আন্তর্জাতিক আসর থেকে স্বর্ণপ্রাপ্তদের অগ্রাধিকার কেন নয়
ক্রীড়া ক্ষেত্রে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’
বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদক ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’। প্রতি বছর এই পুরস্কার জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ উল্লেখযোগ্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে প্রদান করা হয়ে থাকে। পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, পল্লী উন্নয়ন, সমাজসেবা/জনসেবা প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রদান করা হয়। জীবিতদের পাশাপাশি প্রতি বছরই মরণোত্তর পুরস্কার দেওয়ার রীতিও লক্ষণীয়।
এ বছর স্বাধীনতা পুরস্কারে মোট ১০ জনকে ভূষিত করা হয়। এ দশজন হলেন কাজী আব্দুস সাত্তার (স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ), ফ্লাইট সার্জেন্ট মো. ফজলুল হক (স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ), আবু নঈম মো. নজিবউদ্দিন খাঁন (স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ), ড. মোবারক আহমদ খান (বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি), ডা., হরিশংকর দাশ (চিকিৎসা) মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান (সংস্কৃতি), ফিরোজা খাতুন (ক্রীড়া), অরণ্য চিরান (সমাজসেবা/জনসেবা), অধ্যাপক ডা. মোল্লা ওবায়েদুল্লাহ বাকি (সমাজসেবা/জনসেবা) এবং এস এম আব্রাহাম লিংকন (সমাজসেবা/জনসেবা)। ফ্লাইট সার্জেন্ট মো. ফজলুল হক (স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ), আবু নঈম মো. নজিবউদ্দিন খাঁন (স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ)-এ দুজন মরণোত্তর হিসেবে পুরস্কার পেয়েছেন।
এ বছর ক্রীড়ায় স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হয়েছেন বিগত দিনে ১০ বার দ্রুততম মানবী হওয়া সাবেক স্প্রিন্টার ফিরোজা খাতুন। আশি ও নব্বই দশকের মধ্যভাগ জুড়ে ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের ঘরোয়া লড়াই-এ ‘গ্লামার গার্ল’ হিসেবে ফিরোজা খ্যাত ছিলেন। ১০০ মিটার ও ২০০ মিটার স্প্রিন্টারে তিনি সবাইকে পেছনে ফেলে অ্যাথলেটিক্স মিটে আলো ছড়াতেন। সেই ফিরোজাই এবার স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হয়েছেন। ফিরোজার আগে ক্রীড়া ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য ব্যক্তিগত পর্যায়ে মোট ১৩ জন ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব স্বাধীনতা পদক পেয়েছেন। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠান হিসেবে পেয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (২০০১), বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি (২০০৪)।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
ক্রীড়া ক্ষেত্রে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ৭৭ সালে প্রথম স্বাধীনতা পদক পান দূরপাল্লার অ্যাথলেট হিসেবে খ্যাত হাবিলদার মোস্তাক আহমেদ। কিংবদন্তি দৌড়বিদ হিসেবে যিনি জাতীয় পর্যায়ে ৬৯টি স্বর্ণ জয়ের অধিকারী। এরপর ৮১ সালে ক্রীড়ায় স্বাধীনতা পদক পান ক্রীড়া সংগঠক মরহুম আব্বাস মীর্জা। ৮৬ সালে স্বাধীনতা পদক লাভ করেন সে সময়ের প্রখ্যাত সাঁতারু মোশাররফ হোসেন খান। ৮৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সাফ গেমসে যিনি সাঁতারে একাই ৫টি স্বর্ণপদক জয় করে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছিলেন। এরপর ১৯৮৯ সালে স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয় প্রখ্যাত দাবাড়ু নিয়াজ মোর্শেদকে। নিয়াজ মোর্শেদ ৮৭ সালে দাবায় গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব অর্জন করে বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। নিয়াজ মোর্শেদের পর ৯১ সালে ক্রীড়া ক্ষেত্রে অনন্য অবদানের জন্য স্বাধীনতা পদক পান প্রয়াত অ্যাথলেট নায়েব সুবেদার শাহ আলম। আশির দশকে বাংলাদেশের অ্যাথলেটিক্স জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন শাহ আলম। পর পর দুবার (৮৫ ও ৮৭) যিনি দক্ষিণ এশিয়ার ক্রীড়া লড়াইয়ে দ্রুততম মানব হওয়ার অনন্য রেকর্ড গড়েছিলেন। এর পরের বছরগুলোতে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হন ক্রীড়া সংগঠক কাজী আব্দুল আলীম (১৯৯৩), শুটার আতিকুর রহমান (১৯৯৪), সাবেক ফুটবলার জাকারিয়া পিন্টু (১৯৯৫), কিংবদন্তি ফুটবলার কাজী মো. সালাহউদ্দিন (৯৬), আবাহনীর প্রতিষ্ঠাতা শহীদ শেখ কামাল (১৯৯৮), প্রয়াত সাঁতারু ব্রজেন দাস (১৯৯৯), প্রয়াত অ্যাথলেট সুলতানা কামাল খুকী (২০০০), বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (২০০১), বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি (২০০৪), বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক ক্রিকেটার এএসএম রকিবুল হাসান (২০২৩)। সর্বশেষ এ বছর ক্রীড়া ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য স্বাধীনতা পুরস্কার পেলেন সাবেক কৃতী স্প্রিন্টার ফিরোজা বেগম। ক্রীড়ায় দেশের দ্বিতীয় নারী হিসেবে তিনি এই কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। অ্যাথলেটিক্সের ঘরোয়া লড়াইয়ে ফিরোজা অনেক অনেক দিন ধরে আলো ছড়ালেও এ কথা সত্য যে, তিনি কখনই সাফ গেমসসহ কোনো আন্তর্জাতিক মিটে বা লড়াইয়ে স্বর্ণপদক জয় করার কৃতিত্ব দেখাতে পারেননি। তিনি যা কিছু করেছেন অ্যাথলেটিক্সের ঘরোয়া লড়াইÑএ। ফলে বলতে দ্বিধা নেই ফিরোজা আগে আমাদের আরও অনেক কৃতী অ্যাথলেট এবং খেলোয়াড় রয়েছেন যাদেরকে এই পুরস্কারে ভূষিত করা উচিত ছিল। যেসব খেলোয়াড়রা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা থেকে স্বর্ণপদক জয় করে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। কিন্তু তাদেরকে এই গৌরবোজ্জ্বল পুরস্কারের জন্য এখন পর্যন্ত বিবেচনায় আনা হয়নি। ফলে ক্রীড়া ক্ষেত্রে দেশের পক্ষে বড় অবদান রেখে অনেকেই চরম বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হয়েছেন বললে ভুল হবে না।
এক্ষেত্রে সবার আগে বলতে হয় বাংলাদেশের প্রথম মহিলা আন্তর্জাতিক দাবা মাস্টার রাণী হামিদের নাম। তিন তিনবার ব্রিটিশ মহিলা দাবায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার অনন্য রেকর্ডটিও তার। ১৫ বার জাতীয় মহিলা দাবায় চ্যাম্পিয়ন হওয়া দাবাড়ু রাণী হামিদ ২০১৫ সালে কমনওয়েলথ দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে জয়ী হয়ে স্বর্ণপদক পেয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছিলেন। রাণী হামিদকে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত না করাটা সত্যিই দুঃখজনক। একইভাবে দেখা যাচ্ছে সাফ গেমসের দ্রুত মানব হয়ে সোনা অর্জনকারী প্রয়াত বিমল চন্দ্র তরফদার, প্রয়াত মাহবুব আলম উল্লিখিতরা কেউ-ই স্বাধীনতা পদক পাননি। সাবেক স্প্রিন্টার বিমল এবং প্রয়াত স্প্রিন্টার মাহবুব আলম এ দেশে অ্যাথলেট জগতের তারকা খচিত নাম। ৯১ সালে কলম্বোতে অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশীয় গেমসে ১০০ মিটার স্প্রিন্টারে বিমল সোনা জয় করে বাংলাদেশকে অপার আনন্দে ভাসিয়ে দিয়েছিল। আর ৯৫ সালে মাদ্রাজ সাফ গেমসে স্প্রিন্টার মাহবুব আলম ২০০ মিটার স্প্রিন্টারে সোনা জয় করে সবাইকে এক অপার বিস্ময়ের মাঝে ডুবিয়ে দিয়েছিল। একইভাবে সাফ গেমসের ইতিহাসে ১৯৮৪ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম সাফ গেমসে বাংলাদেশের পক্ষে ট্রিপল জাম্পে প্রথম স্বর্ণজয়ী অ্যাথলেট যশোরের সন্তান মুজিবুর রহমান মল্লিক। সেবার 4x100 মিটার দলগত ইভেন্টে সোনা জয়ী দলেরও অন্যতম সদস্য ছিলেন এই স্প্রিন্টার। তিনিও স্বাধীনতা পদকের জন্য কখনও বিবেচিত হননি। আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে প্রথম স্বর্ণজয়ী নারী শুটার কাজী শাহানা পারভীন। ৯১ সালে অনুষ্ঠিত কলম্বো সাফ গেমসে তার নিখুঁত নিশানা থেকেই স্বর্ণ এসেছিল স্ট্যান্ডার্ড রাইফেল ২০ শটসে। কাজী শাহানার আগে কোনো নারীর অ্যাথলেটিক্সের আন্তর্জাতিক কোনো প্রতিযোগিতা থেকে স্বর্ণপদক জয়ের ইতিহাস ছিল না। কিন্তু তিনিও কখনও স্বাধীনতা পদকের জন্য বিবেচনায় আসেননি। একইভাবে সাফ গেমসে সোনা জয়ী শুটার সাবরিনা সুলতানা, কমনওয়েলথ গেমসে স্বর্ণপদক জয়ী শুটার আতিকুর রহমান এবং আসিফ হোসেন খানরাও স্বাধীনতা পদকের ধারে-কাছে আসতে পারেননি।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
ক্রীড়া ক্ষেত্রে যদি বিশেষ অবদানের জন্যই স্বাধীনতা পদক প্রদান করার কথা বলা হয় তাহলে অবশ্যই বিবেচনায় আনতে হবে ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জয়ী ক্রিকেট টুর্নামেন্ট জয়ের অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুলকে। একইভাবে প্রয়াত কিংবদন্তি ফুটবলার মোনেম মুন্নার নেতৃত্বে ১৯৯৫ সালে মিয়ানমারে অনুষ্ঠিত প্রথম চার জাতির টাইগার ট্রফি জিতেছিল বাংলাদেশ। কোনো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে এটিই ছিল বাংলাদেশের প্রথম শিরোপা। কিন্তু সেই মোনেম মুন্নার নামটিও কখনও উচ্চারিত হয় সম্মাননা বা পদক দেওয়ার ক্ষেত্রে। দেশের জন্য যারা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা থেকে স্বর্ণপদক জয় করেছেন, ক্রীড়াক্ষেত্রে স্বাধীনতা পদক পাওয়ার অধিকার বা অগ্রাধিকার তাদের বেশি। বাছাই পদ্ধতিতে যারা আছেন তাদের বলব, আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গন থেকে যারা দেশের জন্য স্বর্ণপদক ও সুনাম বয়ে এনেছেন তাদের এই পুরস্কার দেওয়া হলে পুরস্কারের মর্যাদা আরও বাড়বে।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
জাহিদ রহমান : ক্রীড়ালেখক ও গবেষক