হুমায়ুন আজাদ : আমার বাবা
বাবার জন্মদিনে তাকে নিয়ে লিখতে বসে কত কি যে মনে পড়ছিল। ঘরের হুমায়ুন আজাদ সম্পর্কে জানার পাঠকের অনেক আগ্রহ, তা আমি জানি, আর তাই তো বিভিন্ন পত্রিকা থেকে তাকে নিয়ে বারবার লেখার তাগিদ পাই।
মনে পড়ে, বাবা কখনো বাংলা-ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলতেন না। আপনারা জানেন, আমার বাবা এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে ‘প্রনোমিনালাইজেশন ইন বেঙ্গলী’ শীর্ষক শিরোনামে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। আমাদের দেশে যারা বিদেশে সামান্য ডিপ্লোমা সার্টিফিকেট নিয়ে দেশে ফেরেন, তারাও কথায় কথায় ইংরেজি বলেন। কিন্তু আমার বাবাকে আমি কখনো বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে কথা বলতে শুনিনি। আশ্চর্যজনক যে, তিনি তার মোবাইল নম্বরটিও সবাইকে বাংলায় বলতেন।
আমার মনে আছে, তিনি রাজউক থেকে যখন একটা প্লট পান, তখন প্লট পাওয়া সংক্রান্ত যে চিঠিটি তাকে রাজউক থেকে দেওয়া হয়, তিনি সেই চিঠিটির বানান ও বাক্যের অসংখ্য ভুল ধরেন ও সংশোধিত চিঠি পাঠানোর জন্য রাজউককে পত্র দেন। আমার মা তখন বলেছিলেন এই চিঠি পেলে রাজউক কিন্তু তোমার প্লট ক্যানসেল করে দেবে কিন্তু বাবা সে কথা শোনেননি।
তিনি আসলে এমনই ছিলেন। তার উপরে-নিচে বা পাশে কে আছেন সে কথা ভেবে তিনি কথা বলতেন না। তিনি নিজে যা সঠিক মনে করতেন তাই বলতেন ও করতেন। এ প্রসঙ্গে একবার আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তিনি এটা কীভাবে করেন? তিনি কি পরবর্তী অবস্থা/ঝামেলার কথা মাথায় রাখেন না? তিনি বলেছিলেন -‘মৌলি আমার যা কিছু অর্জন করতে হবে তা আমি নিজের যোগ্যতা দিয়েই করব, কারও ওপর নির্ভর করে না। তাই আমার কোনো ভয় নেই।’
এজন্য অবশ্য তার শত্রু তৈরি হতে দেরি হয়নি।
তিনি তার কবিতায় বলেছেন ‘বাস করে গিয়েছি সাপের গুহায়; সাবধান হতে শিখিনি কখনো; কত বিষধর বসিয়েছে দাঁত, ক্ষতে ছেয়ে গেছে দেহ, বিষে ভরে গেছে নালি, বিষকে করেছি রক্ত, ক্ষতকে সোনালি রুপালি’।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
মনে পড়ল, তিনি যখন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিলেন, তখন পুরস্কারের মূল্যমান ছিল ২৫,০০০ টাকা। আমাদের বাসায় তখন সাদাকালো টিভি ছিল। আমরা ভাইবোনরা তখন ছোট ছিলাম। বায়না ধরেছিলাম রঙিন টিভির। পুরস্কারের টাকায় তিনি রঙিন টিভি কিনেছিলেন ঠিকই কিন্তু কিছুদিন পর তা চুরি হয়ে যায়।
এবার আসি ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৪-এর কথায়। যে দিনটির কথা মনে পড়লে আজও আমার শরীর কাঁপতে থাকে। এরকম দিন আমাদের জীবনে যে এসেছিল তা আমি ভুলতে চাই, যদিও তা সম্ভব নয়। আমার মনে পড়ে একজন সাংবাদিকের ফোনে আমরা তার আক্রান্ত হওয়ার খবর পাই এবং দৌড়ে ঢাকা মেডিকেলে যাই। ঢাকা মেডিকেলে আমি রক্তে ভেজা, ব্যান্ডেজে মোড়ানো বাবাকে দেখতে পাই। কিন্তু তখনও আমি তাকে ভেঙে পড়তে দেখিনি। সেই অবস্থাতেও তিনি পুলিশের গাড়িতে চড়তে চাননি।
তিনি কোনো সংঘ করতেন না। তিনি অন্য বুদ্ধিজীবীদের মতো গুছিয়ে মিষ্টি কথাও বলতেন না। ২৭ ফেব্রুয়ারি তার ওপর আক্রান্তের ঘটনায় সারা বাংলাদেশ ফুঁসে উঠেছিল। তার আহত অবস্থা থেকে সুস্থ হওয়ার পর পত্রিকার কাটিংগুলো আমি তাকে দেখিয়েছি। দেখেছি, তার চোখ বেয়ে কাটা গালের ওপর গড়িয়ে পড়েছে অশ্রু। এরপর ২০০৪ সালের ১২ই আগস্ট তিনি জার্মানিতে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর দুর্জনরা বলেন যে, হুমায়ুন আজাদ অত্যধিক মদ্যপানের ফলে জার্মানিতে মারা গিয়েছেন।
আমি জানি এ বিষয়ে আপনাদের অনেক জিজ্ঞাসা। তাই বলছি জার্মানি থেকে বাবার মৃত্যু সম্পর্কিত যে রিপোর্ট আমরা পাই, সেখানে লেখা ছিল তিনি হার্টফেল করে মারা গেছেন। ডাক্তারি পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তার শরীরে অ্যালকোহল পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ তার সম্পর্কে বাজে ধারণা তৈরির জন্য মিথ্যা তথ্য প্রচার করা হয়েছিল। এ বিষয়ে জার্মান এম্বেসি থেকে জার্মানির উকিল নিয়োগ করে আমাদের আরও তদন্ত করতে বলা হয়। যা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
হুমায়ুন আজাদের ওপর সব সময় একটি গোষ্ঠীর প্রচণ্ড রাগ ছিল, হয়তো এখনো আছে। লেখার মাধ্যমে তিনি যে অনেকের মুখোশ উন্মোচন করেছেন তা তাদের পছন্দ হয়নি। সর্বশেষ লেখা ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ উপন্যাসটি পড়ে তারা তখন হয়ে পড়ে হিংস্র। তারা হাতে তুলে নেয় চাপাতি। সেই সঙ্গে আমি হারাই আমার বাবাকে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
বাংলাদেশকে অসম্ভব ভালোবাসতেন তিনি। বাংলাদেশের যে কোনো সংকটে আমি তাকে দেখেছি প্রচণ্ড কষ্ট পেতে ও মাঝে-মধ্যে তিনি হতাশ হয়ে পড়তেন। ২০০৩ সালে প্রকাশিত তার বই ‘আমরা কী এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম’ যার উৎসর্গপত্রে তিনি লিখেছেন-
তার ধানক্ষেত এখনো সবুজ, নারীরা এখনো রমণীয়, গাভীরা এখনো দুগ্ধবতী কিন্তু প্রিয়তমা, বাংলাদেশের কথা, তুমি কখনো আমার কাছে জানতে চেও না।
আমি তা মুহূর্তেও সহ্য করতে পারি না, তার অনেক কারণ রয়েছে।
হুমায়ুন আজাদ মানেই কী তবে কঠিন কঠিন কথা। প্রথাবিরোধিতার কথা বলা। না তা নিশ্চয়ই নয়। তিনি কিশোরদের জন্য কোমল ভাষায় লিখেছেন ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না, লাল নীল দীপাবলি, আমাদের শহরে একদল দেবদূতসহ অসংখ্য কিশোর উপন্যাস। তার কবিতা ও প্রবচন আজ বিশেষ বিশেষ দিবসে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়ায়। বাইরে কঠিন কিন্তু ভেতরে কোমল হুমায়ুন আজাদ খেলতেন দাবা। তার কন্যাদেরসহ তার সব নারী শিক্ষার্থী ও অন্যদের তিনি আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী দেখতে চাইতেন।
হুমায়ুন আজাদ আজ আর নেই। কিন্তু রেখে গেছেন ৬০-এর অধিক বই। হুমায়ুন আজাদের বই মানে মুক্ত চিন্তার কথা, প্রথা ভাঙার কথা, বিজ্ঞানের দিকে আকৃষ্ট হওয়ার কথা। আপনারা তার বই পড়ুন। পরবর্তী প্রজন্মকে তার বই পড়তে উৎসাহিত করুন। কারণ এখন বেশিরভাগ মানুষই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে চান না। গা বাঁচানো কথাবার্তা বলেন। নিজের স্বার্থের জন্য নীতি-নৈতিকতায় ছাড় দিতে বিন্দুমাত্র সময় নেন না। এভাবে বছরের পর বছর কোনো সমাজ চলতে পারে না। আমাদের দরকার হুমায়ুন আজাদের মতো আরও অসংখ্য মানুষ। আমার বিশ্বাস, তার বই পড়লেই সৃষ্টি হবে এরকম অসংখ্য মুক্ত চিন্তার মানুষ।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
আজ তার জন্মদিন। বেঁচে থাকলে ৭৭ বছরে পা দিতেন। সে সৌভাগ্য তার হলো না। বেঁচে থাকতে জন্মদিন আয়োজনে তার বিশেষ কোনো আগ্রহ আমি দেখিনি। তাই মৃত্যুর পর তার জন্মদিন পালনে আমাদের পরিবারেরও নেই কোনো আগ্রহ। পাঠকের মনের মাঝেই তিনি বরং বেঁচে থাকুক। জন্মদিনে তার প্রতি শ্রদ্ধা।
মৌলি আজাদ : প্রাবন্ধিক