মুক্তিযুদ্ধের আলোকে স্বাধীনতার বার্তা
১৯৭১ সালের ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশবাসী এক ধরনের স্বাধীনতা ভোগ করতে শুরু করেছিলেন। তখন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় অফিস থেকেই সরকারি কর্মচারীসহ সবার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা আসত। তাতে যেমন নিজেদের করণীয় সম্পর্কে নির্দেশ থাকত, তেমনি পাকিস্তান সরকারের সব ধরনের নির্দেশনা অমান্য করার কথাও বলা হতো। এই সময়ে ছাত্র-জনতা কিন্তু কখনো রাজপথ ছাড়েননি। সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীর উপস্থিতি, সান্ধ্য আইন বা কারফিউ জারি- এসব নিবর্তনমূলক কোনো ব্যবস্থাকেই সেদিন মানুষ গ্রাহ্য করেননি। এমনকি গুলি, হত্যা, অত্যাচার, গ্রেপ্তারকেও তারা পরোয়া করেননি। তখন থেকেই বাঙালি স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়ে গেছেন।
স্বাধীনতার প্রথম প্রহর অর্থাৎ একাত্তরের ২৬ মার্চের সকাল হয়েছিল প্রতিপক্ষের দ্বারা আক্রান্ত অবস্থায়। তবে বাড়িতে, গাড়িতে বা পথেঘাটে তো সেই অসহযোগের সময় থেকেই জাতীয় পতাকা উড্ডীন ছিল। তখনকার পতাকার মাঝখানে ছিল দেশের মানচিত্রÑ স্বাধীন বাংলার আকাক্সক্ষার প্রতীক। ফলে দিনটা ছিল স্বাধীনতার উল্লাস ও আক্রমণের আশঙ্কায় টানটান উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তায় ভরা। তখনই ভাবতে হয়েছে স্বাধীনতা রক্ষার দায় আমাদের নিতে হবে। এটাও বোঝা যাচ্ছিল, প্রাথমিক অবস্থায় পাকিস্তানের সুসংবদ্ধ এক সামরিক বাহিনীর সর্বাত্মক নির্মম আক্রমণের মুখে আমাদের পক্ষে টিকে থাকা কঠিন। তার জন্য প্রয়োজন হবে যথাযথ পরিকল্পনা, উপযুক্ত নেতৃত্ব, অস্ত্র-অর্থসহ সব রকম সহযোগিতা। তবে আশার কথা হলো, বিভিন্ন সেনানিবাস থেকে অসংখ্য বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা ও সৈন্য বেরিয়ে এসে স্বাধীনতার লড়াইয়ে শামিল হয়েছিলেন সেদিন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এ রকম পক্ষত্যাগী দক্ষ বাঙালি সৈনিকদের সঙ্গে জনগণের সম্মিলিত বাহিনীর প্রতিরোধ যুদ্ধের খবরও পাওয়া যাচ্ছিল। এভাবেই শুরু হলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। সবার অংশগ্রহণে যেহেতু যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে, তাই একে বলা যায় জনযুদ্ধ।
২৫ মার্চের মধ্যরাতেই তো বঙ্গবন্ধু পাকবাহিনীর হাতে বন্দি হয়ে যান। তার মতো জনপ্রিয় নেতার পক্ষে গোপনে পালানো ছিল প্রায় অসম্ভব, আবার পলায়নকালে ধরা পড়ার ঘটনা হতো আইনের চোখে অপরাধ। তার চেয়ে সাহসিকতার সঙ্গে প্রতিপক্ষের হাতে বন্দি হওয়া এবং অন্যায়, বিচারে অন্যায় শাস্তি ভোগ করার মধ্যে যে বীরোচিত ভাবমূর্তি তৈরি হয়, তা হয়ে উঠেছিল মুক্তিসংগ্রামের অন্যরকম এক হাতিয়ার। তার অনুপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর ডান হাত তাজউদ্দীন আহমদ সেদিন একটি জাতির স্বাধীনতা রক্ষায় মহান সংগ্রামের যোগ্য নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ, পাকিস্তানের পক্ষত্যাগী প্রশাসক ও সরকারি কর্মীবৃন্দ, শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সংগঠিত করে তিনি সেদিন প্রবাসী সরকার এবং তা পরিচালনার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠের ঘোষণা ছিল রণাঙ্গন থেকে শরণার্থী শিবির, গেরিলা ক্যাম্প থেকে অবরুদ্ধ জনগণের জন্য এক চিরায়ত সংগ্রামের অনুপ্রেরণা। বলা যায়, আমাদের প্রথম স্বাধীনতা দিবস ছিল মুক্তিসংগ্রামের অফিসিয়াল সূচনা-দিবস। তবে অবরুদ্ধ দেশে তা উদ্যাপনের সুযোগ ছিল না। একাত্তরের ২৬ মার্চ থেকে দেশবাসী সবাই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সৈনিক। রাজাকার, আলবদর, শান্তি কমিটির অল্পকিছু দেশদ্রোহী দালাল ছাড়া সবাই মুক্তিযুদ্ধে শরিক হয়েছিলেন। বহু মানুষের বীরোচিত সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ, দেশান্তর ও শরণার্থী জীবন, চরম দুর্ভোগ ও সর্বস্ব হারানোর মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছিল বিজয়। এভাবে নয় মাস পরে ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের মধ্য দিয়ে দখলদারমুক্ত হলো দেশ- রাহুমুক্ত হলো আমাদের স্বাধীনতা।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
ফলে আমাদের স্বাধীনতার একদিকে রয়েছে মুক্তিসংগ্রামের বীরত্ব ও ত্যাগের মহিমা আর অন্যদিকে রয়েছে দীর্ঘ লড়াই শেষে স্বাধীন হওয়ার আনন্দ। আজ যেমন আনন্দের দিন, তেমনি অনেক কিছু স্মরণ ও মূল্যায়নেরও দিন। স্মরণ করতে হবে বঙ্গবন্ধুকে, প্রবাসী সরকারের মধ্যমণি তাজউদ্দীন আহমদ ও তার সহযোগীদের, অগণিত মুক্তিযোদ্ধা, লাখো শহীদ এবং দুই লাখ ত্যাগী নারীদের কথা। একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের আলোকে স্বাধীনতার মূল বার্তাটি উপলব্ধি ও ধারণ করতে হবে।
আবার এর পরবর্তী দীর্ঘ সময়ে দেশে ও বিশ্বে এখন নানা পরিবর্তনের ধারা চলমান। উন্নয়নের গৌরব ধারণ করেও এর মধ্য দিয়ে আমাদের মূল্যায়ন করতে হবে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কতটা অর্জিত হয়েছে, কতটাই বা রয়েছে বকেয়া। গণতন্ত্র, তার উপযোগী অসাম্প্রদায়িক মানবিক সমাজ নির্মাণ, সব ধরনের বৈষম্য দূর করে সবার অর্থনৈতিক মুক্তি ও সাম্য প্রতিষ্ঠা, সবার মানবিক মর্যাদা ও জীবনের নিরাপত্তা এবং মতপ্রকাশের অধিকার রক্ষায় কতটা সফল হয়েছি আমরা, তারও মূল্যায়ন চাই।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
মুক্তিযুদ্ধ কেবল চেতনা নয়, এক অঙ্গীকার; স্বাধীনতা কেবল মুক্তির আনন্দ নয়, ব্যক্তি ও সামষ্টির প্রতি প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের দায়বদ্ধতা। আমরা কি সেসব অঙ্গীকার ও দায়িত্বের কথা স্মরণ রাখছি, সেভাবে দেশ ও সমাজকে পরিচালিত করছি? প্রশ্ন সবার কাছে, সবার আগে নিজের কাছে।
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও আমাদের সময়ের সম্পাদক
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!