কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা : চিকিৎসাসেবাও বাইরে থাকবে না

ডা. ছায়েদুল হক
০১ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা : চিকিৎসাসেবাও বাইরে থাকবে না

আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা বর্তমান সময়ে ডিজিটাল জগতে সর্বাধিক আলোচিত বিষয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিকট ভবিষ্যতে ডিজিটাল মাধ্যমে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসবে বলে অনুমিত। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হলো এমন একটি কম্পিউটার প্রযুক্তি যা তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে যন্ত্র বা অ্যাপলিকেশনকে মানুষের বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তির আদলে কাজের উপযোগী করে তোলে। মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তাশক্তিকে কৃত্রিম উপায়ে প্রযুক্তিনির্ভর করে যন্ত্রের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করাই এর কাজ। এটি কম্পিউটার বিজ্ঞানের একটি শাখা, যেখানে মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তাশক্তিকে কম্পিউটার দ্বারা অনুকৃত করার চেষ্টা করা হয়। প্রশ্ন জাগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কতটুকু পরিবর্তন নিয়ে আসবে। সেই পরিবর্তন কতটুকু মানবকল্যাণকর হবে অথবা এটি কি মানুষের বুদ্ধিমত্তাকেও ছাড়িয়ে যাবে? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কাছে কি মানুষ অসহায় আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে? স্বাস্থ্য খাতে এর প্রভাবই বা হবে কেমন?

১৯৫৬ সালে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ধারণাটিকে একাডেমিক্যালি গ্রহণ করা হলেও কিছুদিন আগ পর্যন্ত এটি খুব একটা সাড়া জাগাতে সমর্থ হয়নি। বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারের দৃশ্যমান ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম গুগল সার্চ, ইউটিউব, চ্যাটজিপিটি, ইলেক্ট্রিক কার বা সেলফ ড্রাইভিং কার ইত্যাদি। যুদ্ধক্ষেত্রেও তাৎক্ষণিক বা রিয়েল টাইম তথ্য-উপাত্ত পেতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার লক্ষণীয়। স্বাস্থ্যখাতেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার দৃশ্যমান।

স্বাস্থ্যখাতে যে বিষয়গুলোতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বেশ সম্ভাবনাময় মনে করা হচ্ছে তার মধ্যে রেডিওলজি এবং ইমেজিং অন্যতম। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একটি বিশেষ গুণ হলো ইমেজ শনাক্ত করা। ইমেজ শনাক্ত করার মাধ্যমে সে সফলভাবে সিটি, এমআরআই ইত্যাদি ইমেজ শনাক্ত করতে পারে। শ্বাসযন্ত্র বা স্তনের সূক্ষ্মতম কোনো টিউমারকেও শনাক্ত করে বলে দিতে পারবে এটি একটি ক্যানসার। বর্তমানে ক্যানসার শনাক্তকরণে টিউমার থেকে ছোট করে একটু মাংস কেটে সেখান থেকে প্যাথলজিতে পাঠানো হয়। প্যাথলজিতে প্রথমে স্লাইড বানানো হয় এবং সেটি মাইক্রোস্কোপের নিচে হাই রেজুলেশনে দেখে তবে ক্যানসার শনাক্ত করা হয়ে থাকে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ফলে ছোট-খাটো অপারেশন এবং বায়োপসি ছাড়াই সরাসরি হাই রেজুলেশন ইমেজের মাধ্যমে ক্যানসার শনাক্ত করা সম্ভব হবে। এটি হবে ভার্চুয়াল বায়োপসি। ক্যানসার শনাক্তকরণে ভার্চুয়াল বায়োপসি যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে। ফলে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি, আলজেইমার ডিজিজ, শ্বাসনালী ও শ্বাসযন্ত্রের ক্যানসার, স্তন ক্যানসার, ওভারী ও প্রোস্টেট ক্যানসারসহ অনেক ক্যানসার দ্রুত নিরূপণ করা সম্ভব হবে কোনো ঝামেলা ছাড়াই। অনুরূপভাবে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি, আলজেইমারস ডিজিজ ইত্যাদি রোগ শনাক্তকরণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নিয়ে আসবে।

