বুয়েট প্রসঙ্গ /

ছাত্র আন্দোলন, ছাত্র সংগঠন, ছাত্র সংসদ বনাম ছাত্র রাজনীতি

মাহবুব জামান
০৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৪:১৪
শেয়ার :
ছাত্র আন্দোলন, ছাত্র সংগঠন, ছাত্র সংসদ বনাম ছাত্র রাজনীতি

আমি কখনো বুয়েটে পড়িনি। ভর্তি হয়েও পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্ট্যাটিসটিকসে চলে এসেছিলাম। কিন্তু আমাদের অধিকাংশ সময় কাটতো বুয়েটে। সোহরাওয়ার্দী হল আর তীতুমির হল ছিল আমাদের আস্তানা। ওদিকে আহসানুল্লাহ হল ছিল বড়দের আস্তানা।

বুয়েটে বিভিন্ন হলগুলোতে এত উঁচুমানের দেয়াল পত্রিকা বের হতো যে আমরা আগ্রহ নিয়ে দেখতে যেতাম, ঈর্ষান্বিত হতাম। এ ব্যাপারে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন রীতিমতো প্রতিযোগিতা করতো। বিষয়বস্তু ,অলংকরণ, সাইজ, গেট আপ সবই অভিনব। আর উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সময় তো বুয়েট ছিলএক জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি। ১৯৭১-এর মার্চের শুরুর দিকে এটা হয়ে গিয়েছিল গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতির প্রাণকেন্দ্র।

সারাদিন মলোটভ ককটেল, পেট্রল বোমা আর বুবি ট্র‍্যাপ তৈরি করে গভীর রাতে প্র‍্যাকটিস হতো জগন্নাথ হলের পেছনে পুরাতন ইটের ঢিবি আর পরিত্যাক্ত পানির ট্যাঙ্কের স্তুপে। যেখানে এখন উদয়ন স্কুলের বিরাট অট্টালিকা।

ছাত্র আন্দোলনের এই অগ্নিগর্ভ প্রাণকেন্দ্র বুয়েটে এখন ‘ছাত্র রাজনীতি’র নামে ছাত্র সংগঠন করা নিষিদ্ধ এবং একে পাকাপোক্ত করার জন্য উদ্যোগ-আয়োজন চলছে। মতামতও দিচ্ছেন ছাত্ররা, প্রাক্তনরা, শিক্ষক, সুশীল সমাজসহ আরও অনেকে।

গতকাল বুয়েট অ্যালামনাইদের একটি লিখিত বক্তব্য দেখে বিস্মিত ও মর্মাহত হলাম। আপনারা কি আপনাদের গৌরবোজ্জ্বল সব অতীত ভুলে গেলেন? 

‘ছাত্র রাজনীতি’-র নামে এখন ছাত্রদের আন্দোলন, সংগঠন, সংসদ সবই নিষিদ্ধ করে দিতে চাচ্ছেন? অথচ আপনাদের মধ্যে অধিকাংশই কিন্তু ছাত্র আন্দোলনের প্রোডাক্ট। 

আপনারা সবাই জানেন ‘ছাত্র রাজনীতি’ এই অদ্ভুত শব্দটির উদয় হলো কোথা থেকে। ১৯৭৬ সাল। সামরিক সরকার ঘরোয়া রাজনীতি অনুমোদন দিল এবং পি পি আর ( পলিটিক্যাল পার্টিজ রেগুলেশন )-এর অধীনে সব রাজনৈতিক দলকে রেজিষ্ট্রেশন করার ফরমান জারি করলো। শর্ত দেওয়া হলো প্রত্যেক দলের ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক ,মহিলা অঙ্গ সংগঠনের নাম ঘোষণা করতে হবে। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে রেজিস্ট্রেশন ছাড়া কোনো ছাত্র সংগঠন কাজ করতে পারবে না। এ কারণেই সবগুলো ছাত্র সংগঠন কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে রেজিস্ট্রেশন নিল।

ঐতিহাসিকভাবে গড়ে ওঠা ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের পাশাপাশি গড়ে উঠল জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ছাত্র সমিতি, ইসলামী ছাত্র শিবির ইত্যাদি। এভাবেই গৌরবোজ্জ্বল ছাত্র আন্দোলন ও সংগঠনের সঙ্গে রাজনীতি শব্দটি যুক্ত হয়ে ‘ছাত্র রাজনীতি’ অভিধা পেল এবং এখন যা অনেকের কাছেই ঘৃণিত, ভয়াবহ, আতঙ্কের ও পরিত্যাজ্য।

‘ছাত্র রাজনীতি’-এই অদ্ভূত শব্দটি আনাই হয়েছে আমাদের গৌরবোজ্জ্বল ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করার হীন উদ্দেশ্যে। 

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা আসে শুধু ক্লাশ করা আর ডিগ্রি লাভের জন্য নয়। আসে বিশ্বকে জানা, সমাজকে বোঝা ও তাদের মেধা বিকাশের জন্য। বিশ্ববিদ্যালয় বা ইউনিভার্সিটির আভিধানিক অর্থও তাই।

পৃথিবীর সব দেশেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র আন্দোলন, সংগঠন এবং সংসদ আছে। নির্বাচিত সংসদগুলোই ছাত্রছাত্রীদের মেধা বিকাশের নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে। এগুলোই হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্য। 

এই সামগ্রিকতাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে একটি ইনকিউবেটর গঠন করার লক্ষ্য হবে বুয়েটের জন্য আত্মঘাতী। বুয়েট আমাদের দেশের গর্ব। আমরা কেউ-ই এটা চাই না। তখন বুয়েট হয়ে যাবে বড় ধরনের একটি টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট বা সেন্টার।

বুয়েট অ্যালামনাইরা নানা তথ্য উপাত্ত দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে গত ৫ বছরে বুয়েটের রেটিং, একাডেমিক স্কোর,সাইটেশন স্কোর ইত্যাদি বেড়েছে। হয়তো ঠিক। তবে আবার এ কথাও ঠিক যে সাম্প্রতিককালে আন্তর্জাতিক কম্পিউটিং, রোবোটিকস, নাসা অ্যাপ, বিতর্ক প্রতিযোগিতা সমূহে বুয়েটের আগের সেই দাপুটে উপস্থিতি আর দেখছি না।

আ্যলামনাইরা এটাও উল্লেখ করেছেন যে পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু টানেল, মেট্রোরেল, গভীর সমুদ্রবন্দর ইত্যাদি মেগা প্রজেক্টে বুয়েটের অবদান রয়েছে। তবে এখানে যারা অবদান রেখেছেন তারা সবাই বুয়েটের ছাত্র আন্দোলন, সংগঠন আমলের- ইনকিউবেটর আমলের নয়।

কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের যথাযথ পরিবেশ রক্ষা করতে ছাত্র সংগঠন, ছাত্র সংসদ কার্যক্রমের বিকল্প নাই। তথাকথিত ‘ছাত্র রাজনীতি’র নামে অপরাজনীতিকে বিতাড়িত করতে হলে নিয়মিত প্রকাশ্য ছাত্র সংগঠন ও ছাত্র সংসদ নির্বাচন একমাত্র পথ। এর মধ্য দিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত পরিবেশ ফিরে আসবে।

প্রাথমিকভাবে ভিসি, প্রো ভিসি, রেজিস্ট্রার, ডিএসডাব্লিউ, প্রভোস্ট, হাউজ টিউটরদের দায়িত্ব কিছুটা বাড়বে। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু একটা স্থায়ী সমাধান হয়ে যাবে। ক্রমান্বয়ে অতীতের পরিবেশ ফিরে আসবে। আবারও বুয়েট হবে সুস্থ ছাত্র আন্দোলনের পথ প্রদর্শক।

কোনো ছাত্র সংগঠনেরই দাপট, দৌরাত্ম, প্রভাব বা একচ্ছত্র চিরস্থায়ী নয়। আমরা দেখেছি, পাকিস্তান আমলের এনএসএফ। মোটরসাইকেল,সাপ, হকিস্টিক আর ছুরি চাপাতির কি দহরম মহরম। স্বাধীনতার পর একচ্ছত্র ছিল ছাত্র ইউনিয়ন-ডাকসু, রাকসু, চাকসু, ইউকসু, বাকসুসহ সব কলেজগুলোই তো তারা। এরপর এলো জাসদ ছাত্র লীগের জোয়ার। এরপর সামরিকতন্ত্র আসার পর থেকে তো নির্বাচনের কালচারই চলে গেছে। এসেছে ‘ছাত্র রাজনীতি’-র যুগ। সেটাই আজো চলছে।

আবার ফিরে আসুক সুস্থ ছাত্র আন্দোলন, ছাত্র সংগঠনের যুগ। নিয়মিত অনুষ্ঠিত হোক ছাত্র সংসদের নির্বাচন।

সাহস করে ১০/২০টা নির্বাচন করলেই বোঝা যাবে ছাত্র-ছাত্রীরা কি চায়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফিরে আসবে সুবাতাস। লেখাটা বেশি বড় হয়ে গেল। দু:খিত।

তবে মাথা ব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার কোনো যুক্তি নাই। আপনাদের মতামত প্রত্যাশা করি।

শুভকামনা...

লেখক: মাহবুব জামান, ডাটাসফট সিস্টেম বাংলাদেশ লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর।