মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনার আওতায় অর্থায়ন

ড. খলিলুর রহমান
১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনার আওতায় অর্থায়ন

বৈশ্বিক কার্বন নির্গমনে ন্যূনতম অবদান থাকা সত্ত্বেও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। দেশটি যখন এর ১৭ কোটি মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি এবং উন্নত জীবনযাত্রার জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে তখন জলবায়ু পরিবর্তনজনিত চরম আবহাওয়া ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, বিধ্বংসী বন্যা ও খরা, তীব্র গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততার মাত্রা বৃদ্ধি, নদীর তীরের ভাঙন এবং সমুদ্রের অম্লতা বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসকারী লাখ লাখ মানুষের জীবন ও জীবিকা ধ্বংস করছে। বাংলাদেশের ৯ কোটি মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অতিঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে বসবাস করছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে উপকূল বরাবর বসবাসকারী দেশটির শতকরা ২০ শতাংশ মানুষ বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশঙ্কায় আছে। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তঃসরকার প্যানেল (Intergovernmental Panel on Climate Change - IPCC)-এর সর্বশেষ অর্থাৎ ষষ্ঠ মূল্যায়ন প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১২ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের মিঠা পানি সরবরাহকারী নদীর মোট আয়তন ৪০.৮ শতাংশ থেকে ১৭.১ শতাংশে হ্রাস পাবে যা উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবনধারা আরও কঠিন ও দুর্বিষহ করে তুলবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ ইতোমধ্যে অসংখ্য প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম ২০০৯ সালে নিজস্ব অর্থায়নে ৪৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট তহবিল গঠন করেছে। ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম (সিভিএফ)-এর দু-দুবার সভাপতির দায়িত্ব পালনকালে প্রধানমন্ত্রী জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক ফোরামে গৃহীত কার্যক্রমেও নেতৃত্ব দেখিয়েছেন। তার নেতৃত্বে সিভিএফ ৬৮টি জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশের সত্যিকারের কণ্ঠে রূপান্তরিত হয়েছে। ২০২১ সালের নভেম্বরে গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত কপ-২৬ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিবিসি সম্মেলনের ফলাফলকে প্রভাবিত করবে এমন পাঁচজন বিশ্বনেতার একজন হিসাবে চিহ্নিত করেছিল। আমাদের এতসব প্রশংসনীয় উদ্যোগ থাকা সত্ত্বেও সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় অভিযোজন (adaptation) এবং প্রশমন (mitigation) প্রকল্পগুলোর অর্থায়নে উল্লেখযোগ্য ঘাটতি রয়ে গেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ অভিযোজন খাতে বার্ষিক প্রায় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করে যেখানে বিশ্বব্যাংকের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী ২০৫০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর আনুমানিক ৫.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রয়োজন হবে। এই আর্থিক ঘাটতি মেটাতে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে Blended Finance ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় মূলধন প্রবাহ নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। এ লক্ষ্যে অভিযোজন ও প্রশমন খাতে আগামী দশকের মধ্যে প্রায় ৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের উচ্চাকাক্সক্ষী লক্ষ্য নিয়ে সরকার সম্প্রতি মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা (Mujib Climate Prosperity Plan - MCPP) প্রণয়ন করেছে। অধিকন্তু বাংলাদেশ সম্প্রতি জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (National Adaptation Plan - NAP) গ্রহণ করেছে যার আওতায় আমাদের অভিযোজন খাতে ২০৫০ সালের মধ্যে ২৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থায়নের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

