নিত্যপণ্যের দাম ও ঋণগ্রস্ত পরিবার

আহমেদ সাগর
২৮ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
নিত্যপণ্যের দাম ও ঋণগ্রস্ত পরিবার

বেঁচে থাকার জন্য সব প্রাণীকেই খাবার খেতে হয়। না খেয়ে কোনো প্রাণীই বেঁচে থাকতে পারে না। মানুষও তার ব্যতিক্রম নয়। তাই মানুষের জীবন ধারণের জন্য যে পাঁচটি মৌলিক চাহিদার কথা বলা হয় সেগুলোর সর্বপ্রথমেই খাদ্যের কথা বলা হয়েছে। আদিম যুগে মানুষ জামা-কাপড় পরত না, বসবাসের জন্য বাড়ি তৈরি করত না, লেখাপড়া, স্কুল-কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়, উপার্জন, ক্যারিয়ার কিছুই ছিল না। কিন্তু জন্ম নেওয়ার পর থেকেই মানুষের ক্ষুধা লাগে, খাবার খেতে হয়। তাই খাদ্যদ্রব্য মানুষের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বস্তু। এটা ছাড়া কোনোভাবেই মানুষ চলতে পারে না।

অনেকদিন ধরেই দেশের মানুষের অন্যতম আলোচনার বিষয় নিত্যপণ্যের দাম। জীবন ধারণের জন্য প্রতিদিন যেসব পণ্য আমাদের প্রয়োজন হয় সেগুলোর দাম অনেক আগেই মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। তাই এ বিষয় নিয়ে সর্বত্র আলোচনা-সমালোচনা। সাধারণ মানুষের আয়ের বড় অংশ ব্যয় করতে হচ্ছে খাদ্যের পেছনে। বাকি টাকা দিয়ে অন্যান্য প্রয়োজন মেটানো অনেকের পক্ষেই সম্ভব হচ্ছে না। ফলে মানুষ বাধ্য হয়ে খাবার কেনা কমিয়ে দিয়েছে। পর্যাপ্ত পুষ্টি ছাড়াই বেড়ে উঠছে শিশু, যা তাদের মেধা বিকাশে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুষ্টিহীন, মেধাহীন এক প্রজন্ম বেড়ে উঠছে অসহায় পরিবেশে। চিকিৎসার খচর যোগাতে না পেরে ধুঁকে ধুঁকে মরছেন অনেকে। অনেকে শহরে টিকতে না পেরে গ্রামে ফিরে গেছেন। নানা জরিপে এসব তথ্য উঠে আসছে আমাদের সামনে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএস-এর খাদ্যনিরাপত্তা পরিসংখ্যান-২০২৩-এর চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে বর্তমানে মোট পরিবার বা খানার সংখ্যা ৪ কোটি ১০ লাখ। এসব পরিবারের ২৬ শতাংশ পরিবার মৌলিক চাহিদা পূরণে ঋণ করেছে। যাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছে গ্রামের মানুষ। ঋণগ্রস্ত পরিবারের ২৮ শতাংশই গ্রামের। শহর ও সিটি করপোরেশন এলাকায় এ হার যথাক্রমে ২৪ ও ১৫ শতাংশ।

দিনের পর দিন একইভাবে চললেও পরিস্থিতি বদলানোর কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। বরং নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার নানা যুক্তি দেওয়া হয়েছে সরকারের নানা স্তর থেকে। শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে সরকারের মন্ত্রী আমলারা প্রথমে করোনা মহামারি এবং পরবর্তীতে ইউক্রেন যুদ্ধের দোহাই দিয়ে নিত্য পণ্যের দাম বাড়াকে বৈধতা দিয়েছেন। তখন নানা অনুষ্ঠান সমাবেশে তারা ইউরোপ আমেরিকাসহ উন্নত বিশে^র তুলনায় বাংলাদেশে পণ্যের দাম কম বলে দাবি করতেন। কিন্তু এ দেশের মানুষের অর্থনৈতিক সমার্থ যে ওইসব দেশের মানুষের তুলনায় অনেক কম সেটি তারা ঘুণাক্ষরেও উল্লেখ করতেন না। ফলে সেই সুযোগে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে একের পর এক নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। কখনো চালের দাম হঠাৎ বেড়ে যাচ্ছে তো পরের সপ্তাহেই বাড়ছে ডিমের দাম। এভাবে একে একে বাড়তে বাড়তে চাল, ডাল, তেল, চিনি, পেঁয়াজ, মাছ, মাংস, ডিম সবকিছুর দামই এখন সাধারণের নাগালের বাইরে। কিন্তু যারা এসব কারসাজি করছেন তাদের কখনোই প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়নি। তাদের প্রশ্ন করার সাহসও দেখাননি দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ও কর্মকর্তারা। বরং সংসদে দাঁড়িয়ে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব নয় বলে নিজের অক্ষমতা প্রকাশ করেছিলেন সাবেক বাণিজমন্ত্রী টিপু মুনশি। এরপর সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনলে তিনি বলেছিলেন, “খাদ্যপণ্যের দাম বাড়লে আমরা সঙ্গে সঙ্গে তো ব্যবস্থা নেই। কাজেই সিন্ডিকেট থাকলে সিন্ডিকেট ভাঙা যাবে না ... এটাতো কোনো কথা না। কে কত বড় সিন্ডিকেট আমি জানি না। তবে আমি দেখব কী ব্যবস্থা করা যায়।” প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর আট মাস কেটে গেছে। পুরনো সরকারের বদলে নতুন সরকার গঠন হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি বদলায়নি।

নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ খাদ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকে তাদের অন্যতম লক্ষ্য বলে উল্লেখ করেছিল। নির্বাচনে জয়লাভ করে দায়িত্ব গ্রহণের পর বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু সিন্ডিকেট ভাঙার ঘোষণা দিয়েছেন সেটাও দুই মাস হয়ে গেল। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি সিন্ডিকেট শব্দটির সঙ্গে অভ্যস্ত নই। দেশে কোনো সিন্ডিকেট থাকতে পারবে না। ব্যবসায়ী নয়, ভোক্তার স্বার্থে কাজ করব... পণ্যের দাম যৌক্তিক পর্যায়ে চলে আসবে।’ বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রীর এই ঘোষণার কোনো প্রতিফলন আমরা বাজারে দেখতে পাইনি। বরং চাল, মাছ ও মাংসের পাশাপাশি রোজার প্রয়োজনীয় খেজুর, ডাল, ছোলা, দেশি-বিদেশি ফল সবকিছুর দাম আরও বেড়েছে। সিন্ডিকেট বহাল তবিয়তে নিরাপদে ব্যবসার নামে তাদের লুটপাট চালিয়ে যাচ্ছে।

কখনো কখনো নির্দিষ্ট পণ্যের দাম হঠাৎ দুই/তিন গুণ হয়ে গেলে সে পণ্যটি না খেতেও মানুষকে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। কখনো বলা হচ্ছে তেল ছাড়া রান্না করতে, কখনো পেঁয়াজ বাদ দিতে বলা হচ্ছে রান্নার রেসিপি থেকে। এর আগেও আমরা এমনটা দেখেছি। এক এগারোর পর তৎকালীন সেনাপ্রধানকে দেখেছি ভাতের বদলে মানুষকে আলু খাওয়ার পরামর্শ দিতে। মানুষ কী খাবে, কী খাবে না এটা তার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। প্রত্যেকটা মানুষের নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ আছে। সরকারের কাজ মানুষ কোনটা খাবে কোনটা খাবে না সেটা নির্ধারণ করে দেওয়া নয়। সরকারের কাজ ন্যায্যমূল্যে মানুষের প্রয়োজনীয় পণ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করা।

সম্প্রতি কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ২৯ পণ্যের উৎপাদন খরচ উল্লেখ করে বিক্রয়মূল্য বেঁধে দিয়েছে। তাদের বেঁধে দেওয়া মূল্যে পণ্য বিক্রি করতে অনুরোধ করেছে অধিদপ্তর। অথচ সে অনুরোধ কেউ মানছে না। কারণ তাদের অনুরোধ কেউ না রাখলে কিছুই করার নেই অধিদপ্তরের। মুনাফাখোরদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার তাদের নেই। ফলে আগের মতোই সব পণ্য অতিরিক্ত দামে বিক্রি হচ্ছে।

কৃষি ও কৃষিভিত্তিক পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের হিসাবে আমানত বেড়েছে ৮৯৫ কোটি টাকা। অন্যদিকে কম আয়ের মানুষের হিসাবে আমানত কমেছে দুই হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ একদিকে ব্যবসার নামে লুট করা জনগণের টাকায় ফুলে-ফেঁপে উঠছে ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ীদের ব্যাংক হিসাব। অন্যদিকে সর্বস্বান্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ।

সরকারের সব ব্যর্থতার অংক ‘বিএনপি’ দিয়ে গুণ করার এই প্রবণতা ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে চলছে। বাণিজ্য, খাদ্য, শিল্প, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ এবং কৃষি মন্ত্রণালয় পণ্যমূল্য নিয়ে কাজ করলেও, একটার পর একটা পদক্ষেপ নিলেও তার ফল পাচ্ছে না মানুষ। তাহলে কী করছে এতগুলো মন্ত্রণালয় ও সংস্থা? তারা কী যোগ্য নন? নাকি তারা আসলে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। যা করছেন তা কেবল আইওয়াশ! সিন্ডিকেটের সঙ্গে মন্ত্রণালয় ও সংস্থার অনেকের যোগসাজশের কথা শোনা যায়। তেমন হলে ব্যবস্থা নিতে হবে এসব সুবিধাভোগীদের বিরুদ্ধেও। দাম নির্ধারণের পাশাপাশি সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নয়ন করতে হবে। খুঁজে বের করতে হবে কাঁচা পেঁপের কেজি ৪০-৫০ টাকা হলে পাকা পেঁপের কেজি কেন ১৮০-২২০ টাকা হবে। উৎপাদন থেকে শুরু করে সরবরাহ ব্যবস্থার পথে পথে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নিয়মিত ও কার্যকর বাজার মনিটর ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি মানুষের আয় বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। এছাড়া মৌলিক চাহিদা পূরণে হিমশিম খাওয়া বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক সুরক্ষার আওতা বাড়ানো জরুরি। সর্বোপরি নিজেদের ব্যর্থতা স্বীকার করে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে এককভাবে দাম নির্ধারণ করে কোনো লাভ হবে না। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দাম নির্ধারণ করে তা বাস্তবায়নে বাধ্য করতে হবে। প্রয়োজনে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। না হলে দায় সরকারের উপরই বর্তাবে। মানুষ কিন্তু ভোট সরকারকেই দেয়। দোকান মালিক সমিতি না ব্যবসায়ীদের নয়।


আহমেদ সাগর : সাংবাদিক ও লেখক