পেনশন বৈষম্যমূলক: এক দেশে দুই নীতি চলতে পারে না!
গত ১৩ মার্চ ২০২৪ তারিখে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারিকৃত (এস.আর.ও নং-৪৭-আইন/২০২৪) প্রজ্ঞাপনে সব স্ব-শাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা এবং তার অধীনস্থ অঙ্গ প্রতিষ্ঠানসমূহে আগামী ১ জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ তারিখ ও তৎপরবর্তী সময়ে নতুন যোগদানকৃত সব চাকরিজীবীকে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনার আওতাভুক্ত করা হয়েছে। এই প্রজ্ঞাপন জারির ফলে সারা দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দের মাঝে তীব্র অসন্তোষ বা ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এই পেনশন ব্যবস্থাপনার আওতায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ চরম বৈষম্যের শিকার হবেন। যা আমাদেরকে দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের ক্ষেত্রে এই ধরনের প্রজ্ঞাপন কাম্য নয়। স্বাধীনতার পরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করে যে শিক্ষা ও গবেষণার গুরুত্বকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, এই প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দের মাঝে সেই গুরুত্ব এবং শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
যেখানে দেশ বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছে। যা খুবই প্রশংসনীয়। তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন ব্যাহত হতে পারে যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শিক্ষা ও গবেষণায় একনিষ্ঠভাবে মনোনিবেশ করতে না পারেন। এই বৈষম্যমূলক প্রজ্ঞাপনের ফলে মেধাবীরা শিক্ষকতায় নিরুৎসাহিত হবেন। উক্ত বৈষম্যমূলক প্রজ্ঞাপন অবিলম্বে প্রত্যাহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দের মাঝে সৃষ্ট ক্ষোভ ও অসন্তোষ নিরসনের বিনীত অনুরোধ করছি। পাশাপাশি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর দীর্ঘদিনের দাবির প্রতি সমর্থন জ্ঞাপনপূর্বক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দের মর্যাদাকে সমুন্নত করার জোর দাবি জানাচ্ছি। বৈষম্যমূলক পেনশন সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন দেশের টেকসই উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
সর্বজনীন শব্দটির অর্থ হলো সবার জন্য। কিন্তু এই প্রজ্ঞাপন সবার জন্য প্রযোজ্য না হয়ে কিছু মানুষের জন্য করা হয়েছে। যা খুবই দুঃখজনক। আসলে যে বা যেসব সরকারি কর্মকর্তা এই প্রজ্ঞাপনে স্বাক্ষর করেছেন, তার জন্য যদি প্রয়োগ হতো তাহলে আজ এত সমালোচনা হতো না। সাধারণত কোনো নতুন কিছু বাস্তবায়ন করতে হলে, নিজের ঘর থেকে শুরু করা বাঞ্ছনীয়। তবে এই ক্ষেত্রে বিপরীত হয়েছে। সব পেশাজীবীর জন্য যদি এই প্রজ্ঞাপন কার্যকর করা হয়, তাহলে একে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা বলা যায়। অন্যথায় এই বৈষম্য সৃষ্টি করে পেশাজীবীদের মধ্যে দ্বন্দ্বের ব্যবস্থা করে দেওয়া কোনোভাবেই সঠিক হচ্ছে না। কিন্তু দেখা যায় কিছু নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষকে বৈষম্যর মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
প্রকৃতপক্ষে সুবিধা যত বেশি দেওয়া যায়, কিন্তু এখন দেখি সুবিধা তুলে নেওয়া হচ্ছে। এটা দেশের কল্যাণের জন্য শুভকর নয়। যদি বর্তমানে প্রচলিত পেনশন প্রক্রিয়া রাষ্ট্র পরিবর্তন করতে চায় বা দেশের? অর্থনীতির জন্য যৌক্তিক মনে করে তবে সেটা সব সরকারি কর্মচারীর জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য নয় কেন? এটা এখন বড় প্রশ্ন। বিশেষ কোনো কোনো পেশাজীবীর উপর বেশি নির্ভরশীলতাই কি এই ধরনের বৈষম্যের কারণ?
সর্বজনীন পেনশনের নামে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চ শিক্ষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র মনে করা হচ্ছে বলে সমাজে অভিযোগ রয়েছে। উচ্চশিক্ষা ছাড়া একটি দেশের উন্নয়ন যেমন সম্ভব না, তেমনি একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা যত বেশি শক্তিশালী সেই দেশ তত বেশি অর্থনৈতিকভাবে উন্নতির দিকে ধাবিত হতে পারে। বাস্তবে দেশে নানা পেশাজীবীর মধ্যে অনেক ধরনের বৈষম্য রয়েছে। নতুন করে আরও বৈষম্য যোগ করা হলে এটা সার্বিক অর্থে রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর। এমনকি রাষ্ট্রের বিসিএস ক্যাডার সার্ভিসের অন্তর্ভুক্ত অনেক ক্ষেত্রেই বৈষম্য রয়েছে। যেমনÑ প্রশাসন ক্যাডারে যোগদান করলে একজন যে সুযোগ-সুবিধা, ক্ষমতা পেয়ে থাকেন, অন্য ক্যাডারে সেসব সুবিধা নেই। প্রশাসন ক্যাডারের অনেক কর্মকর্তা একটু কর্তৃত্বপূর্ণ মনোভাব নিয়ে চলতে চান বলে অভিযোগ রয়েছে। আবার এই কর্তৃত্বের মধ্যে অনেকেই ভালো কাজ করছেন, এটা ঠিক। তবে কর্তৃত্ব ও বৈষম্যর কারণে প্রশাসন ক্যাডার ব্যতীত অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেক অসন্তোষও রয়েছে, গবেষণা করলে এই সত্য আশা করি প্রকাশ হবে।
ক্যাডার বৈষম্য নিরসনসহ বিভিন্ন দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের শিক্ষকরা। যা আসলেই হওয়া ঠিক নয়। কিন্তু তারা নানা সমস্যায় ও বৈষম্যর শিকার হয়। যেমনÑ ক্যাডার সার্ভিসে শূন্য পদ না থাকলে পদোন্নতি দেওয়া যাবে না এমন কোনো বিধান না থাকলেও শূন্য পদের অজুহাতে পদোন্নতি বঞ্চিত রাখা হয়েছে সরকারি কলেজের শিক্ষকদের। যা খুবই দুঃখজনক। যেখানে শিক্ষকদের সর্বদা বেশি সুযোগ-সুবিধা থাকার কথা, তা পাচ্ছে অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা। কারণ শিক্ষায় উন্নয়নের মাধ্যমে দেশকে টেকসই উন্নয়নের দিকে ধাবিত করা যায়। অন্য কোনো মাধ্যমে দেশের সার্বিক বা টেকসই উন্নয়ন সম্ভব না। বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করে অনেকে পরে প্রশাসন ক্যাডারে চলে যাচ্ছেন। এতে উচ্চশিক্ষায় ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়তে যাচ্ছে। যা দেশের উন্নয়নের জন্য শুভ নয়। উচ্চশিক্ষার যথাযথ উন্নয়ন ছাড়া দেশের টেকসই উন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এই পেনশন প্রজ্ঞাপন যদি বাস্তবায়ন হয় তাহলে মেধাবী শিক্ষার্থীরা শিক্ষকতা পেশায় আসতে আগ্রহী হবে না। এটা হলফ করে বলতে পারি বিশ্বের যে কোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশে শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা অনেক কম ও বৈষম্যমূলক। এমনকি ভারত বা পাকিস্তান থেকে আমাদের শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা অনেক কম। গবেষণা বাড়াতে হলে শিক্ষকদের নানামুখী আর্থিক সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। আমাদের দেশে অনেক শিক্ষক জটিল কোনো রোগের চিকিৎসার জন্য সারা জীবনের পুঁজি দিয়ে তার চিকিৎসা করতে পারে না। কারণ অনেক শিক্ষক যে বেতন পায় তাতে তার সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। সময়ের দাবি সবার জন্য সর্বজনীন চিকিৎসা ব্যবস্থা করা। বরং উল্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুযোগ-সুবিধা কাটার ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে কেউ কেউ। পেনশন ব্যবস্থা যদি চালু করা প্রয়োজন, তাহলে সব সরকারি চাকরিজীবীর জন্য একই নীতিমালা থাকতে হবে। মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আগ্রহী করতে সব ধরনের বৈষম্য কমিয়ে সুযোগ-সুবিধা আরও বৃদ্ধি করা জরুরি।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে একযোগে আন্দোলনে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। আজ যেখানে শিক্ষকদের উচিত ছিল কীভাবে ভালো মানের বা আপডেট তথ্য দিয়ে ক্লাসে যাওয়ার চিন্তা করা। আর সেখানে চিন্তা করতে হচ্ছে কীভাবে বৈষম্যমূলক পেনশন প্রজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি করা। গণমাধ্যমে দেখতে পাই দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সর্বজনীন পেনশন স্কিমের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিচ্ছেন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা অনেক আগেই প্রত্যাখ্যান করেছে। কর্তৃপক্ষ এটি বাতিল না করলে শিক্ষকরা কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করতে বাধ্য হতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সব মিলিয়ে শিক্ষক রয়েছেন প্রায় ১৬ হাজার। কর্মকর্তা মিলিয়ে এ সংখ্যা ৩০ হাজারের বেশি। কর্মচারী ধরলে সব মিলিয়ে এ সংখ্যা চার লাখ হবে। অথচ সরকারি অন্য চাকরিজীবীর সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি। তবে তাদের ক্ষেত্রে আগের নিয়মেই পেনশন ব্যবস্থা চালু রাখা হয়েছে। অর্থাৎ এটা কোনোভাবেই যৌক্তিক সিদ্ধান্ত হলো না। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা এবং কর্মচারীর মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। দ্রুত এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা উচিত। এই প্রজ্ঞাপন কার্যকর হলে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা এবং কর্মচারীরা চরম বৈষম্যের শিকার হবেন। সুতরাং নতুন এই সর্বজনীন পেনশন সিস্টেমকে আমরা গ্রহণ করতে পারি না। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে স্মার্ট শিক্ষাব্যবস্থার পাশাপাশি সবার আগে প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষা এবং শিক্ষক-বান্ধব নীতি। সব ধরনের বৈষম্য কমিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে কর্তৃপক্ষের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছি।
ড. শফিকুল ইসলাম : সহযোগী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!