এই আর্থিক ঘাটতি বিবেচনা করে মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা এবং অন্যান্য পরিকল্পনার আওতায় গৃহীত প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় জলবায়ু অর্থায়ন সুরক্ষিত করতে অর্থনৈতিক কূটনীতির অংশ হিসেবে বাংলাদেশকে জলবায়ু কূটনীতি জোরদার করতে হবে। কানাডায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার হিসেবে আমি অর্থনৈতিক কূটনীতিকে অগ্রাধিকারের অংশ হিসাবে অভিযোজন এবং প্রশমন খাতে অর্থায়নের জন্য যখনই সুযোগ হয়েছে কানাডার সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। সম্প্রতি এ বিষয়ে আমি ব্রুকফিল্ড অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের চেয়ারম্যান এবং জলবায়ু কার্যক্রম সম্পর্কিত জাতিসংঘের বিশেষ দূত মার্ক কার্নি এবং কানাডিয়ান পেনশন ফান্ড (CDPQ)-এর প্রধান রাষ্ট্রদূত মার্ক-আন্দ্রে ব্ল্যানচার্ডের সঙ্গে ফলপ্রসূ বৈঠক করেছি। এখানে উল্লেখ্য যে, ব্রুকফিল্ড আরব আমিরাতে অনুষ্ঠিত গত কপ-২৮ সম্মেলনে সৃষ্ট Catalytic Transition Fund (ÔCTFÕ)-টি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পেয়েছে। অধিকন্তু কানাডিয়ান পেনশন ফান্ড সংযুক্ত আরব আমিরাতের অখঞঊজজঅ ও সিঙ্গাপুরের ঞবসধংবশ-এর সঙ্গে ঈঞঋ ফান্ডটির অর্থায়ন করেছে। এই মাল্টি-বিলিয়ন-ডলারের ঈঞঋ ফান্ড উদীয়মান এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার, শিল্প খাতে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস, টেকসই জীবনযাপন এবং অন্যান্য জলবায়ু প্রযুক্তি খাতে অর্থায়ন করবে।

বৈঠকগুলোতে আলোচনাকালে আমি তাদের মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনার আওতায় আমাদের অভিযোজন ও প্রশমন খাতে অর্থায়নের সুযোগ সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরেছি। ফলে বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অভিযোজন এবং প্রশমন প্রচেষ্টায় সম্ভাব্য বৈদেশিক অর্থায়নের পথ খুলে যাওয়ার একটি সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। তারা আমাকে জানিয়েছেন যে, সরকার যদি আমাদের অভিযোজন কর্মসূচিতে Blended Finance পদ্ধতি অনুসরণ করতে ইচ্ছুক হয় তবে CTF-এর আওতায় বাংলাদেশে বিনিয়োগ করা সম্ভবপর হবে। হাইকমিশন থেকে আমরা এখন ব্রুকফিল্ড ও ঈউচছ-এর সঙ্গে সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগের মধ্যে সমন্বয় সাধন করছি। এই বিষয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনার জন্য মার্ক কার্নি এবং রাষ্ট্রদূত মার্ক-আন্দ্রে ব্ল্যানচার্ডের সঙ্গে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর শিগগিরই একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।

পরপর তিনটি সফল মূল্যায়নের পর বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ২০২৬ সালে জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন করেছে। উত্তরণ-পরবর্তী সময়ে উন্নয়নের ধারা বজায় রেখে উন্নয়ন ফাঁদ (Development Trap) এড়াতে অভিযোজন এবং প্রশমনসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য অর্থনৈতিক কূটনীতির গুরুত্ব অপরিসীম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অর্থনৈতিক কূটনীতিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন এবং পাঁচটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন। যার মধ্যে রয়েছে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা, রপ্তানি পণ্যের সম্প্রসারণ ও বহুমুখীকরণ, আমাদের প্রবাসীদের মানসম্মত সেবা প্রদান ও দেশ গঠনের তাদের সম্পৃক্তকরণ, সহজ শর্তে গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তির হস্তান্তর এবং বিদেশে আমাদের জনগণের জন্য লাভজনক কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা।

তা সত্ত্বেও সরকারের সমন্বিত কৌশলের অভাবে অর্থনৈতিক কূটনীতির ক্ষেত্রে আমাদের সাফল্য সীমিত। প্রতিবছর জানুয়ারিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোর প্রধানদের কাছে অর্থনৈতিক কূটনীতি জোরদার করতে নির্দেশনা প্রদান করে একটি নামকাওয়াস্তে চিঠি পাঠানো হয়। তবে দুঃখের বিষয় যে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী সরকার অর্থনৈতিক কূটনীতির লক্ষ্যসমূহ পূরণের জন্য দূতাবাসগুলোকে প্রয়োজনীয় রিসোর্স কিংবা সুনির্দিষ্ট কৌশল প্রদান করতে পারেনি। এমনকি অর্থনৈতিক কূটনীতি বাস্তবায়ন করার জন্য কোনো প্রকার আন্তঃমন্ত্রণালয় ব্যবস্থাও নেই। কয়েকটি দেশ থেকে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে তাদের বিনিয়োগকারীদের আস্থা গড়ে তোলার জন্য সুনির্দিষ্ট দ্বিপাক্ষিক চুক্তি সম্পন্ন করা প্রয়োজন। কানাডার ক্ষেত্রে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য দেশটির সঙ্গে বৈদেশিক বিনিয়োগ সুরক্ষা চুক্তি (Foreign Investment Protection Agreement - FIPA) চূড়ান্ত করা অপরিহার্য। ২০১২ সাল থেকে এ নিয়ে আলোচনা শুরু হলেও আমাদের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় একটি চুক্তির খসড়া তৈরি করতে না পারায় গত এক দশকের বেশি সময়েও এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি। হাইকমিশন থেকে বারবার বিভিন্নভাবে যোগাযোগ ও অনুরোধ করার পর অবশেষে গত মার্চে সরকারের পক্ষ থেকে কানাডাকে আনুষ্ঠানিকভাবে বৈদেশিক বিনিয়োগ সুরক্ষা চুক্তি সম্পন্ন করতে কারিগরি আলোচনা শুরুর প্রস্তাব দেওয়া হয়। আমি আশা করি, সরকার এখন যত দ্রুত সম্ভব কানাডার সঙ্গে বৈদেশিক বিনিয়োগ সুরক্ষা চুক্তি সম্পন্ন করার প্রক্রিয়াটি এগিয়ে নিয়ে যাবে।

পরিশেষে আমাকে বলতেই হবে যে, অর্থনৈতিক কূটনীতির কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা বিভাগ প্রায়ই কোনো প্রকার সমন্বয় ছাড়াই বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক মন্ত্রণালয় বা সংস্থাগুলোকে তাদের এ সংক্রান্ত কার্যক্রমের সমন্বয় সাধনের জন্য একটি স্থায়ী আন্তঃমন্ত্রণালয় ব্যবস্থার মাধ্যমে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি অনুবিভাগকে শক্তিশালী করা প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রীর ভিশন ও নির্দেশনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক কূটনীতির প্রসারের জন্য পর্যাপ্ত চিন্তাভাবনা ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের সময় এসেছে। পররাষ্ট্র দপ্তর, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং বিদেশে আমাদের মিশনগুলো যাতে অর্থনৈতিক কূটনীতির প্রসারে সমন্বিতভাবে কাজ করতে পারে সে লক্ষ্যে সরকারের উচিত একটি বাস্তবভিত্তিক কর্মকৌশল প্রণয়ন করা। কানাডায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার হিসাবে পূর্ণ মেয়াদ শেষ করে আমার আসন্ন প্রস্থানের প্রাক্কালে অর্থনৈতিক কূটনীতি বাস্তবায়নে আমি যে চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হয়েছিলাম তা তুলে ধরার জন্য আমি এই নিবন্ধটি লিখছি। আমার উত্তরসূরির ওপর কানাডা ও অন্যান্য সমবর্তী দায়িত্বপ্রাপ্ত দেশগুলোর সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক জোরদার ও সম্প্রসারণ করতে বাংলাদেশ হাইকমিশন, অটোয়ার অর্থনৈতিক কূটনীতির উদ্যোগকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব বর্তাবে। আমি আশা করি, সরকার অর্থনৈতিক কূটনীতির সঠিক বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক সহযোগিতাসহ অন্যান্য সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে তার কাজকে সহজতর করবে।


ড. খলিলুর রহমান : কানাডায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত