বাস্তবানুগ দৃষ্টিভঙ্গি বনাম আন্দোলনের দূরদৃষ্টিহীনতা

ভারতীয় পণ্য বর্জন

সাইমন মোহসিন
০৭ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
বাস্তবানুগ দৃষ্টিভঙ্গি বনাম আন্দোলনের দূরদৃষ্টিহীনতা

ভারতীয় পণ্য বর্জনের আহ্বানে মুখর ছিল গণমাধ্যম, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। তবে, সামাজিক পরিস্থিতি ও ঘটনার বিবর্তনে এখন বিষয়টা নতুন বিষয়াদি ও আলোচনার জন্য জায়গা করে দিতে বাধ্য হচ্ছে যেন। তবে, ভারতীয় পণ্য বর্জনের এই আহ্বান আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতার আরও প্রকট করেছে। সেটা হলো, আমাদের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনধারায় প্রতিবেশী রাষ্ট্র্র ভারতের প্রভাব এবং গুরুত্ব। এই গুরুত্বের ও প্রভাবের ইতি এবং নেতিবাচক, উভয়ই রয়েছে।

গণমাধ্যমে এই বিষয়ে অনেক বিজ্ঞজনের আলোচনা পড়েছি এবং তাদের প্রত্যেকেই একটি বিষয়ে একমত- বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সুশাসনব্যবস্থার যত নেতিবাচক পরিণতি তার সবই ভারতের প্রণোদনায়। কথাটার কোনো বিরোধিতা করছি না। করার উপায়ও নেই। আর সেই বরাত ধরেই, পরিস্থিতি নিয়ে ক্ষুব্ধদের ভারতীয় পণ্য বর্জনের আহ্বান যুক্তিসঙ্গত, সহজাত একটি প্রতিক্রিয়াই বটে। তবে, এ ধরনের আন্দোলনের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, এ ধরনের বর্জনের আন্দোলন সেগুলোই সফলকাম যেগুলো জনসংহতি অর্জন পরবর্তী সময়ে এ ধরনের বর্জনের আহ্বান করেছে। আমারই শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ও বাংলাদেশের এক স্বনামধন্য আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপকের মতে, কোনো ইস্যু, দল, ব্যক্তি, বা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে প্রথমে জনসংহতি গঠন এবং পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট কোনো উপাদান বা কার্যক্রম বর্জনের আহ্বানই কেবল সময়ে ও বাস্তবতার পরশপাথরে টিকে না। এমন সফল উদাহরণ, আমাদেরই ৭১ সালের ২৬শে মার্চ পরবর্তী আন্দোলন, ব্রিটিশ আমলে ভারতীয়দের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, খুবই সম্প্রতি ইসরায়েলি পণ্য বর্জনের বিশ^ব্যাপী আন্দোলনের কথাও বলা যায়। যদিও ইসরায়েলি পণ্য বর্জনের অভিযানকে এখনও পুরোপুরি সফলকাম বলা যায় না, তবে এর কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ করার এখন আর কোনো উপায় নেই। আরেকটি বড় উদাহরণ হলো মালদ্বীপের নির্বাচন, যেখানে বিরোধী দল ভারত বর্জনের মতো ইস্যু নিয়েই জয়যুক্ত হয়েছেন। আর এই ইস্যু নিয়ে নির্বাচনে আসার আগে তারা দীর্ঘ সময় ও পরিকল্পনা নিয়ে ভারত বিরোধী একটি জনসংহতি গড়ে তোলে আগে। কিন্তু, আপাতদৃষ্টিতে এ দেশের ভারতীয় পণ্য বর্জনের আহ্বান যেন ভারতবিরোধী জনসংহতি অর্জনের সূত্রপাতের প্রয়াস হিসেবেই প্রতীয়মান।

তবে, এর আন্দোলনের এই আপাত দুর্বলতা ও পরিকল্পনাহীনতা ব্যতীত আরও কিছু বিষয় রয়েছে যা বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাস্তবতার সঙ্গে অসামঞ্জস্যহীন। এই আন্দোলনের মূল আহ্বায়ক কে, আন্দোলনের নেতৃত্বে কারা, সেটা এখন আর পরিষ্কার নয়। সঠিক ও সুষ্ঠু নেতৃত্ব ব্যতীত কোনো আন্দোলনই তার লক্ষ্য অর্জনে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে। আরেকটি বিষয় হলো, ভারতীয় পণ্য বর্জনের আহ্বানে কি ভারতীয় সবকিছুই শামিল, নাকি বিষয়টা কতিপয় ভারতীয় দৈনন্দিন পণ্যকেই লক্ষ্য করে ঘোষণা ও সঞ্চালনের প্রচেষ্টা করা হয়েছে, সেটা নিয়ে এই আন্দোলন সমর্থনকারীদের যেমন ধারণা অপরিষ্কার, তেমনি যারা আহ্বান দিয়েছেন

তাদের কোনো সুষ্ঠু পরিকল্পনা নেই, বা ছিল না। সময়ের সঙ্গে সেই পরিকল্পনা বিবর্তন ও গঠন হবে বলেই মনে হচ্ছে। এমন বিবর্তনশীল আন্দোলন সহসা টেকসই হতে পারে না। তাছাড়া, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ব্যাপ্তি, ভূরাজনীতি, ভূকৌশল ও ভূ-অর্থনীতির বিষয়টা তো রয়েছেই, যা আন্দোলনের পথে বড় চ্যালেঞ্জ।

দৈনন্দিন পণ্য, যেমন খাবারজাত দ্রব্য, ঘরোয়া সামগ্রী, এগুলোর বিকল্পও রয়েছে এবং এগুলোর বিকল্প পণ্য ব্যবহারে আমাদের দেশের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সুবিধা ও লাভ হবে বেশি। অবশ্যই দেশের জন্য মঙ্গলজনক সেটা। কিন্তু বাংলাদেশের ছোট ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের একাংশ ভারতীয় পণ্য আমদানি করেই বাণিজ্য করে এবং ভারতীয় পণ্যের বিক্রি দিয়েই তাদের আয়ের সিংহভাগ আসে। তাদের জন্য এই পণ্য বর্জনের বিষয়টা সহনশীল করার কোনো বিকল্প প্রক্রিয়া না থাকলে তাদের জন্য এই আন্দোলনে সমর্থন করার তেমন কোনো উপায় নেই। তাছাড়া, বাংলাদেশের অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান কাঁচামালের জন্য ভারতের ওপর নির্ভরশীল। ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এর অন্যতম। কাঁচামালের নতুন উৎস খুঁজে, সেখান থেকে সাশ্রয়ী মূল্যে কাঁচামাল কিনে এবং সময়মতো ও মানসম্মত সরবরাহের নিশ্চয়তা ব্যতীত, তাদের জন্য অন্য উৎস থেকে কাঁচামাল ক্রয় করা ব্যবসায়িক নির্বুদ্ধিতা ব্যতীত আর কিছু নয়। তাদের এই বিকল্প সিদ্ধান্ত ইচ্ছে থাকলেও হয়তো ব্যবসায়িক তাগিদে সেটা করতে দেবে না। যার জন্য প্রয়োজন ব্যাংকিং, নীতি, কাঠামোগত সংস্কার, পরিবর্তন, কিংবা সহায়তা। যা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রদানের সংকল্প ও প্রতিশ্রুতি ব্যতীত তাদের এই ভারতীয় পণ্য বর্জনের আহ্বানে সাড়া দেয়া কঠিন। ভারত থেকে আমরা প্রায় ১৪ কোটি ডলার মূল্যমানের পণ্য আমদানি করি। এগুলোর মধ্যে কোনগুলো ও কত মূল্যমানের কেবল দৈনন্দিন পণ্য এবং কোনগুলো কাঁচামাল পর্যায়ের অপরিহার্য পণ্য সেটা জেনে নিতে আন্দোলনের আহ্বায়কদের পর্যালোচনা তেমন করা হয়নি বলে মনে হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য, বাংলাদেশে অনেক এমন খাদ্যসামগ্রী ভারত থেকে আমদানি হয়, যা সাশ্রয়ী মূল্যে সরবরাহ করা অতি জরুরি।

আর ভূরাজনৈতিক বিষয়টা তো রয়েই গেল। একদিকে, কেবল ভারত আর ভারত। অন্যদিকে অসহিষ্ণু মিয়ানমার, যার ওপর ভরসা রাখা দায়। ভূরাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি বলে, হাতির সঙ্গে শত্রুতা করে নিজেরই ক্ষতি হবে। যেমনটা সুদূর উত্তর আমেরিকাতে কানাডাকে মেনে চলতে হয়। তবে, এটা অবশ্যই মানতে হবে যে, বাংলাদেশের এক বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভারত নিয়ে ক্ষুব্ধতা ও অসন্তোষ বিরাজ করছে, এই পণ্য বর্জনের আহ্বান সেটার এক অন্যতম, প্রকট ইঙ্গিত মাত্র। অসন্তোষের মাত্রা আর গভীরতা আরও অনেক বেশি এবং সেটা বহিঃপ্রকাশের সঠিক পথ এখনো অগোচরে। আবারও বলছি, এই অসন্তোষ অবাঞ্ছিত নয়, বরং অনেকটাই সঠিক এবং যারা এই অসন্তোষ পোষণ করেন তাদের মতামতের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, এই ক্ষোভ প্রকাশের নেপথ্যে আরও সুসংহত ও সুপরিকল্পিত অভিযানের প্রয়োজন। তা না হলে, হিতে-বিপরীতই হবে। এখানে আবার আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের বলা কথা একটু বলতে হয়।

ভারতীয় পণ্য বর্জনের আন্দোলনটি আরও জোরালো ও প্রজ্বলিত রূপে প্রমাণ করেছে যে, বাংলাদেশের সামষ্টিক রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তাধারায় এবং আপামর বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ না হলেও, নির্ণায়ক একটি ফ্যাক্টর। আর ভারতীয় পণ্য বর্জনের বিরুদ্ধে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ভারতীয় শাড়ি পোড়ানোর উক্তিটি পরিষ্কার করে দিয়েছে এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে তার মতামত কী। অন্যদিকে, বিরোধীদলগুলোর মধ্যেও এখন আন্দোলনটি নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের উদ্রেক হয়েছে। সুতরাং, এই আন্দোলন কেবলই ভারতকে আরও সুস্পষ্ট ধারণা দিয়েছে যে, কে বা কারা এ দেশে ভারতের বন্ধু আর কারা ভারত বিপন্থী। আঞ্চলিক রাজনীতিতে এরকম একচোখা নীতি সমালোচনার দাবিদার হলেও, বাস্তবতা এখন এটাই যে বিশ^রাজনীতিতে এখন আমার সঙ্গে অথবা আমার বিরুদ্ধে মনোভাবটাই প্রবল। আর ভারতের বর্তমান রাজনীতিতে সেটা আরও বেশি প্রকট রূপ নিয়েছে। সুতরাং, এই আন্দোলন যাদের বিরুদ্ধে লক্ষ্য করে সূত্রপাত হয়েছিল, উল্টো এটা তাদের জন্য ভূরাজনৈতিক বিচারে শাপে বর হয়ে উঠেছে বলেই আমার ধারণা। শুধু তাই নয়, চলমান চীন-বনাম-ভারতের ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বাংলাদেশকে অবশ্যই দুই দানবই গুরুত্বপূর্ণ মিত্র বলেই নিজের দিকে আকৃষ্ট করতে চায়। এই আন্দোলন বাংলাদেশে ভারতের গুরুত্ব স্পষ্টত প্রতীয়মান করে নীতিনির্ধারকদের ভারত-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যবর্তী অবস্থানে দর কষাকষির ক্ষেত্রে অনেক সুবিধা করে দিল বলে মনে হয়।

তবে, এটা বলে শেষ করব যে, ভারতীয় পণ্য বর্জনের ফলে দেশের অর্থনীতির জন্য যে সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে, সেটার সঠিক ও সুপরিকল্পিত সমন্বয়, যেমন দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক হবে, তেমনি দেশের অর্থনীতির অন্য রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীলতাও হ্রাস করতে পারে। এমনটা হলে অবশ্যই প্রশংসনীয় এবং স্বাগত জানাই এমন পরিস্থিতির। তবে, সেটা করতে হলে যে কোনো প্রচেষ্টার বাস্তববাদী হওয়া জরুরি।


সাইমন মোহসিন : রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক