বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে কমানো হোক তামাকের ঝুঁকি
তামাকের ঝুঁকি কমিয়ে আনতে সক্ষমতা দেখিয়েছে পৃথিবীর একাধিক দেশ। একটি গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, তামাকের ক্ষতিহ্রাস কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে বাংলাদেশে ৯ লাখ ২০ হাজার জীবন রক্ষা করা সম্ভব। বিশেষজ্ঞদের মতে, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টান্ত সামনে রেখে বিষয়টি নিয়ে যথাযথ আলোচনা হওয়া উচিত। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যেসব দেশ এরই মধ্যে সফল হয়েছে তারা কীভাবে এগিয়েছে? তাদের কৌশল কী ছিল এসব বিষয় আমলে নেওয়া খুব প্রয়োজন। কারণ অবাস্তব, অবৈজ্ঞানিক ও তাড়াহুড়ো করে নেওয়া পরিকল্পনা জনস্বাস্থ্যের জন্য বুমেরাং হতে পারে। যার ক্ষয়ক্ষতিটা হতে পারে আশঙ্কাজনক।
তামাকের ঝুঁকিহ্রাসে সফল হওয়া দেশগুলোর মধ্যে আছে সুইডেন, নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি দেশ। একাধিক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ধূমপায়ীদের অভ্যাস দূর করতে এসব দেশে দীর্ঘমেয়াদি কৌশল নেওয়া হয়েছে, বৈজ্ঞানিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে মিলেছে সুফল যা টেকসই।
ধূমপানের অভ্যাস রোধে তামাকের ঝুঁকি কমিয়ে আনার পক্ষে মত দিচ্ছেন আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্যবিদরা। বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে ‘টোব্যাকো হার্ম রিডাকশন’ বা টিএইচআর কৌশলটি তুলে ধরছেন। ধূমপায়ীরা যেন দীর্ঘদিনের এই অভ্যাস থেকে চিরতরে মুক্ত হতে পারেন সেদিকেই জোর দেওয়া হয়েছে ওই কৌশলে। যেখানে বলা হয়েছে, তামাকের বিকল্প হিসেবে ভেপিংসহ অন্যান্য সিগারেটের বিকল্প নিরাপদ পণ্য ব্যবহারের মাধ্যমে ধীরে ধীরে অভ্যাসের পরিবর্তন আনা সম্ভব। ভেপিং প্রচলিত সিগারেটের চেয়ে ৯৫ শতাংশ কম ক্ষতিকর। ধূমপানের বিকল্প হিসেবে ভেপিং কার্যকর ফল এনেছে। বেশ কয়েকটি দেশ ওই পথেই এগিয়েছে এবং ধূমপানের বিকল্পের মাধ্যমে তামাকের ঝুঁকিহ্রাসে সফল হয়েছে।
সম্প্রতি ‘লাইভস্ সেভড’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে টিএইচআর-এর কার্যকারিতা। কৌশলটি অনুসরণ করে সফল হয়েছে নিউজিল্যান্ড। ধূমপানের বিকল্প ভেপিং ব্যবহারের মাধ্যমে ধূমপায়ীর সংখ্যা হ্রাসে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে দেশটি। ২০১৭-১৮ সালে ধূমপায়ীর হার ছিল ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ। যা ২০২২-২৩ সালে ৬ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে এসেছে। একই কৌশলে এগিয়েছে যুক্তরাজ্য। ২০২২ সালে ধূমপায়ীর হার দেশটিতে ২ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে এসেছে। সুইডেনও একই পথ অনুসরণ করে ধূমপানের হার কমিয়ে নিয়ে আসছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়েও এমন গবেষণা হয়েছে। পাবলিক হেলথ ইমপ্লিকেশন অব ভেপিং ইন দ্য ইউএসএ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, কৌশল গ্রহণের মাধ্যমে ২০১৩-২০৬০ পর্যন্ত ১৮ লাখ (১.৮ মিলিয়ন) অকাল মৃত্যু রোধ করা সম্ভব।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
সারা বিশ্বে ১১ কোটি ২০ লাখ মানুষ (১১২ মিলিয়ন) ধূমপানের বিকল্প ব্যবহার করছে। বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোতে এর ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। আর এভাবে দেশকে তামাকমুক্ত করা যায় এর উদাহরণ সুইডেন, যুক্তরাজ্য, জাপান, লিথুয়ানিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র।
বাংলাদেশে ৯ লাখেরও বেশি জীবন বাঁচানো সম্ভব ‘লাইভস্ সেভড’-এর গবেষণায় এসেছে বাংলাদেশেরও কথা। গবেষণায় বলা হয়েছে, টিএইচআর কৌশল গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ আগামী চার দশকে ৯ লাখেরও বেশি মানুষের জীবন বাঁচাতে পারবে। বাংলাদেশসহ চারটি নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ নিয়ে প্রতিবেদনটি করা হয়। সেখানে বলা হয়েছে, তামাকের ঝুঁকিহ্রাস কৌশল গ্রহণের মাধ্যমে ওই দেশগুলো কীভাবে মানুষের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে।
বাংলাদেশ ছাড়া গবেষণায় আলোচনা করা অন্য তিনটি দেশ হচ্ছে- কাজাখস্তান, পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকা। গবেষণায় বলা হয়, কৌশলটি প্রণয়নের মাধ্যমে চারটি দেশ ২৫ লাখেরও (২.৫ মি) বেশি মানুষের জীবন রক্ষা করতে পারবে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
সংখ্যাটা কাজাখস্তানে ১ লাখ ৬৫ হাজার, দক্ষিণ আফ্রিকায় ৩ লাখ ২০ হাজার ও পাকিস্তানে ১২ (১.২ মি) লাখেরও বেশি।
ল্যানসেটের নিবন্ধেও একই দাবি : প্রভাবশালী চিকিৎসাবিজ্ঞান সাময়িকী ল্যানসেটে প্রকাশিত নিবন্ধেও উঠে এসেছে টিএইচআর কৌশলের যৌক্তিকতা। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ রবার্ট বেগলহোল ও রুথ বনিতা কৌশলের যৌক্তিকতা তাদের নিবন্ধে তুলে ধরেন। যা চলতি বছর ল্যানসেটে প্রকাশিত হয়। রবার্ট বেগলহোল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ক্রনিক ডিজিজ ও হেলথ প্রমোশন বিভাগের সাবেক পরিচালক। বর্তমানে তিনি ল্যানসেটের অসংক্রামক রোগবিষয়ক অ্যাকশন গ্রুপের চেয়ার। অন্যদিকে রুথ বনিতা অকল্যান্ড ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস অধ্যাপক। তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অসংক্রামক রোগবিষয়ক শাখার পরিচালকের দায়িত্বও পালন করেন। নিবন্ধে লেখকরা দাবি করেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি)-এ টিএইচআর কৌশলকে গ্রহণ করে নেওয়া উচিত। দুই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মনে করেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভেপিংসহ ধূমপানের অন্যান্য বিকল্পকে প্রচলিত তামাক হিসেবে মনে করে, যার কোনো বৈজ্ঞানিক যৌক্তিকতাই নেই। তামাকের ঝুঁকি কমিয়ে আনতে বা ধূমপায়ীর সংখ্যা কমিয়ে আনতে সফল হয়েছে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোই। যার মূল প্রভাবক আসলে দেশগুলোর অর্থনীতি বা সমৃদ্ধিও নয়। বরং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও গবেষণার দিকেই আস্থা রেখেছে দেশগুলো। অর্থ বা সামাজিক কোনো বাধা নয় বরং সুদূরপ্রসারী কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমেই সফল হওয়া সম্ভব। সেই প্রেক্ষিতেই নিম্নমধ্যম আয়ের দেশগুলোতেও এ নিয়ে হচ্ছে গবেষণা। যেখানে বাংলাদেশের ব্যাপারেও জনস্বাস্থ্যবিদরা একই পরামর্শ দিচ্ছেন। প্রয়োজনে দেশের উদ্যোগেই দেশীয় গবেষণা সংস্থার মাধ্যমেও বিষয়টি নিয়ে কাজ হতে পারে। যথাযথ গবেষণা, বৈজ্ঞানিক পদক্ষেপে জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। ডায়রিয়া, কলেরা, ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে বাংলাদেশ ঈর্ষণীয় সফলতা দেখিয়েছে। যেখানে নেওয়া হয়েছে বাস্তবসম্মত ও বৈজ্ঞানিক পদক্ষেপ। আশা করি তামাকের ঝুঁকি কমাতেও বাংলাদেশ সফল হবে।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
ডা. মো. জুবায়ের আল হোসাইন : ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল অফিসার, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল