নারী ফুটবলারদের প্রতি কোনো অনাদর, অবহেলা নয়

জাহিদ রহমান
১৬ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
নারী ফুটবলারদের প্রতি কোনো অনাদর, অবহেলা নয়

৮ মার্চ ছিল আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এদিন সারা দেশে নানাভাবে নারী দিবস পালিত হয়। নারী দিবসের উচ্ছ্বাস কাটতে না কাটতেই দেশবাসীর জন্য বড় এক সুসংবাদ আসে একদিন পরেই অর্থাৎ ১০ মার্চ। মেয়েদের সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ টুর্নামেন্টে নেপালের মাটিতে ভারতকে টাইব্রেকারে পরাজিত করে চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জন করে বাংলাদেশের কিশোরীরা। এই উপমহাদেশে যে কোনো টুর্নামেন্টেই ভারতকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা আসলে চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের মেয়েরা সেই চিরন্তন সত্যকে একেবারে ভেঙে দিয়েছে। ভারতকে পরাজিত করে যে চ্যাম্পিয়ন হওয়া যায়, সে প্রমাণ বাংলাদেশের মেয়ে ফুটবলাররা একের পর এক দেখিয়ে যাচ্ছে।

মেয়েদের ফুটবল র‌্যাংকিং-এ ভারত আমাদের থেকে অনেক অনেক এগিয়ে। অভিজ্ঞতাও তাদের প্রচুর। কিন্তু বাংলাদেশের মেয়েরা গত দেড় যুগে যেন অসাধ্যকে সাধন করেছে। এক কথায় বলা যায়, এত অল্প সময়ে কোনো খেলাতেই আমাদের এরকম উত্থান ঘটেনি। গত কয়েক বছর ধরেই আমরা লক্ষ্য করছি ছেলেদের ফুটবলে আমাদের তেমন কোনো সাফল্য নেই, বিপরীতে মেয়েরা ফুটবলে অনেক অনেক এগিয়ে। আর তাই সুসংবাদ আসাটাও এখন রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশের মেয়েদের ফুটবলে অভিযাত্রা কিন্তু খুব বেশি দিনের নয়। সব মিলিয়ে দেড় যুগের একটু বেশি সময় হবে। অনেকেরই মনে থাকার কথা এই শতকের শুরুতে প্রথম প্রথম কিছু মেয়ে অ্যাথলেট রাজধানীর ধানমন্ডিস্থ মহিলা ক্রীড়া সংস্থার মাঠে অনুশীলন করতেন। তখন এই নারী অ্যাথলেটদের উৎসাহ ও উদ্দীপনার প্রেক্ষিতেই মেয়েদের ফুটবলে এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা উঁকি দিতে থাকে। সে সময় সাঁতার, হ্যান্ডবলসহ অ্যাথলেটিক্সের কিছু ইভেন্টের আগ্রহী মেয়েরা ফুটবলকে ঐচ্ছিকভাবে নিয়ে অনুশীলন করতেন। বলা যায়, তখন সবই ছিল অনানুষ্ঠানিক। আর এভাবেই এক সময় পশ্চিমবঙ্গের মেয়েদের সঙ্গে প্রীতিম্যাচ খেলার সুযোগ ঘটে বাংলাদেশের মেয়েদের। এভাবেই বাংলাদেশের মেয়েদের ফুটবল প্রতিযোগিতায় আনুষ্ঠানিক পদার্পণ ঘটে। এই ধারাবাহিকতায় এক সময় ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে গিয়ে খেলারও সুযোগ ঘটে বাংলাদেশের মেয়েদের। কিন্তু গত ১০ বছরে মেয়েদের ফুটবলে বাংলাদেশের উত্থান অনেকটাই চমকে দেওয়ার মতো। আর তাইতো ছেলেদের ফুটবলে যখন কেবলই বার বার দুঃসংবাদ আসে, তখন বিজয়ের বারতা নিয়ে আসছে মেয়েরা। আমরা দেখতে পাই ভারতের মতো ফুটবল শক্তিকে হারিয়ে বিজয়ের বেশে দেশে ফিরছে বাংলাদেশের মেয়েরা। এ কথা সত্য যে, বরাবরই ছেলেদের ফুটবলে ভারত মানেই আমাদের জন্য এক মহাআতঙ্ক। বিগত দিনে আমরা দেখেছি পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের ছেলেরা ভালো করলেও যে কোনো প্রেক্ষিতে ভারতের কাছে আমাদের ফুটবলারদের নতি স্বীকার করাটা যেন অনিবার্য। সেই বৃত্ত থেকে আমরা বের হতে পারিনি। কিন্তু মেয়েদের বেলায় একেবারেই ভিন্ন চিত্র। সাফ ঘরানার যে দলই হোক না কেন বাংলাদেশের কাছে তাদের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হতে হয়। আমরা দেখছি গত কয়েক বছর ধরেই সাফ ফুটবলের বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের মেয়েদের জয়জয়কার অবস্থা। হিসাব মতে মেয়েদের সাফ ফুটবলে এ পর্যন্ত ৭টি শিরোপা জিতেছে বাংলাদেশ। এই প্রাপ্তি অহংকার করার মতো। মনে করিয়ে দিতে চাই ২০২১ সালে ঢাকার মাঠে ভারতকে ১-০ গোলে পরাজিত করে সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জনও ছিল তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। আর ২০২২ সালে নেপালে অনুষ্ঠিত মেয়েদের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ বাংলাদেশের অর্জনটা ছিল রীতিমতো বিস্ময়কর ঘটনা। ১৬ সেপ্টেম্বর নেপালের দশরথ রঙ্গশালা স্টেডিয়াম আলোকিত করেছিলেন বাংলাদেশের সাবিনারা। এসবের মাঝে আমরা বছরের শুরুতেই শুনতে পেলাম ভারতের নারী ফুটবল লীগে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের পক্ষে খেলবেন আমাদের জাতীয় নারী ফুটবল দলের উইঙ্গার সানজিদা। তখন ফুটবলমোদীদের স্মৃতিতে ফের উঠে এসেছিল প্রয়াত কিংবদন্তি ফুটবলার মুন্নার কথা। এ দেশের কেউ বোধ হয় এর আগে স্বপ্নেও ভাবেননি যে, এ দেশের কোনো মেয়ে ফুটবলার ভারতের ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে খেলে মুন্নার স্মৃতিকে মনে করিয়ে দেবেন।

মেয়েদের ফুটবল শত বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে যেভাবে হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে যাচ্ছে সেখানে বাফুফের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। একই সঙ্গে বিভিন্ন জেলার গ্রামের মেয়েরা সমাজের সমস্ত ট্যাবু ও চোখ রাঙানি ভেঙে যেভাবে ফুটবলের জন্য নিজেদেরকে উৎসর্গ করেছে তা অনন্য উদাহরণ। তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় আমাদের ছেলে ফুটবলাররা যে সুযোগ-সুবিধা পান বা যে টাকার বিনিময়ে ক্লাবে খেলে থাকেন সেই তুলনায় আমাদের মেয়ে ফুটবলাররা নিতান্তই পেটে-ভাতে খেলেন। অনেক ক্ষেত্রে তারা চরম বৈষম্যেরও স্বীকার। সবচেয়ে বড় কথা এসব বাস্তবতা মেনে নিয়েও আমাদের মেয়েরা নিজেদেরকে ফুটবলের জন্য উজাড় করে দিয়ে যাচ্ছেন। এ কথা সর্বাংশে সত্য যে, দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার অনেক কিছুই আমাদের মেয়েদের ফুটবলে এগিয়ে যাওয়ার পথে বড় অন্তরায়। মেয়েরা ফুটবল খেলবে এ বিষয়টি গ্রামের অনেকেই মেনে নিতে পারেন না। গ্রামের মোড়ল মাতব্বরদের অনেকেই আবার এটিকে ধর্মীয় মোড়কে নানান ধরনের বয়ান দিয়ে থাকেন। অনূর্ধ্ব-১৬ টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ দলে খেলা ঠাকুরগাঁও জেলার রাণীশংকৈল উপজেলার রাঙ্গাটুঙ্গি গ্রামের সাগরিকা নামের যে মেয়েটি এখন গ্রামবাসীর কাছে গর্ব হিসেবে খ্যাত সেই মেয়েটিকে কিন্তু নানান সামাজিক চড়াই-উৎরাই পাড়ি দিয়ে এখনকার অবস্থানে আসতে হয়েছে। কিছুদিন আগেও গ্রামবাসীর কাছে অনেক কটূক্তিও তাকে শুনতে হয়েছে। কিন্তু সাগরিকা এখন গ্রামবাসীর কাছে এক চকচকে মুক্তা। শুধু সাগরিকা নয়, অন্যদের গল্পও এ রকমই। সবাই-ই গরিব ঘরের লড়াকু মেয়ে। কারও বাবা কৃষক, কারও বাবা অটোচালক, কারও বাবা দিনমজুর। অথচ এরাই এই উপমহাদেশে দেশের জন্য আলো ছড়িয়ে চলেছেন।

আমরা দেখছি শত-সহস্র বাধা পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের মেয়ে ফুটবলাররা। মেয়েদের ফুটবলে শত সম্ভাবনার স্বপ্ন বিস্তৃত করেছে বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়া চঞ্চল, উচ্ছল কিশোরীরা। তারাই জাতীয় দলে জায়গা করে নিচ্ছে। সাফ পেরিয়ে আমাদের চোখ এখন তাই মহিলা এশিয়া কাপসহ অন্যান্য অন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের দিকে। আমাদের এই মেয়েদের প্রতি উপেক্ষা-অবিচার আর নয়। এই মেয়েদের জন্য যদি সুযোগ-সুবিধা আরও অবারিত করা হয়, তাদের জন্য যদি উচ্চমানের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়Ñ তাহলো মেয়েদের ফুটবলে যে ধারাবাহিকতা তৈরি হয়েছে তা আরও দূরে এগিয়ে যাবে। আমাদের সারা দেশেই কিন্তু প্রতিভা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সেই প্রতিভাগুলোকে তুলে আনা এবং তাদের সঠিকভাবে এগিয়ে নেওয়াটাই এখন বড় কাজ। একই সঙ্গে মেয়েদের ফুটবলে শহুরে মেয়েদের আগ্রহী করার পদক্ষেপও গ্রহণ করা এখন প্রয়োজন। আমরা দেখছি আমাদের নারী ফুটবলের প্রাণ মূলত গ্রামের মেয়েরাই। সেই অর্থে শহুরে মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের অংশগ্রহণ নেই। এ বিষয়েও বাফুফের কর্মকর্তাদের পরিকল্পনা করে এগুতে হবে।

সুরক্ষা, নিরাপত্তা আর জীবনমানের নিশ্চয়তা দেওয়া হলে আরও মেয়েরা যে ফুটবলে আসতে আগ্রহ দেখাবে এটি নিশ্চিত। আমরা আশা করব নারী ফুটবলারদের প্রতি আর কোনো অনাদর, অবহেলা ও কার্পণ্য নয়। তাদেরকে সামাজিক মর্যাদার উচ্চশিখরে নিতে হবে। মনে রাখতে হবে আমাদের প্রতিটি নারী ফুটবলারই এক বৈরী, নিষ্ঠুর, নির্মম সমাজ মোকাবিলা করে নতুন নতুন ইতিহাস তৈরি করছেন। ফুটবলে বাংলাদেশের মেয়েদের যে অর্জন তা আমাদের ক্রীড়াঙ্গনকে নিত্য আলোকিত করছে। তাদের পেশার স্বীকৃতি ও নিশ্চয়তাই এ দেশের মেয়েদের ফুটবলকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে।


জাহিদ রহমান : ক্রীড়া লেখক ও গবেষক