কিছুদিন পরপর নিত্যনতুন ভাইরাস বা অন্যান্য জীবাণু দ্বারা মানব সমাজ আক্রান্ত হচ্ছে। এদের প্রতিরোধের জন্য যেসব ভেকসিন বা প্রতিষেধক প্রয়োজন সেটি আবিষ্কারের জন্য জেনোমিক সিকুয়েন্স জানাটা খুব জরুরি। এ কাজটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা খুব সফলভাবে দ্রুততম সময়ে নিরূপণ করে দিতে পারবে। ফলে ভেকসিনসহ অন্যান্য প্রতিষেধক আবিষ্কার দ্রুত ও সহজতর হবে। নিত্যনতুন ভেকসিন ও ওষুধের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালও সংক্ষিপ্ত হবে। ফলে ভেকসিন ও অন্যান্য প্রতিষেধক সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী হবে।

হৃদরোগীসহ অন্যান্য জটিল মুমূর্ষু রোগী যেখানে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে থাকে এবং সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ের প্রয়োজন হয় সেখানে একই সময়ে একাধিক রোগীর প্রতিমুহূর্তের তথ্য-উপাত্ত আপডেট রাখা এবং প্রয়োজনে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া এক দুরূহ কাজ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এ কাজটিকে সহজ করে একই সময়ে একাধিক রোগীর সার্বক্ষণিক তথ্য-উপাত্ত পর্র্যবেক্ষণ ও করণীয় নির্ধারণ করে দিতে পারবে। এতে একই সঙ্গে একাধিক রোগীর সার্বক্ষণিক মনিটরিং ও তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেওয়া সহজতর হবে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অনন্য একটি দিক হতে পারে রোবটিক সার্জারি। এ মুহূর্তে মনে হতে পারে রোবটিক সার্জারি সার্জনের বিকল্প হতে পারবে না। তবে রোবটিক সার্জারি অনেক ক্ষেত্রে সার্জনের কাজ খুবই সহজ করে দিতে পারবে। কারণ প্রযোজ্য ক্ষেত্রে রোবটিক সার্জারিতে কাটা-ছেঁড়া হবে কম, রক্তপাত কম হবে, অধিকতর নিখুঁত হবে। ফলে রোগী দ্রুত আরোগ্য লাভ করবে এবং রোগীর হাসপাতালে অবস্থান সংক্ষিপ্ত হবে। হাসপাতাল এবং সার্জনের উপর চাপ প্রশমিত হবে। বর্তমানে এক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে বিশ্বে প্রায় ১৭ মিলিয়ন স্বাস্থ্যকর্মীর ঘাটতি রয়েছে। নিকটভবিষ্যতে এ ঘাটতি পূরণ করা প্রায় অসম্ভব। সে ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অনেকটাই উপসম দিতে পারবে।

চিকিৎসা প্রদানে প্রথম কাজটি হলো রোগ নিরূপণ। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে একটি রোগ নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হতে পারে অথবা নাও হতে পারে। প্রমাণিত হলে চিকিৎসা প্রদান সহজ হবে যায়। কিন্তু যদি রোগটি নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত না হয় তবে অভিজ্ঞতার আলোকে বিশেষ কোনো একটি রোগকে অনুমিত ধরে নিয়ে চিকিৎসা দিতে হয়। এক্ষেত্রে চিকিৎসা ফলপ্রসূ হতে পারে, নাও পারে। দুটি কারণে এমনটি হতে পারে। হয়তো রোগ নিরূপণ ভুল অথবা ওষুধে কাজ হচ্ছে না বা ডোজ কমবেশি হয়ে থাকতে পারে। যেভাবেই হোক ওষুধ কাজ না করলে ওষুধ পরিবর্তন করতে হবে অথবা ডায়াগনোসিস পুনর্বিবেচনা করে চিকিৎসায় পরিবর্তন আনতে হবে। এক্ষেত্রে বেশ সময়ক্ষেপণ হয়ে থাকে। চিকিৎসায় সময় ক্ষেপণ মানেই দুর্ভোগ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এক্ষেত্রে দ্রুততম সময়ে বিষয়টি নজরে আনতে সক্ষম হবে এবং দ্রুত চিকিৎসা পরিবর্তন করা সম্ভব হবে। ফলে দুর্ভোগ কমবে এবং সফলতার হারও বাড়বে।

