বড় ব্যবসায়ী জালিয়াতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
১৩ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
বড় ব্যবসায়ী জালিয়াতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে

ঠিক এই সময়ে অর্থাৎ রোজার সময়ে পাকিস্তান আর বাংলাদেশের পত্রিকাগুলো দেখলে বেশ মিল চোখে পড়ে। রমজান মাস এলেই এই দুই দেশে নিত্যপণ্যের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে যায়, সাধারণ নাগরিকদের বাইরে চলে যায়। বাংলাদেশে যেমন পত্রিকাগুলো রিপোর্ট করছে যে, রোজাকে সামনে রেখে ইফতারের বাজারে আগুন জ্বলছে, তেমনি পাকিস্তানের কয়েকটি ইংরেজি পত্রিকা ঘেঁটে এমনই শিরোনাম পেলাম।

প্রতিবছর রমজান এলেই বাজার বেসামাল হয়ে পড়ে, জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। এমনকি কিছু পণ্যের দাম ক্রেতাদের নাগালের বাইরে চলে যায়। অসাধু ব্যবসায়ীরা যেন ওৎপেতে থাকেন এ মাসের জন্য। প্রতিবারের মতো এবারও সরকারি প্রশাসন তৎপরতা দেখিয়েছে, বলতে গেলে বেশ খানিকটা আগে থেকেই এই সক্রিয়তা শুরু করেছিল, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। সরকারের পদক্ষেপ-প্রতিশ্রুতি সেই অর্থে কোনো কাজে লাগেনি, রোজার বাজার নিয়ন্ত্রণে আসেনি।

এ বছর ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে থেকেই সরকার সচেতন ছিল। এবং নতুন করে সরকার গঠন করে এই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকে এক নম্বর এজেন্ডা হিসেবে স্থির করে কয়েক সপ্তাহ ধরে রোজার বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করে, ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের অভিযান চলে, টিসিবির মাধ্যমে ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রি করে। কিন্তু এর পরও বাজার নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি।

চাঁদ দেখা সাপেক্ষে মঙ্গলবার থেকে বাংলাদেশে শুরু হয়েছে পবিত্র মাহে রমজান। এর আগেই বাজারে সব পণ্যের দাম বেড়েছে। ইফতারে বাঙালি মুসলমানের কাছে অতি আবশ্যিক পণ্য হলো চিনি, লেবু, শসা এবং বেগুন। এগুলোর দাম বেড়েছে যথারীতি। বিক্রেতারা বলছেন, গত দুদিনের ব্যবধানে প্রতি হালি লেবু ২০-৩০ টাকা, বেগুন ও শসা কেজিপ্রতি ২০ টাকা বেড়েছে।

পবিত্র রমজানে নিত্যপণ্যের দাম বাড়বে না, এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী। তার এই আশ্বাস কেন বাস্তবায়িত হলো না সেটার আর ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না। উপরে উল্লেখিত পণ্য ছাড়াও ছোলা, ব্রয়লার মুরগি, আলুসহ বিভিন্ন সবজির দাম বেড়েছে। খেজুরের দামও বেশ চড়া। রোজায় প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দাম যাতে ঊর্ধ্বমুখী না হয়, সেজন্য ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমদিকে চার পণ্যে শুল্ক কমায় সরকার। প্রশ্ন হলো এর সুফল কারা পেল? রাষ্ট্র শুল্ক হারাল, জনগণ কিছুই পেল না, মাঝখান থেকে পুরো সুবিধাটা ঘরে গেল ব্যবসায়ীদের। সরকারের কাছে এর ব্যাখ্যাটা তা হলে কী?

