দূষণের নগরীতে বিষবাষ্প ভরা আমাদের ফুসফুস
আমরা বায়ু বা বাতাস ছাড়া বাঁচতে পারি না। বাতাস থেকে প্রতিনিয়ত অক্সিজেন গ্রহণ করি। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ প্রতিদিন গড়ে ৫৫০ লিটার বা ১৯ কিউবিক ফুট বিশুদ্ধ অক্সিজেন গ্রহণ করে। বেশি হাঁটাহাঁটি কিংবা খেলাধুলা করলে অক্সিজেন গ্রহণের পরিমাণ বেড়ে যায়। কিন্তু বর্তমানে ঢাকা শহরে আমরা যে বাতাস থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করি তা বিষে ভরা। যারা রাজধানীতে বসবাস করছে তাদের ফুসফুস ভরা বিষ। কেননা এখানকার বাতাসে ভাসছে বিষ। বিশুদ্ধ বায়ুকে পরিবেশের আত্মা হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। বায়ুতে সাধারণত ২১ ভাগ অক্সিজেন, ৭৮ ভাগ নাইট্রোজেন, ০.০৩১ ভাগ কার্বন ডাই-অক্সাইড, একটি নির্দিষ্ট অনুপাতে ওজোন, হাইড্রোজেন ইত্যাদি থাকে। যদি কোনো কারণে বাতাসে অক্সিজেনের ঘাটতি হয়ে অন্যান্য গ্যাসের ঘনত্ব বেড়ে যায় অথবা বালিকণার ভাগ বেড়ে যায় তবে তাকে দূষিত বায়ু বলা হয়ে থাকে।
বায়ু দূষণ বর্তমান বিশ্বে বৃহত্তম পরিবেশগত স্বাস্থ্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা ‘আইকিউএয়ার’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ ২০১৮ সাল থেকে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে। তবে তা বিপজ্জনক মাত্রায় পৌঁছায় গত বছর। বায়ুদূষণে ২০২৩ সালে দেশ হিসেবে শীর্ষে ছিল বাংলাদেশ। আর নগর হিসেবে বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ নগর ছিল ঢাকা।
বায়ু দূষণের ক্ষেত্রে আমাদের দেশ ও ঢাকা নগরীর অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকেই এগোচ্ছে। গত বছরের নভেম্বর থেকে দেখা যাচ্ছে যে, প্রতি তিন দিনের মাঝে যে কোনো একদিন দিনের কোনো না কোনো সময়ে ঢাকা পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত নগরীতে রূপান্তরিত হয়েছে এবং তার বায়ুর মান সূচক ৩৩০-এর উপরে থাকছে।
অথচ, কোনো স্থানের একিউআই স্কোর যদি ৩০১ থেকে ৪০০-এর মধ্যে থাকে, তবে তা ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে বিবেচিত হওয়ার কথা। এমনকি, এই একিউআই স্কোর যদি পর পর তিন ঘণ্টা ৩০০-র বেশি থাকে, তবে সেখানে স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থাও ঘোষণা করা যেতে পারে।
‘আইকিউএয়ার’-এর হিসাব মতে, স্কোর শূন্য থেকে ৫০-এর মধ্যে থাকলে বায়ুর মান ভালো বলে বিবেচিত হয়। ৫১ থেকে ১০০ হলে মাঝারি বা সহনীয় ধরা হয় বায়ুর মান। সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচিত হয় ১০১ থেকে ১৫০ স্কোর। ১৫১ থেকে ২০০ পর্যন্ত অস্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচিত হয়। স্কোর ২০১ থেকে ৩০০ হলে খুবই অস্বাস্থ্যকর বলে বিবেচনা করা হয়। এছাড়া ৩০১-এর বেশি হলে তা দুর্যোগপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। এ অবস্থায় শিশু, প্রবীণ এবং অসুস্থ রোগীদের বাড়ির ভেতরে এবং অন্যদের বাড়ির বাইরের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে। এদিকে ৩০১ থেকে ৪০০-এর মধ্যে থাকা একিউআই ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে বিবেচিত হয়, যা নগরের বাসিন্দাদের জন্য গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে।