চিকিৎসায় অনেক সময় চিকিৎসক এবং রোগীর ভিন্ন ভিন্ন ভাষা চিকিৎসার অন্তরায় হিসেবে দেখা দেয়। বর্তমান বিশ্বে স্বাস্থ্যসেবাসহ কোনো সেবাই আর নির্দিষ্ট ভূখ- বা ভাষাভাষীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ফলে ভাষার ভিন্নতা একটি প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এক্ষেত্রে ভাষান্তরের মাধ্যমে চিকিৎসক ও রোগীর মাঝে কথোপকথনকে সহজ করে দিতে পারবে। ফলে ভাষার ভিন্নতা সত্ত্বেও চিকিৎসা কাজে কোনো ব্যাঘাত সৃষ্টি হবে না এবং চিকিৎসক রোগীর বোঝাপড়া সহজতর হবে যা ফলপ্রসূ চিকিৎসার পূর্বশর্ত।

অনেক বিষয় আছে যেমন উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরল ইত্যাদি মাত্রা ঠিকঠাকমত চলছে কিনা দেখার জন্য বার বার পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হয়। পরীক্ষার রেজাল্ট দেখে তবে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হয়ে থাকে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এক্ষেত্রে ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে সার্বক্ষণিক তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করতে সক্ষম হবে এবং প্রতি মুহূর্তেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হবে।

নিকট ভবিষ্যতে কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তা স্বাস্থ্যসেবায় যে সকল ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসবে বলে অনুমিত হচ্ছে তার মধ্যে ইমেজ শনাক্তকরণ ও ভার্চুয়াল বায়োপসির সাহায্যে দ্রুত রোগ শনাক্তকরণ ও দ্রুত চিকিৎসা শুরু করার মাধ্যমে চিকিৎসা কাজ সহজতর করা, চিকিৎসাকে অধিকতর ফলপ্রসূ ও সাশ্রয়ী করা, রেকর্ড সংরক্ষণ ও প্রশাসনিক কাজ সহজতর করা, নিত্যনতুন ওষুধ ও ভেকসিন আবিষ্কার দ্রুত ও সহজতর করা, গবেষণা কাজ সহজতর করা, রোবটিক অপারেশনের মাধ্যমে অপারেশন অধিকতর নিখুঁত করা এবং সার্জনদের কাজের চাপ প্রশমিত করা ইত্যাদি অন্যতম।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে একদল মানুষ যখন পরিবর্তনের আশায় উদ্বেলিত তখন তার বিপরীতে অনেকেই কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তা নিয়ে উৎকণ্ঠিত। উৎকণ্ঠার কারণ বা ভিন্নমতের জায়গাটা হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হলো মনুষ্যসৃষ্ট একটি কম্পিউটার প্রযুক্তি যার পক্ষে সম্ভব নয় মানুষের মতো সৃজনশীল হওয়া। সৃজনশীল হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় মুক্ত চিন্তা, আবেগ, অনুভূতি এগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় অনুপস্থিত। আবার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় প্রথমে মেশিনকে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে উপযোগী করা হয় এবং যেসব তথ্য-উপাত্ত দিয়ে কম্পিউটারকে প্রশিক্ষিত করা হবে কম্পিউটার তার উপর ভিত্তি করেই কাজ করবে। এখন যদি মেশিন লার্নিং ত্রুটিপূর্ণ হয় তবে সে ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন জনপদের সেবাগুলো একটি ছোট্ট প্রভাবশালী গোষ্ঠীর ইচ্ছাধীন হয়ে পড়বে। সমাজ ও রাষ্ট্রের মূল্যবোধগুলো এক ধরনের সংকটের মুখে পড়বে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বহুমাত্রিক আশা ও সংশয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় পরিবর্তন অভিসম্ভাবী। সংশয় থাকলেও নতুন প্রযুক্তিকে স্বাগত জানানোই উত্তম। প্রয়োজন নতুন প্রযুক্তির প্রতি সার্বক্ষণিক দৃষ্টি। আগামীর বিশ্ব হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিশ্ব। যারা দ্রুত এর সঙ্গী হবে তারাই এগিয়ে থাকবে। তবে এর ভালো-খারাপ দুই ধরনের প্রভাবই থাকবে। সজাগ এবং সচেষ্ট থাকতে হবে যাতে খারাপ প্রভাব থেকে নিজেকে এবং সমাজকে নিবৃত রাখা যায়।


ডা. ছায়েদুল হক : চক্ষুবিশেষজ্ঞ ও সার্জন

এবং জনস্বাস্থ্যবিষয়ক লেখক