কথাগুলো এবারও বলা হচ্ছে, আগেও বলা হয়েছে। উৎসবে পৃথিবীর সব দেশে নিত্যপণ্যের দাম কমে । পবিত্র রমজান উপলক্ষে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় রমজানের সব পণ্যের দাম কমিয়েছে। এমনকি পশ্চিমা বিশ্বের অমুসলিম দেশগুলোতেও রমজানে পণ্যের দাম কমানোর নজির আছে। বড়দিন উপলক্ষে ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোয় পণ্য বাজারে বিশাল মূল্য হ্রাস করে। ভারতেও আমরা পূজার সময় দাম কমতে দেখি। কিন্তু বাংলাদেশ আর পাকিস্তানে এই পরিস্থিতি পুরোপুরি উল্টো। রমজান মাস এলেই আমাদের দেশের খুচরা থেকে মাঝারি ও বড় বড় ব্যবসায়ী সাধারণ ভোক্তাদের পকেট কাটার উৎসবে মেতে ওঠে। এ দাম বৃদ্ধির সংস্কৃতি থেকে কোনোভাবেই আমরা মুক্ত হতে পারছি না।

চট্টগ্রামে এস আলম চিনি কারখানায় আগুন লেগে এক লাখ টনের মতো চিনি পুড়ে যাওয়ায় পাইকারিতে চিনির দাম কেজিতে দুই টাকা ও খুচরা বাজারে পাঁচ টাকার মতো বেড়েছে। তবে বাজারে চিনি সরবরাহে বড় ধরনের কোনো সংকট দৃশ্যমান নয়। অর্থাৎ সরবরাহ থাকলেও দাম কমছে না। এ পরিস্থিতি অন্যান্য পণ্যের বেলায়ও। একটা হতে পারে যে, আমদানিতে ডলারের খরচ বেশি পড়ায় কয়েক মাস ধরে বাজারে ডালজাতীয় পণ্যের দাম বেড়েছে। কিন্তু সরকারের শুল্ক সুবিধা পাওয়ার পরও কেন বাড়তি দাম তার উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে।

একটা বিষয় পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, সরকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পেরে উঠছে না। আমদানিকারক থেকে শুরু করে খুচরা পর্যায়, কোনো পর্যায়ের ব্যবসায়ীরাই নিয়ন্ত্রণে নেই। এটাই সরকারের দুর্বলতা বা সরকারের বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা। এ কারণেই যে কোনো পর্যায়ের ব্যবসায়ী কারসাজি করে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দিতে পারছে। এত এত অভিযান বা হাঁকডাকের পরও এ অবস্থার অর্থ হলো বাজার তদারকিতে সরকারি সংস্থাগুলো একেবারেই সফল হতে পারছে না। গরুর মাংস ৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রির ঘোষণা দিচ্ছেন। কিন্তু সুপার শপসহ বড় বাজারগুলোতে ৭৫০ টাকা দরেই প্রকাশ্যে বিক্রি চলছে। রোজা শুরুর আগের সপ্তাহে কীভাবে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে ২০ টাকা বেড়েছে।

রমজান মাস এলে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। এটা একেবারেই স্বাভাবিক বাংলাদেশে। এবার কথা বেশি হচ্ছে, কারণ সরকার বেশ চড়া গলায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। মানুষ এই প্রতিশ্রুতিতে আশ্বস্ত হয়েছিল এজন্য যে, প্রায় তিন বছর ধরে টানা উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলছে। এতে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় বড় সংকট তৈরি হয়েছে। মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত মানুষ খরচ কমিয়ে, কম খেয়ে চলছে। এর মধ্যে সরকার রমজানের আগে আগে মার্চ মাসের শুরুতেই বিদ্যুতের দাম এক দফা বাড়িয়েছে যার প্রভাব পড়েছে জীবনের প্রতিটি স্তরে। বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ করলেও ডিজেলের দাম লিটারে মাত্র ৭৫ পয়সা আর অকটেনের দাম নামমাত্র চার টাকা কমায় তার প্রভাব জনজীবনে ছিটেফোঁটাও লাগেনি। এ অবস্থায় রোজা উপলক্ষে ব্যবসায়ীরা নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে চরম সংকটে ফেলেছে।

সরকার সরবরাহের কথা বেশি করে বলে। এটি অবশ্যই জরুরি। কিন্তু একই সঙ্গে সরকারের তদারকি বাড়াতে হবে বাজারে। ব্যবসায়ীদের মধ্যে যারা বড় জালিয়াত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।


সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা : প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন