বিষমচক্রে মধ্যবিত্ত এবং একচিলতে বারান্দা
অর্থনীতি বৃক্ষের মাঝামাঝি তিন পুরুষ ধরে ঝুলে থাকা মানুষকে বলা হয় মধ্যবিত্ত। তার মেধা, প্রতিভা, যোগ্যতা ও দক্ষতাকে ম্লান করে তিনি ঝুলে আছেন মধ্যবিত্তের তালিকায়। মাঝে মাঝে কখনও উচ্চ-মধ্যবিত্ত, কখনও বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত। ফেসবুকে কোনো এক ভদ্রলোকের দেওয়া একটি স্ট্যাটাস হুবহু তুলে ধরছি : ১. বাসায় যে ছুটা বুয়া কাজ করে তার মাসিক ইনকাম ১৩,০০০ টাকার মতো; দুই বেলা খাবারসহ। তার স্বামী রিকশা চালিয়ে আয় করেন মাসে প্রায় ১৮ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা। তাদের ১২ বছরের একটা ছেলে টেম্পুতে হেলপারি করে পায় ৬ হাজার টাকা। ওই পরিবারের মাসিক আয় ৩৯ হাজার টাকা। মা ও ছেলের দুই বেলা খাবার ফ্রি। এরা যে বাসায় থাকে তার ভাড়া ৭ হাজার টাকা। সব খরচ মিটিয়ে প্রতি মাসে সমিতিতে জমা করে ৮ হাজার টাকা। জমার পরেও গত কয়েক বছরে গ্রামের বাড়িতে জায়গা কিনেছে ১০ শতাংশ। ২. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বছর দশেক আগে মাস্টার্স করা ছেলে রফিকুল ইসলাম, বিবাহিত, ৬ বছরের ছেলে আছে। একটা বায়িং হাউজে চাকরি করত। করোনার কারণে চাকরি চলে যায়, দীর্ঘদিন বেকার থেকে বহু চেষ্টা-তদবির করে আরেকটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি পায়। বেতন সর্বসাকুল্যে ২৮ হাজার ৫০০ টাকা, ৩ দিন লেট হলে একদিনের বেতন কাটা। এক রুমের বাসা নিয়ে ঢাকায় থাকে, বাসা ভাড়া সমস্ত বিলসহ ১৪ হাজার টাকা। বাকি ১৪ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে খাওয়া, যাতায়াত, কাপড়-চোপড়, চিকিৎসা, বাচ্চার লেখাপড়া সব। ২০ দিন যেতে না যেতেই টাকা শেষ। এরপর ধার-দেনা করে চলতে হয়। দেশে এক কোটি দরিদ্র পরিবারকে টিসিবির কার্ড দেওয়া হচ্ছে কম দামে পণ্য কেনার জন্য। এই কার্ড কে পাওয়ার যোগ্যÑ কাজের বুয়া নাকি রফিকুল ইসলাম? কোন ক্রাইটেরিয়াতে দারিদ্র্য সংজ্ঞায়িত হয় বাংলাদেশেÑ আয় দিয়ে, নাকি সামাজিক অবস্থান দিয়ে? প্রশ্নটি খুবই ন্যায্য। এর জবাব খুঁজে পাওয়া কঠিন। মধ্যবিত্ত কাকে বলে? বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত আধুনিক বাংলা অভিধানে ‘মধ্যবিত্ত’ বলতে ‘ধনী ও দরিদ্রের মাঝামাঝি শ্রেণিভুক্ত’ মানুষকে বুঝানো হয়েছে। এই বিবেচনায় রফিকুল ইসলাম কি মধ্যবিত্ত? ফেসবুকের এই স্ট্যাটাসে কিছু লোক মন্তব্য করেছেন। অধিকাংশ মানুষের মন্তব্য রফিকুল ইসলামের প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শন করে। দু-একজন কঠোর ভাষাও ব্যবহার করেছেন। একজন লিখেছেন, ‘রফিকুল ইসলামের স্বাধীনতা রয়েছে; তিনি তার স্ত্রীকে কাজের বুয়া এবং ছেলেকে টেম্পু ড্রাইভার পদে কাজ করতে পাঠাতে পারেন।’ অন্য একজন লিখেছেন, ‘ভালো বেতনের চাকরি না পেয়ে রফিকুল ইসলামকে বিয়ে করতে কে বলেছে, বাচ্চা নিতেই বা কে বলেছে?’ একটি পরিবারের আশা-আকাক্সক্ষা শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে যখন পরিবারের একটি ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। সাত-আট বছর ধরে কষ্ট করে চার বছরের কোর্স সম্পন্ন করে ছেলেটি ঢুকে চাকরির বাজারে। প্রতিটি আবেদন করতে হয় এক বা দুবেলা খাবারের টাকা ব্যয় করে। ইন্টারভিউ দিতে হয়, এতেও টাকা খরচ হয়। তারপর ব্যর্থতা তাকে এবং পরিবারটিকে চরম হতাশায় নিক্ষেপ করে। ছেলেটিকে পড়াতে গিয়ে এর মধ্যেই বেশ কিছু সম্পদ চলে গেছে। আয়ও কমেছে। আবার যদি কেউ চাকরি পেয়ে যায় তাহলেও সংকট। বেতনে সংসার চলে না। প্রেমিকা মুখ অন্ধকার করে, বিয়ের পর বউ হতাশার অগাধ সাগরে হাবুডুবু খায়। আর পিতামাতা, ভাইবোনের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন বা নড়বড়ে হয়ে যায়। ইন্টারনেট থেকে মধ্যবিত্তের আরও সংজ্ঞা পাওয়া যায়। এগুলো হচ্ছে, ১. যে বা যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয় (মধ্যবিত্তরা কেবল নুন দিয়ে ভাত খেলে চলে না। তাদের ঘরে ইজ্জতদার মেহমান আসে, তাদেরকে মাছ-মাংস খাওয়াতে হয়। ভালো প্লেট-গ্লাস দিতে হয়)। ২. যে লোকটা সপ্তাহের ছয় দিনই মাত্র দুটো শার্ট পরে বাইরে যায়। শার্ট কুঁচকে যাওয়া বা জুতোতে পলিশ না থাকার দিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ করে না। ৩. কর্জ ফেরত দিতে গিয়ে যার হাতে মাসের টাকা থেকে মাত্র এক সপ্তাহের খরচ অবশিষ্ট থাকে। ৪. চলমান পেশার সঙ্গে একটি কম মর্যাদাসম্পন্ন পেশায় যুক্ত হলে আয় কিছুটা বাড়বে জেনেও যিনি চক্ষুলজ্জার ভয়ে তা করতে পারেন না এবং দিনে দিনে আরও নিঃস্ব হয়ে যান এবং ৫. পকেটে টাকা থাকা সত্ত্বেও রিকশায় না চড়ে যিনি হেঁটে ঘরে ফেরেন এবং মনে মনে ডায়বেটিককে ধন্যবাদ জানান তারা সবাই মধ্যবিত্ত। বাসায় রান্নাবান্নার কাজে সাহায্যকারী ভদ্র মহিলা ছুটি নিয়ে গ্রামে গিয়েছেন। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, বনানীর একটি রেস্টুরেন্টে সেহরি খেয়ে আসব। তাহলে আর বাসায় কষ্ট করে রান্না করতে হবে না। শেষ রাতে ফেরার পথে উবারের ড্রাইভার সাহেবকে স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা অন্যরকম ভালো ও ভদ্র মনে হলো। তার সম্পর্কে জানতে চেয়ে জানলাম যে, তিনি একটি প্রাইভেট গ্রুপ অব কোম্পানিজে অফিসার পদে চাকরি করেন। বর্তমান বাজার দরের সঙ্গে বেতন দিয়ে তাল মেলাতে পারছেন না বলে রাতে উবার চালান। আমার অফিসের জুবায়ের শিকদার তার ফেসবুক পেজে নানা রকম মজার মজার জিনিস পোস্ট করেন। আমরা মনোযোগ দিয়ে সেগুলো উপভোগ করি। প্রাইভেট কোম্পানির চাকরিজীবী শিরোনামে তিনি এবার নিম্নরূপ একটি পোস্ট ছেড়েছেন। ‘স্বর্গের দরজায় তিন লোক দাঁড়িয়ে আছে। ঈশ্বরের অলৌকিক বজ্রকণ্ঠ ভেসে এলো- তোমাদের মধ্য থেকে কেবল একজন ভেতরে আসতে পারবে। প্রথম ব্যক্তি : আমি ধর্মপুজারি। সারা বছর আপনার গুণগান করেছি, আপনার কথা মেনে চলেছি, স্বর্গে ঢোকার অধিকার আমার সবচেয়ে বেশি। (ঈশ্বর নিশ্চুপ) দ্বিতীয় ব্যক্তি : আমি সমাজ সেবক। সারাজীবন আপনার সৃষ্টির সেবা করেছি। তাদের দুঃখ দূর করেছি। স্বর্গে ঢোকার অধিকার আমারই বেশি। (ঈশ্বর নিশ্চুপ) তৃতীয় ব্যক্তি : আমি সারাজীবন একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি...... থাম্। (ঈশ্বর ধরা গলায় আর্তনাদ করে উঠলেন) আয়, ভেতরে আয়। আমাকে আর কাঁদাস না। সারাটা জীবন কষ্ট করেছিস...। সারা জীবনের মধ্যবিত্ত তুই।
পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং বিক্রেতাদের মেজাজ নিয়ে ফেসবুকের আর একটি পোস্ট দিচ্ছি। ‘ভদ্রলোকের নাম মোরশেদ আলম (৪৫)। তার বাসায় চাল-তেল শেষ। একটি মুরগিও নিতে হবে। তাই ঢাকার নাজিরাবাজারে গেলেন সওদা করতে। দোকানদার পোলট্রি মুরগির দাম চাইল ২৩০ টাকা কেজি। তিনি বললেন, গত সপ্তাহেও তো ২০০ টাকা ছিল। দাম কমিয়ে রাখুন। দোকানদার বলল, দাম প্রতিদিনই বাড়ে। কমাতে পারব না। আরও দু-একটি দোকান দেখেন, একই দাম। তখন মোরশেদ বললেন, আচ্ছা, এক কেজির একটি মুরগি দাও। তখন দোকানদার বলল, এক কেজির কোনো মুরগি নেই। সব দেড় কেজির ওপর। মোরশেদ বললেন, ভাই, একটু দেখেন। এক কেজি পাওয়া যায় কিনা। দোকানদার তখন বলে উঠল, একটা মুরগি কেনার মুরোদ নাই, প্যান্ট-শার্ট পরে ভাব দেখাইতে আইছে।’
বাজারে নিত্যপণ্যের দাম মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাসে পৌঁছে গেছে। সেই সঙ্গে মধ্যবিত্তের কপালে জুটছে এ ধরনের অপমান-কটু কথা। এই অপমান-অপদস্থ হওয়া চলতে থাকবে মধ্যবিত্তের জীবনে, যুগের পর যুগ ধরে। রেলের কামরায় দেখা হলো একজন সৌম্য চেহারার সিনিয়র সিটিজেনের সঙ্গে। তার চার ছেলে দেশের চার শহরে থাকেন। সরকারি চাকরি করতেন, এখন অবসরে গিয়েছেন। তিনি শতভাগ পেনশন সমর্পণকারী একজন হতভাগা মানুষ। অফিস থেকে টাকা পেয়ে চার ছেলেকে ভাগ করে দিয়েছেন। এখন ছেলেরা তাকে ভাগ করে নিয়েছে। পনেরো দিন পর পর তাকে আবাস বদলাতে হয়, শহর বদল করতে হয়। কোনো ছেলের বাসাতেই যথাযথ সম্মান পাচ্ছেন বলে তিনি মনে করেন না। প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন, অবসর গ্রহণের ১৫ বছর পর থেকে তাদের পেনশন আবার পুনর্বহাল হবে। অবশ্য পরে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, এটা ১৫ বছর থেকে কমিয়ে ১০ বছর করা হবে। এই ঘোষণা বাস্তবায়িত হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণাটি বাস্তবায়িত হলে দুটো ভাতের জন্যে শহরে শহরে ঘোরার লাঞ্ছনা থেকে তিনি বেঁচে যেতেন। তাঁর ধারণা, তিনি সেই ১৫ বছর বাঁচবেন না, সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর অনুগ্রহ গ্রহণ করার সুযোগ পাবেন না।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
মুখ বুজে শত যন্ত্রণা সহ্য করা জনগোষ্ঠী হচ্ছে মধ্যবিত্ত। সারা জীবনই এদের কপালে থাকে যন্ত্রণা। এরা প্রতিবাদ করতে জানেনা, শেকল ভাঙতে জানে না, গর্ত থেকে লাফিয়ে উঠতে জানে না। লোকলজ্জার ভয়ে এরা কাঁদতেও ভুলে যায়। পরিস্থিতির চাপে এরা একান্তই নিরীহ গৃহপালিত হয়ে ওঠে।এই গৃহপালিত মধ্যবিত্তদের জন্যে দেয়ালে দেয়ালে নোটিশ টানানো হয়, চাকরিজীবী মেস মেম্বার চাই, দুই সদস্যের পরিবারের জন্যে সাবলেট। নতুন তৈরি বাড়ি, দক্ষিণমুখী, সার্বক্ষণিক পানি, রাত ১১টার পরও দারোয়ান গেট খুলে দেয়। প্রধান আকর্ষণ : একচিলতে বারান্দা এবং চাঁদ দেখার জন্য খোলা আকাশ। দেয়ালে ঝুলিয়ে দেওয়া এই নোটিশের লেখক অবশ্যই একজন রোমান্টিক মানুষ। দখিনের এক চিলতে বারান্দায় বসে চাঁদ দেখার সুযোগের পাশাপাশি সবার অজান্তে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ার সুযোগও যে পাওয়া যাবে তা তিনি লেখেননি। কখনও কখনও সেই চাঁদকেও হয়তো ঝলসানো রুটি বলেই মনে হবে। মধ্যবিত্তের এই দুঃখ কবে শেষ হবে কেউ কি জানেন!
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
মাহফুজুর রহমান : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক