চিকিৎসাসেবায় পরিবর্তন আনাই অঙ্গীকার

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭তম বছরে পদার্পণ

ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান
৩০ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
চিকিৎসাসেবায় পরিবর্তন আনাই অঙ্গীকার

আজ ৩০ এপ্রিল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ২৬ বছর পূর্ণ করে ২৭তম বছরে পদার্পণ করলো। কয়েক দশক ধরে দেশ-বিদেশে চিকিৎসাসেবা ও গবেষণায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় এক অনন্য নাম। উচ্চতর মেডিক্যাল শিক্ষায়ও রেখেছে বড় অবদান। আজকের এই বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা, ইতিহাসের মহানায়ক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করছি। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আমার চিরকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। এবারের বিশ্ববিদ্যালয় দিবসটি এমন এক সময়ে উদযাপিত হচ্ছে যখন প্রখ্যাত চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. দীন মোহাম্মদ নূরুল হক উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী এই গুণী শিক্ষক ও চিকিৎসককে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগদানের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে নবজাগরণের সৃষ্টি হয়েছে। উচ্চতর মেডিক্যাল শিক্ষা, চিকিৎসাসেবা ও স্বাস্থ্য গবেষণা কার্যক্রম আরও জোরদার ও উন্নত করার পাশাপাশি দ্রুততম সময়ের মধ্যে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল পূর্ণাঙ্গরূপে চালু করার বিষয়ে নবনিযুক্ত উপাচার্য সফল হবেন বলে বিশ্বাস করি।

বিশ্ববিদ্যালয় দিবস ও প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে অনুষ্ঠান যা-ই পালন করা হোক না কেন সেটা বড় কথা নয়, সবচেয়ে বড় কথা হলো উন্নত সেবা ও গবেষণার মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। আর সেটাই ২৭তম বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের অঙ্গীকার। দেশরত্ন শেখ হাসিনা চিকিৎসা শিক্ষার পাশাপাশি গবেষণায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে বলেছেন। গবেষণা ছাড়া স্বাস্থ্যসেবা উন্নত হতে পারে না সেটা আমাদের মনে রাখতে হবে। জাতির পিতার নামে প্রতিষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বের বুকে মর্যাদার আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে আমাদের সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে।

আইপিজিএমএন্ডআর ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা : বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে গবেষণার জন্য স্বাধীনতা-পূর্ব ১৯৬৫ সালের ডিসেম্বরে প্রতিষ্ঠিত তৎকালীন আইপিজিএমএন্ডআর-কে গবেষণা করার জন্য বঙ্গবন্ধু প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যেও চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে সুস্পষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। স্নাতকোত্তর শিক্ষার ক্ষেত্রে আইপিজিএমএন্ডআর-কে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) যখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে শাহবাগে স্থানান্তর করা হয় তখন শয্যা সংখ্যা ছিল ৩০০। বঙ্গবন্ধু শয্যা সংখ্যা আরও বৃদ্ধি করে ৫০০ শয্যায় উন্নীত করেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ৮ অক্টোবর তৎকালীন আইপিজিএমএন্ডআর-এ কেন্দ্রীয় রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগের উদ্বোধন করেন। ১৯৯৬ সালে জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা বর্তমানে বিশ্বনেতার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে নিয়ে এককভাবে সরকার গঠন করার মাত্র দুবছরের মধ্যে ১৯৯৮ সালের ৩০ এপ্রিল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দেশের প্রথম মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।’ প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ঐকান্তিক সদিচ্ছাতেই পূরণ হয়েছিল এ দেশের চিকিৎসক সমাজের তিন দশকের দাবি।

চিকিৎসা শিক্ষা : তৎকালীন আইপিজিএমএন্ডআর-এর যাত্রা শুরু হয়েছিল ৭টি কোর্স দিয়ে। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এমডি, এমএস, এমপিএইচ, এমফিল, ডিপ্লোমাসহ পোস্ট গ্রাজুয়েট বিষয়ের সংখ্যা ১০৬টি। রেসিডেন্সি কোর্সের সংখ্যা ৭০টি। অধিভুক্ত মেডিক্যাল কলেজ ও ইনস্টিটিউটের সংখ্যা ৫৪টি। অনুষদের সংখ্যা ৭টি। বিভাগের সংখ্যা ৫৭টি। রয়েছে ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরোডিসঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম (ইপনা)। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের লক্ষ্যে প্রতিবছর ৮ শতাধিক ছাত্রছাত্রী ভর্তি হচ্ছেন এবং প্রায় ৫ হাজার শিক্ষার্থীর পদচারণায় মুখরিত থাকছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। দেশের শিক্ষার্থী ছাড়াও নেপাল, ভারত, বতসোয়ানা, সোমালিয়া, ইরান, কানাডা, মালদ্বীপ, অস্ট্রেলিয়া, ভুটানসহ বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। চালু করা হয়েছে বহুল প্রত্যাশিত পিএইচডি প্রোগ্রাম।

স্বাস্থ্যবিষয়ক গবেষণা : বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা দিবস নিয়মিত পালিত হচ্ছে। প্রতিবছর শিক্ষক, শিক্ষার্থীকে গবেষণা মঞ্জুরি প্রদান করা হচ্ছে। গবেষণা কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে ইম্পিরিয়াল কলেজ অব লন্ডন, ভারতের মুম্বাইয়ের টাটা মেমোরিয়াল সেন্টার, সুইজারল্যান্ডের জুরিখ ইউনিভার্সিটি, ওয়ার্ল্ড ওয়াইড হসপিস অ্যান্ড প্যালিয়েটিভ কেয়ার অ্যালায়েন্স, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, রকফেলার ফাউন্ডেশন, জাপানের নাগোয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চিকিৎসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর সম্পন্ন হয়েছে এবং এ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। করোনা ভাইরাসের ভ্যারিয়েন্ট নির্ধারণে ও টিকার কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে বিশ্বমানের গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। এ বিষয়ে একাধিক গবেষণার ফলাফল প্রকাশ হয়েছে।

চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরে গড়ে ২০ লক্ষাধিক রোগী চিকিৎসাসেবা নিয়ে থাকেন। প্রতিবছর মেজর ও মাইনর অপারেশনসহ কমপক্ষে ৫০ হাজার রোগীর অপারেশন করা হয়। বহির্বিভাগে প্রতিদিন নতুন-পুরনো মিলিয়ে ৮০০০ রোগী চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন। বৈকালিক স্পেশালাইজড আউটডোরে প্রতিদিন ১০০০ রোগী সেবা গ্রহণ করছেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা প্রায় ২০০০টি, এর মধ্যে অর্ধেকই গরিব রোগীদের জন্য বিনা ভাড়ার বিছানা। এসব শয্যাতে ভর্তিকৃত রোগীদের ২৪ ঘণ্টাই সেবা দেওয়া হচ্ছে।

উল্লেখযোগ্য সাফল্য : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্য ও উল্লেখযোগ্য কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছেÑ ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরোডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম (ইপনা) প্রতিষ্ঠা, শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের শিশুদের জন্য কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট কার্যক্রম, শিশু হৃদরোগীদের জন্য চিকিৎসাসেবা ও শিক্ষা কার্যক্রম, অত্যাধুনিক আইসিইউ, এনআইসিইউ ও ওটি কমপ্লেক্স চালু, সর্বাধুনিক লিনিয়ার এক্সিলেরেটর মেশিন চালু, বীর মুক্তিযোদ্ধা চিকিৎসা সেল গঠন, সেন্টার অব এক্সিলেন্স প্রকল্পের সফল বাস্তবায়ন ইত্যাদি।

আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আগামী দিনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল স্থাপনের উদ্দেশ্য সফলভাবে বাস্তবায়ন করা। দক্ষ লোক নিয়োগের মাধ্যমে বেতার ভবনে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল-২ নির্মাণ সফলভাবে বাস্তবায়ন করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাসেবা, শিক্ষা ও গবেষণাকে গতিশীল করতে ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস কার্যক্রম চালু করা, রেসিডেন্ট চিকিৎসক, ছাত্রছাত্রী, কর্মকর্তা, নার্স ও কর্মচারীদের আবাসিক সমস্যার সমাধান করা, সাধারণ জরুরি বিভাগকে পূর্ণাঙ্গরূপে চালু করা, বহির্বিভাগে আসা রোগীদের চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তি সহজতর করা, রোগীদের বিভিন্ন ধরনের টেস্ট বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ-সুবিধা আরও বৃদ্ধি করা ইত্যাদি।

সর্বোপরি প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ‘রূপকল্প ২০৪১,’ ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’-এর সঙ্গে সাযুজ্য রেখে এই হাসপাতালের সব কার্যক্রম ডিজিলাইজেশন করা প্রয়োজন। ফলে সেবা দানকারী ও সেবা গ্রহণকারী হবে স্মার্ট সিটিজেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হবে স্মার্ট গভর্নেন্স এবং পর্যায়ক্রমে এ উদ্যোগ দেশ ও সমাজের স্মার্ট ইকোনমি ও স্মার্ট সোসাইটি গঠনে ভূমিকা রাখবে। পরিশেষে বলতে চাই যে, দেশের মেডিক্যাল শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবার উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর অবদান চিরস্মরণীয় ও অনস্বীকার্য। বর্তমান বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে ও উন্নত বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করতে সব বাধা পেরিয়ে দেশকে অগ্রগতি ও উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়কে চিকিৎসা শিক্ষা, চিকিৎসাসেবা ও গবেষণার ক্ষেত্রে বিশ্বমানে উন্নীত করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা মেনে নবনিযুক্ত উপাচার্য অধ্যাপক ডা. দীন মোহাম্মদ নূরুল হকের নেতৃত্বে এখানে কর্মরত সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করব এই হোক ২৭তম বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের অঙ্গীকার।


ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান : অধ্যাপক রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগ ও উপ-উপাচার্য (একাডেমিক), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়