এই বায়ু দূষণের কারণসমূহকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। মানবসৃষ্ট কারণ এবং প্রাকৃতিক কারণ। মানব সৃষ্ট কারণের মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো অন্যতম। ভূ-অভ্যন্তর থেকে উত্তোলিত জ্বালানি যেমন- ডিজেল, পেট্রোল, কেরোসিন তেল ইত্যাদি পোড়ানোর কারণে ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের কণা বাতাসে মিশে বায়ু দূষণ ঘটায়। এছাড়া যানবাহন থেকে নির্গত কালো ধোঁয়ায় থাকে কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেনের অক্সাইডসমূহ প্রভৃতি গ্যাস যা মানুষের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। ইদানীং প্রচুর পরিমাণ সিএনজিচালিত গাড়ি চলাচল করছে। এসব সিএনজিচালিত গাড়ি থেকে বের হয় ক্ষতিকারক বেনজিন। আর এই বেনজিনের কারণে ঢাকায় ক্যানসারের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে বহুলাংশে। এছাড়া সালফার ও সিসাযুক্ত পেট্রল ব্যবহার, জ্বালানি তেলে ভেজাল ও ত্রুটিপূর্ণ ইঞ্জিনের কারণে এসব গাড়ির ধোঁয়ার সঙ্গে কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন-মনোক্সাইড, নাইট্রোজেনের অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড, অ্যালডিহাইডসহ সিসা নিঃসারিত হয়ে বাতাসকে দূষিত করছে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
শিল্প-কারখানার নির্গত ধোঁয়ার বিভিন্ন প্রকার গ্যাস ও ধাতব কণা যেমন- কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড ইত্যাদি দুর্গন্ধময় বিষাক্ত পদার্থ যা বাতাসের সঙ্গে মিশে বাতাসকে দূষিত করে।
পদার্থের দহন বিশেষ করে শহরাঞ্চলে পরিত্যক্ত বর্জ্য পদার্থসমূহ আবর্জনামুক্ত করার জন্য পোড়ানো হয়। এ থেকে নির্গত ধোঁয়াতেও কার্বন-মনোক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড ইত্যাদি গ্যাস থাকে যা বাতাসকে দূষিত করে। অপরিকল্পিতভাবে গাছপালা কর্তনের ফলে বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বেড়ে গিয়ে বাতাসকে দূষিত করছে। এতে প্রাণী ও উদ্ভিদের শ্বাসকার্যে ব্যবহৃত অক্সিজেন ও কার্বন ডাই-অক্সাইডের ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে।
‘বিশুদ্ধ বায়ু পাওয়ার চেষ্টা : দক্ষিণ এশিয়ায় বায়ু দূষণ ও জনস্বাস্থ্য’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত দশ শহরের নয়টিই দক্ষিণ এশিয়ায়, তার মধ্যে ঢাকা একটি। বছর দেড়েক পূর্বে আমেরিকার এক গবেষণা সংস্থার বায়ুদূষণ সংক্রান্ত রিপোর্টে বলা হয়েছিল, বাতাসে ভাসমান অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণা ও নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডের উপস্থিতির নিরিখে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা অন্যতম শীর্ষে রয়েছে। শুষ্ক মরসুমে বাতাসে মিশ্রিত ধূলিকণা এ শহরের নাগরিকদের শ্বাসজনিত অসুখের অন্যতম উৎস।
বায়ু দূষণ জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বড় প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশে যত মানুষ অকালে মারা যায়, তাদের ২০ শতাংশের মৃত্যুর কারণ বায়ু দূষণ বলে ওঠে এসেছে বিশ্ব ব্যাংকের এক গবেষণায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান অনুযায়ী প্রতি ঘনমিটার বাতাসে পাঁচ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত দূষণকারী কণার উপস্থিতি গ্রহণযোগ্য ধরা হয়। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার অনেক ঘনবসতিপূর্ণ ও দরিদ্র এলাকাতেই দূষণের মাত্রা থাকে ২০ গুণ পর্যন্ত বেশি।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতি বছর অন্তত ২০ লাখ মানুষের অকাল মৃত্যু হয়। একই কারণে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। দূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে ২ লাখ ৭২ হাজার মানুষের অকাল মৃত্যু হচ্ছে। আর বায়ু দূষণের ফলেই ৫৫ শতাংশের অকাল মৃত্যু হচ্ছে। এই দূষণ শিশুদের বিকাশে বাধাগ্রস্ত হয়। শ্বাসনালীর বিভিন্ন রোগ এবং দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ তৈরি হয় বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।
যে কোনো সভ্য শহরে স্থানীয় প্রশাসনের মূল ভূমিকাটি হলো, স্থানীয়ভাবে উদ্ভূত সমস্যাগুলোকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে সুসংগঠিতভাবে তার সমাধানের বন্দোবস্ত করা। কিন্তু আমাদের দেশে কাজের ক্ষেত্রে আড়ম্বর ও বাগাড়ম্ব— দুটোই দেখা যায়। আসল কাজের নমুনা যৎসামান্য। পরিবেশবিষয়ক বিভিন্ন সমস্যা, যার সঙ্গে নাগরিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি জড়িত, সে ক্ষেত্রেও যেমন অ-পরিকল্পনা এবং বিশৃঙ্খলার নমুনা অসংখ্য, তেমনই অবিন্যস্ত পথনিরাপত্তার মতো বিষয়টিও। শহরের বায়ুদূষণ ঠেকাতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও কার্যত সেগুলো অকেজো হয়ে রয়েছে।
আর যানবাহনের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে তো কোনো নীতিমালাই নেই। শহরের যে কোনো রাস্তায় কিছুক্ষণ দাঁড়ালেই দেখা যাবে, চারপাশকে কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন করে বিকট শব্দে ছুটে চলছে বিভিন্ন ফিটনেসবিহীন যানবাহন, বিশেষ করে বাস ও ট্রাক। ঢাকা শহরে যে পরিমাণ বাস চলে, তার সত্তর শতাংশেরই আয়ুষ্কাল শেষ। লক্কড়ঝক্কড় বাসগুলো চলছে, এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষ বরাবর উদাসীন।
বায়ু দূষণ নিয়ে আমাদের নেতানেত্রীদের মধ্যে তেমন কোনো উদ্বেগ নেই। কার্যকর কোনো পদক্ষেপও নেই। এমনকি বায়ু দূষণের কারণ-ফলাফল নিয়ে তেমন কোনো গবেষণাও নেই। কোন কোন উৎস থেকে মহানগরে কতটা দূষণ ছড়াচ্ছে, সেটা আগে খুঁজে বের করা প্রয়োজন। উৎস চিহ্নিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। যদিও পরিবেশকর্মীদের অনেকেই বলছেন, এ শহরে দূষণের মূল উৎস গাড়ির ধোঁয়া। ফলে দূষণে রাশ টানতে হলে ধোঁয়ায় রাশ টানা জরুরি। গণপরিবহন ব্যবস্থাকে উন্নত করলে এই সমস্যা অনেকটাই কমানো সম্ভব। কিন্তু গণপরিবহন ব্যবস্থা উন্নত করার বিষয়টি যতটা আলোচিত হয়, কাজের কাজ তার এক শতাংশও হয় না।
বায়ু দূষণের জন্য নাগরিকরা কতটুকু দায়ী, তাদের করণীয় কী, এ বিষয়গুলোও আলোচনায় স্থান পাচ্ছে না। অথচ সবাই ফুসফুসে বিষ নিয়ে ঘুরছে। নানা ধরনের রোগব্যাধিতে জর্জরিত হচ্ছে। হ্যাঁ, ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। এই দূষণের জন্য আমরা সবাই কম-বেশি দায়ী। কিন্তু কার কী কর্তব্য, সেটুকু যদি নির্ধারণ করা না যায়, তাহলে দূষণের মাত্রা তো দিন দিন বাড়তেই থাকবে। দূষণ নিয়ন্ত্রণে তাই জনমনে চেতনা জাগাতে হবে। প্রতি নাগরিকের অংশগ্রহণ ছাড়া বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ এক অলীক স্বপ্ন।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
চিররঞ্জন সরকার : কলাম লেখক