ফুটবলার রাজিয়ার মৃত্যু ও কিছু কথা

মৌলি আজাদ
৩০ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
ফুটবলার রাজিয়ার মৃত্যু ও কিছু কথা

প্রসবকালীন জটিলতায় মাত্র কিছুদিন আগে অকালে পৃথিবী ছেড়েছে নারী ফুটবলের পরিচিত মুখ রাজিয়া খাতুন। ফুটবল-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মাধ্যমে জানা গেছে, গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরায় সন্তান প্রসব করে রাজিয়া। সন্তান প্রসবের পর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয় তার। সেই রক্তক্ষরণেই প্রাণ হারিয়েছে সে। ২০১৭ সালে থাইল্যান্ডে এএফসি অ-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের মূল পর্বে রাজিয়া খেলেছিল। পরের বছর সাফ অ-১৮ ভুটানের চ্যাম্পিয়ন দলেও ছিল। সিনিয়র দলে ক্যাম্পও করেছে কিছুদিন।

২০০১ সালের ২৫ জানুয়ারি জন্ম নেওয়া রাজিয়া বাংলাদেশের নারী ফুটবলের উত্থানের শুরুর দিকের একজন। এএফসি অ-১৪ রিজিওনাল (সেন্ট্রাল ও দক্ষিণ এশিয়া) চ্যাম্পিয়নশিপে ২০১৩ ও ১৫ সালে চ্যাম্পিয়ন দলেও ছিল সে। পারফরম্যান্স অবনতির জন্য ২০১৯ সালের দিকে ক্যাম্প থেকে বাদ পড়ে সে।

দেখা যাচ্ছে, রাজিয়ার জন্ম ২০০১ সালে অর্থাৎ তার বয়স মাত্র ২৩ বছর। সে গরিব ঘরের মেয়ে। কিন্তু নানান প্রতিকূলতা দূরে সরিয়ে সে ফুটবলের মতো খেলা খেলেছে। ফুটবল খেলতে দেশের বাইরে গিয়েছে। গোলও করেছে।

এত প্রমিজিং মেয়ের বিকশিত হওয়ার জন্য তবে কি ফুটবলে কোনো কাউন্সিলর ছিল না? সে এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করল কেন? বলবেনÑ সে গরিব ঘরের মেয়ে বা এটা তাদের ব্যক্তিগত বিষয়। রাজিয়া যদি ফুটবলার না হতো তবে হয়তো কথা থাকত না। কিন্তু সে তো ঘর থেকে বেরিয়ে যে কোনো মেয়ের জন্য চ্যালেঞ্জিং খেলা ফুটবল পেশাকে বেছে নিয়েছে। সেখানে তাকে কোন বয়সে কোন কাজ করা উচিত সে গাইড কি তার ছিল না?

সে তো হোম মেকার নয়। দশটা-পাঁচটা চাকরিজীবীও নয়। ফুটবলের মতো শ্রমসাধ্য খেলায় নিজেকে জড়িয়েছে। আমাদের দেশে গ্রামীণ ঘরের মেয়েদের গাইড করার জন্য সাধারণত তাদের বাসায় কেউ থাকে না। রাজিয়ার বাসার অবস্থা দেখে বুঝলাম সে অত্যন্ত দরিদ্র ঘরের মেয়ে এবং তার স্বামীও অবস্থাপন্ন নয়। হয়তো রাজিয়ার পারিশ্রমিকে তাদের সংসার চলত। যেই রাজিয়া প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ফুটবলের জন্য নিজেকে নিয়োজিত করেছে সেখানে তার কি নিজের ঘরে কথা বলার স্বাধীনতা ছিল না? সে কি বুঝতে পারেনি এ সময়ে বিয়ে মানে তার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাওয়া?

এ ধরনের খেলা যারা খেলে তাদের শারীরিক ফিটনেস থাকতে হয়। রাজিয়ার খাদ্যাভাস সম্পর্কে আমার ধারণা নেই। তবে অনুমান করতে পারি তা নিশ্চয়ই তার শরীরের জন্য অপ্রতুল ছিল।

পত্রিকা মারফত জানলাম খেলায় তাড়াতাড়ি অংশগ্রহণ করার জন্য সে নরমাল ডেলিভারি করতে চেয়েছে। বাচ্চা নরমাল না সিজার হবে তা কি রোগী বা তার অত্মীয়রা সিদ্ধান্ত নেবে, নাকি ডাক্তার নেবেন? এই আধুনিক যুগে নরমাল ডেলিভারি করতে হলেও তা বাসায় কেন হবে? যেখানে জেলা, উপজেলা, সদরে হাসপাতাল/ক্লিনিক রয়েছে। তার পরিবার বিষয়টা গুরুত্ব দেয়নি বলেই বোঝা যায়।

আমার জানার ইচ্ছে, দেশে নারী ফুটবলারদের তবে কী কোনো ফিটনেস ট্রেনার বা কাউন্সিলর নেই? তার সঙ্গে যারা খেলত তারা কি প্রসব সম্পর্কিত বিষয়ে তার সঙ্গে কোনো আলাপ করেনি? শুধু বাড়ির কয়েকজন মানুষ (আমার ধারণা যারা এখনো প্রসবকে সর্দি-কাশির মতো ছোট বিষয় মনে করেন) তাদের ওপর ভরসা করে এ যুগের একজন নারী ফুটবলার ঘরে প্রসবের সিদ্ধান্ত কীভাবে নিল?

পুরুষ ফুটবলার বা ক্রিকেটার অসুস্থ হলে তা আগেই চাউর হয়ে যায়। তাদের দেশে-বিদেশে চিকিৎসার জন্য ফুটবল ফেডারেশন-বিসিবি পাগল হয়ে যায়। তাহলে নারী ফুটবলারের ক্ষেত্রে তা হলো না কেন? সে নারী বলেই কি তার অসুস্থতাকে ধর্তব্যে নেওয়া গেল না?

সে ঢাকা শহরের বিত্তবান নারী নয় বলে তাকে সম্পূর্ণভাবে অবহেলা করা হলো। যারা তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তারা জানেন রাজিয়ার মৃত্যুতে কাউকে কোথাও জবাবদিহি করতে হবে না। কোচ ও অন্যদের এ রকম সাহসী মেধাবী ফুটবলারকে যেখানে মাতৃত্বকালীন সময়ে আর্থিক ও মানসিক সাপোর্ট দেওয়া উচিত ছিল সেখানে তারা কেন কোনো ভূমিকাই রাখেননি?

তাদের কী একবারও মনে প্রশ্ন জাগেনি গ্রামে তাদের এই ফুটবলার বন্ধু কীভাবে প্রসব করাবে? তারা কী জানে না- নারী প্রসবের সময় কতটা ঝুঁকির মধ্যে থাকে? তারা কি জানতেন না মেয়েটির পরিবার এতটাই আর্থিকভাবে অসচ্ছল যে, তাকে ঠিকঠাকমত গাইডনেস দিতে পারবে না? ফুটবল দলের কারও মাথায় কি বিষয়টি আসেনি? তাহলে বোঝাই যায় আমাদের দেশের নারী ফুটবলাররা কতটা অসহায়। শারীরিক-মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে তাদের নেই কোনো গাইড। তারা দেশের জন্য গোল করে সুনাম আনবে ঠিকই কিন্তু তাদের বিপদের সময় তারা কোনো সাপোর্ট পাবে না। এভাবে কী মেয়েরা দেশে ফুটবল খেলতে আগ্রহী হবে?

আমাদের দেশে যেসব নারী ফুটবলার আছেন তারা কেউ ঢাকা শহরের নন। তারা কেউ সচ্ছল পরিবারের নন। কেউই খুব বেশি শিক্ষিত নন। দরিদ্র পরিবারের এসব মেয়ে সমাজ-সংসারের নানা রকম কটূক্তিকে পাত্তা না দিয়ে ফুটবলের মতো খেলা খেলতে আসে। এদেরকে যদি ফুটবল ফেডারেশন থেকে বা নারী ফুটবলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যারা আছেন তারা যদি ঠিকমত দেখভাল না করেন তাহলে আমি নিশ্চিত আমাদের দেশের গরিব ঘরের মেয়েরা খেলায় আসতে আগ্রহী হবে না। আমরা রাজিয়ার মতো প্রমিজিং মেয়েদের কেবলই হারাব।

রাজিয়ার মৃত্যু নারী ফুটবলারদের প্রকৃত অবস্থা বুঝিয়ে দিল যেন। চারপাশে রাজিয়ার মৃত্যু নিয়ে কোনো কথা নেই। সবাই বিষয়টাকে ধর্তব্যে নিচ্ছেন না। শোক প্রকাশেই তার জন্য যথেষ্ট যেন। এর মৃত্যু যেন প্রাপ্যই ছিল।

এভাবে চলতে পারে না। নারীকে ফুটবলে আগ্রহী করতে হলে তাকে সব সময় সব রকম সাপোর্ট দিতে হবে। সাপোর্টের অভাবে আর কোনো নারী ফুটবলারকে হারাতে চাই না। নারী ফুটবলারদের প্রতি যথাযথ কর্তৃপক্ষের এখনই সর্বোচ্চ দৃষ্টি দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।


মৌলি আজাদ : লেখক ও প্রাবন্ধিক