বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন বাংলার চেতনায় উজ্জীবিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী
`অগ্নিঝরা ২৬শে মার্চ, তোমার আগমনে কেঁপেছিলাম সেদিন
তবে আজ বুঝেছি, তুমি এসেছিলে করতে স্বাধীন'
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ- এক রক্তাভ ভোরের সূর্য দেখেছিল এদেশের মানুষ। যা ছিল এক নতুন আশার সূর্য, স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয়ের সূর্য। অগ্নিঝরা এই মার্চে স্বাধীন বাংলার মহান স্থপতি বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এই যুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী ত্রিশ লাখ বাঙালি তথা সর্বস্তরের জনতার অদম্য উদ্দীপনায় শুরু হয়েছিল বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম।
২৬শে মার্চ বাঙালি জাতির মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। বাঙালি জাতির জন্য ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন হচ্ছে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে দীর্ঘ নয় মাসের আন্দোলন আর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সশস্ত্র জনযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে বাংলার জনতার মুক্তির ইতিহাস। ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মদান ও দুই লক্ষ মা-বোনের ত্যাগ, তিতিক্ষা এবং কোটি বাঙালির আত্মদানের ফসল হিসেবে অর্জিত হয়েছে এই স্বাধীন ভুখণ্ড। বাঙালি জাতিকে মুক্তির এই মহামন্ত্রে উজ্জীবিত করে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পথে এগিয়ে নিয়ে যান ইতিহাসের মহানায়ক বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বে ১৯৪৮ সালে বাংলা ভাষার দাবিতে গড়ে তোলা আন্দোলন, ৫২’র রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ৫৪-তে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে জয়লাভ, ৫৬’র সংবিধান প্রণয়ন আন্দোলন, ৫৮’র মার্শাল'ল বিরোধী আন্দোলন, ৬৬’র বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। ষড়যন্ত্রমূলক আগরতলা মামলা করা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। ৭০’র সাধারণ নির্বাচনে তার নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ জয়লাভ করেছে। এগুলো সবই ছিল স্বাধীনতার পথে বাঙালির এগিয়ে যাওয়ার পদক্ষেপ। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী সেই ভাষণ ও পাকিস্তানি হায়েনার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের চূড়ান্ত লক্ষ্যে ধাবমান হয় বাঙালি জাতি।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ও ভারত বিভক্তির আগে থেকেই পূর্ব বাংলা অর্থনৈতিকভাবে অবহেলিত ছিল। পাকিস্তান শাসনামলে এই অনগ্রসরতা ক্রমান্বয়ে আরও বৃদ্ধি পায়। কেন্দ্রীয় সরকার সর্বদাই তৈরি করে রাখে এক রাষ্ট্রীয় বৈষম্য। এছাড়াও ১৯৪৮ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে পাকিস্তানের মোট রপ্তানি আয়ের ৭০ ভাগ এসেছিল পূর্ব পাকিস্তানের রপ্তানিজাত দ্রব্য থেকে। এরপরও আয়কৃত অর্থের মাত্র ২৫ ভাগ বরাদ্দ পেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান। এই সময়ের মধ্যে হ্রাস পেতে থাকে পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প-প্রতিষ্ঠান আর ক্রমান্বয়ে স্থানান্তরিত হতে থাকে পশ্চিম পাকিস্তানে। এছাড়াও প্রায় ২৬ কোটি ডলার মূল্যমানের সম্পদ পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাচার হয়ে যায় পশ্চিম পাকিস্তানে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতেও পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা ছিলেন সংখ্যালঘু। ১৯৬৫ সালে সশস্ত্র বাহিনীর বিভিন্ন শাখায় বাঙালি বংশোদ্ভূত অফিসার ছিলেন মাত্র ৫ শতাংশ। এর মধ্যেও যৎসামান্য অংশ ছিলেন নেতৃত্বে, বাকিরা ছিলেন কারিগরি ও প্রশাসনিক পদে। পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালিদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বলে মনে করত। তদুপরি বিশাল প্রতিরক্ষা ব্যয় সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তান ক্রয়, চুক্তি ও সামরিক সহায়তামূলক চাকরির মতো কোনো সুবিধা পেত না।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও তৎকালীন সামরিক সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা করতে থাকে। শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠক সফল না হওয়ায় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইটের নামে বাঙালিদের ওপর নির্বিচারে ঝাঁপিয়ে পড়ে। গ্রেপ্তার করা হয় বঙ্গবন্ধুকে।
২৫শে মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী প্রথমেই রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং পিলখানায় অতর্কিত আক্রমণ চালায়। নির্বিচারে গণহত্যা চালায় দেশের বিভিন্ন স্থানে। ২৬শে মার্চ ভোরেই বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার বলিষ্ঠ কণ্ঠে বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলার হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান; জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বস্তরের আপামর জনগণ একত্রিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনায় দীর্ঘ ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদ ও দুই লক্ষ মা-বোনের আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত হয় বাংলার স্বাধীনতা। বিশ্ব মানচিত্রে অভুদ্যয় হয় স্বাধীন, সার্বভৌম ও সবুজের সমারোহে ঘেরা বাংলাদেশ নামক এই রাষ্ট্রের।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের এই সংগ্রাম করতে গিয়ে জীবনের উল্লেখযোগ্য সময় জেলে কাটিয়েছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই আন্দোলনের কারণে দুই বার ফাঁসির মঞ্চে যেতে হয়েছে তাকে। অসংখ্য মিথ্যা মামলায় অগণিতবার কারাবরণ করার পরও স্বাধীনতার প্রশ্নে আপোস করেননি বঙ্গবন্ধু। তিনি বাংলার মানুষকে উপহার দিয়েছেন একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম ভুখণ্ড, একটি লাল সবুজের পতাকা, একটি মানচিত্র, একটা শ্রুতিমধুর জাতীয় সংগীত, সুস্পষ্ট এক সংবিধান ও বিশ্বের বুকে গর্বিত এক পরিচয়, নাম তার বাঙালি ও বাংলাদেশি।
একই বৃন্তে ও সমচেতনায় উজ্জীবিত তিনটি ফুল হচ্ছে বাংলা, বাঙালি ও বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে বাংলার গরিব-দুঃখী ও মেহনতি মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই ছিল বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য। তিনি জেল, জুলুম ও হুলিয়াসহ শত যন্ত্রণা, দুঃখ-কষ্ট আর বেদনাকে সহ্য করে এই বাংলার আপামর কৃষক-শ্রমিক জনতার মুখে হাসি ফোটাতে নিরবিচ্ছিন্ন সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। বিশ্বের সকল মুক্তিকামী জনতার মাঝে চির অম্লান হয়ে থাকবেন এই মহান নেতা। একই সঙ্গে বাংলার সকল শ্রেণির জনতার হৃদয়ে চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অর্জিত চির প্রত্যাশিত স্বাধীনতার মূলমন্ত্র আজও আমাদেরকে প্রেরণা জোগায় নির্ভীক যোদ্ধা হওয়ার ও দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করার এক অমর উপাখ্যান হিসেবে। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে এসেছে প্রকৃত মুক্তি। এই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের এক ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত, সুখী ও সমৃদ্ধশালী সোনার বাংলা।
২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করে দেশবাসীর উদ্দেশে একটি বার্তা পাঠান। ইপিআরের বেতার বার্তায় প্রচার করা হয় বঙ্গবন্ধুর সেই স্বাধীনতার ঘোষণা। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিল পত্র তৃতীয় খণ্ডে শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, ‘২৫শে মার্চ মধ্য রাতের পর, অর্থাৎ ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, যা তৎকালীন ইপিআর এর বেতার ট্রান্সমিশন এর মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র হতে ২৬শে ও ২৭শে মার্চ বেশ কয়েকজন সদস্য শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।’
২৫শে মার্চ রাতে গণহত্যা শুরুর পরপরই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিরোধ গড়ে তোলে মুক্তিকামী বাঙালিরা। রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও পিলখানায় গড়ে তোলা সশস্ত্র প্রতিরোধ শত্রুর ভারী অস্ত্রের মুখে বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি। চট্টগ্রাম, নওগাঁ, জয়দেবপুর ও বরিশালসহ বিভিন্ন জেলায় প্রতিরোধ গড়ে তোলে বাংলার মুক্তিকামী অকুতোভয় জনতা। এদিকে ২৫শে মার্চ রাতে শুরু করা গণহত্যা ২৬শে মার্চেও চালিয়ে যায় পাকিস্তানি বর্বর সেনারা। ঢাকায় কারফিউ ঘোষণা করে সকল ভবন, বস্তি, বাজারে ভারী মেশিনগান ও কামানের গোলা নিক্ষেপ অব্যাহত রাখে। শহরের ঘনবসতিপূর্ণ অনেক এলাকায় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ও গুলি করে অগনিত বাঙালিদের হত্যা করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৎকালীন ইকবাল হল (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল), সলিমুল্লাহ হল, জগন্নাথ হল, জিন্নাহ হল (বর্তমানে মাস্টারদা সূর্যসেন হল), হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হল, ফজলুল হক হল, রোকেয়া হলসহ শিক্ষকদের আবাসিক এলাকায় আক্রমণ চালায় পাকিস্তানি সেনারা। হত্যা করে ড. মনিরুজ্জামান, ড. জি সি দেব, অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্য, জ্যোর্তিময় গুহ ঠাকুরতাসহ (আহত হয়ে পরে মারা যান) নয় জন শিক্ষককে। একাত্তরের ২৫শে মার্চের রাতে ঢাকায় গণহত্যার খবর ছড়িয়ে পড়লে দেশের বিভিন্ন জেলা ও মহকুমা শহরের পুলিশ, ইপিআর, ছাত্র-শিক্ষক-জনতা শত্রুর মোকাবেলায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। যদিও তারা ছিল নিরস্ত্র। ২৫শে মার্চের রাতে সেই আক্রমণ চলাকালেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গ্রেপ্তার করে শেখ মুজিবুর রহমানকে।
একাত্তরের ২৯শে মার্চ ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল গোলাগুলি হয়। বৃহত্তর ময়মনসিংহ, রাজশাহী এবং সিলেটে মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় উদ্বেগে পড়ে হানাদার বাহিনী। ১৯৭১ সালের এই দিনেই আনুমানিক রাত দেড়টার দিকে আইন সভার সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে কুমিল্লার বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় পাক সেনারা। তিনি ও তার ছেলে দিলীপ কুমার দত্তর খোঁজ আর কখনো মেলেনি বাঙালির ইতিহাসে।
মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর নেতৃত্বে চুয়াডাঙ্গায় গঠিত ইপিআর, আনসার ও ছাত্র-জনতার এক যৌথ বাহিনী কুষ্টিয়ায় অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের ওপর হামলা চালায়। পাকিস্তানি বাহিনী মর্টার ও মেশিনগান নিয়ে পাল্টা আক্রমণ চালালে মুক্তিবাহিনী তিনটি উপদলে ভাগ হয়ে আক্রমণ চালায়। এরই মধ্যে পাকিস্তানি বিমান বাহিনী বাহ্মণবাড়িয়া জেলায় বিমান হামলা চালায়। এই হামলায় একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাত বরণ করেন। একই দিন সন্ধ্যায় মুক্তিবাহিনীর ফাঁদে পাক বাহিনীর একটি দল নিহত হয়। এদিকে মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ভৈরব ও নরসিংদীর মধ্যবর্তী রেললাইন বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
পাকিস্তানি বাহিনীর ৪০ জনের একটি দল পাবনা হতে গোপালপুর যাওয়ার পথে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে নিহত হয়। এদিকে মেজর কে এম শফিউল্লাহ ২য় ইস্ট বেঙ্গল-এর অফিসার ও সৈনিকদেরকে ময়মনসিংহ টাউন হলে একত্রিত করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের শপথ গ্রহণ করান। অন্যদিকে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও তৎসংলগ্ন পাহাড়ি এলাকাসমূহে অবস্থান নেয়। ২৯শে মার্চ সন্ধ্যায় তারা চট্টগ্রামবাসীর ওপর অতর্কিত হামলা শুরু করে।
১৯৭১ সালের ৩০শে মার্চ সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে চট্টগ্রামে অবস্থিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হতে বাংলাদেশকে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি ও সাহায্য দানের জন্য বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক সরকার ও জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানানো হয়। এদিন রাতে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে সদ্য প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে হামলা চালায় পাকিস্তানি বিমান বাহিনী। এই আক্রমণের ফলে ট্রান্সমিশন অ্যান্টিনাসহ বেতার ভবনের মারাত্মক ক্ষয়-ক্ষতি হয়, তবে কেউ হতাহত হননি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এদিন চট্টগ্রাম শহরকে বিভিন্ন দিক থেকে ঘিরে ফেলে এবং বোমা বর্ষণ করতে থাকে।
এছাড়াও, নোয়াখালীতে উভয় বাহিনীর মধ্যে তুমুল যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর হাতে ৪০ জন পাকিস্তানি সেনা বন্দি হয়। এই আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা প্রচুর গোলাবারুদ ও অস্ত্র দখল করে। উদ্ধারকৃত যুদ্ধ সরঞ্জামাদি পরবর্তীতে শুভপুর যুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। ৩০শে মার্চ বিকেল ৫টার দিকে মতিন পাটোয়ারীর নেতৃত্বে বাংলার অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা কুষ্টিয়া পুলিশ লাইনস দখল করতে সক্ষম হয়। এদিকে, ফ্রান্সে অবস্থানরত পাকিস্তানি যুদ্ধ জাহাজ হতে নৌবাহিনীর আটজন বাঙালি নৌ সেনা ও কর্মকর্তাগণ পক্ষত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন।
মুক্তিবাহিনী গঠনের পর নিয়মিত সেনাবাহিনীর ৫টি ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেয়। পরবর্তীতে নিয়মিত সেনাবাহিনীর সদস্যদেরকে নিয়ে গঠন করা হয় আরও তিনটি ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড (জেড, কে ও এস ফোর্স)। ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসের শেষের দিকে আরও তিনটি নতুন ব্যাটালিয়ন গঠন করা হয়। এছাড়াও দুইটি আর্টিলারি ব্যাটারি (মুজিব ব্যাটারি ও ২ ফিল্ড ব্যাটারি) গঠন করা হয়। পরবর্তীতে এই ব্যাটারি দুটিকে নবগঠিত ব্রিগেড তিনটির সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে আরও সু-সংগঠিত ও সু-সজ্জিত করার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনেক যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা এই সেনাবাহিনীর প্রতি বঙ্গবন্ধু ছিলেন যেমন স্নেহশীল তেমন দায়িত্ববান। অত্যাচারের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পাওয়া সদ্য স্বাধীন নবজাতকতুল্য একটি দেশের সম্পদ বলতে তখন ছিল শুধু মানুষের ঐক্য ও কর্মস্পৃহা। এরকম অবস্থায় বঙ্গবন্ধু হাত দেন সমগ্র দেশ পুনর্গঠনের কাজে। একইসঙ্গে সেনাবাহিনীর পুনর্গঠন প্রক্রিয়াও শুরু হয়। সেনাবাহিনীকে একটি আধুনিক, শক্তিশালী ও আন্তর্জাতিক মানের বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন বঙ্গবন্ধু ও তার সরকার। ইনফ্যান্ট্রি, আর্টিলারি, সিগন্যাল, আর্মার্ড, ইঞ্জিনিয়ার ও মেডিকেলকে পূর্ণাঙ্গ রেজিমেন্ট অথবা ব্যাটালিয়ন হিসেবে গড়ে তুলেছেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর আন্তরিকতা ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার ফলশ্রুতিতেই স্বাধীন বাংলাদেশে গড়ে উঠেছিল সম্ভাবনাময় সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী।
যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে, পাকিস্তান থেকে প্রত্যাবর্তনকারী প্রায় ত্রিশ হাজারের অধিক সামরিক কর্মকর্তা ও অন্যান্য পদবীর সৈনিকদেরকে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত উদার ও যুক্তিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেখিয়েছেন। প্রত্যাবর্তনকারী হাজার হাজার সৈনিক ছিল এই বাংলাদেশেরই সন্তান। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে তখন মাত্র ৩০-৪০ জন কর্মকর্তা ছিলেন। এদিকে, প্রত্যাবর্তনকারী কর্মকর্তার সংখ্যা ছিল তেরো’শত। বঙ্গবন্ধু সেদিন সকল অফিসার ও জওয়ানদের সমন্বয়ে অর্ধ লক্ষেরও অধিক সদস্যের একটি চৌকশ সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। দেশ স্বাধীনের মাত্র সাড়ে তিন বছর সময়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে অত্যন্ত সু-সজ্জিত করে তুলেছিলেন।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলেন বাংলাদেশের আধুনিক সশস্ত্র বাহিনীর রুপকার। একটি আধুনিক, যুগোপযোগী ও শক্তিশালী সেনাবাহিনী প্রতিটি দেশের জন্য অপরিহার্য। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার জাতির পিতার গঠিত প্রতিরক্ষা নীতির আলোকে ‘ফোর্সেস গোল' বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাংগঠনিক ও প্রশাসনিক কাঠামো বিন্যাস ও পরিবর্তন আর পরিবর্ধনের পাশাপাশি আধুনিকায়নের প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই ধাবমান অগ্রযাত্রার অংশ হিসেবে সমগ্র উন্নতি সাধনে নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন বর্তমান বাংলাদেশ সরকার। এরই মধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে আরও নতুন নতুন ব্রিগেড সংযোজন করা হয়েছে। সকল ইউনিটসমূহের যুদ্ধক্ষেত্রে সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য আধুনিক ট্যাঙ্ক, ফিল্ড গান, অত্যাধুনিক এয়ার ডিফেন্স গান, ক্ষেপণাস্ত্র, কম্বাট সিমুলেটর, বিভিন্ন ধরনের রাডার ও অত্যাধুনিক লোকেটিং সরঞ্জামাদি সংযোজন করা হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন দেশ হতে সর্বাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন গান, রাডার এবং যানবাহন সংযোজনের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। দুর্বার এ দেশের আকাশ প্রতিরক্ষাকে আরও সুসংহত করতে সংযোজিত হয়েছে এমএলআরএস এবং মিসাইল রেজিমেন্ট। আধুনিক ও উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বর্তমান সরকার সেনাবাহিনীতে অত্যাধুনিক বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্র, আর্টিলারি গান এবং মডার্ন ইনফ্যান্ট্রি গেজেট ইত্যাদি সংযোজন করে সেনাবাহিনীর আভিযানিক সক্ষমতাকে বহুলাংশে বাড়িয়ে দিয়েছেন।
তাই আজ স্বাধীনতার এই দিনে বুক ফুলিয়ে আমরা বলতে পারি, বঙ্গবন্ধু তার সেনাবাহিনীকে যে চৌকস একটি বাহিনী হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন আজকের বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ঠিক সেভাবেই প্রশিক্ষিত ও আধুনিক সরঞ্জামাদি সম্বলিত চৌকস এক বাহিনী হিসেবে স্বীয় অবস্থান গড়তে সক্ষম হয়েছে। শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এই বাহিনী দেশের সম্মানকে সমুন্নত রাখতে সক্ষম হয়েছে। এ সকল কিছুই বাস্তবায়িত হয়েছে বর্তমান সরকারের সুনিবিড় পরিকল্পনার ফলশ্রুতিতে। আজ সত্যিই 'বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন বাংলার চেতনায় উজ্জীবিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।’