টেকসই উন্নয়নের জন্য নারীর ক্ষমতায়ন জরুরি

হীরেন পণ্ডিত
১০ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
টেকসই উন্নয়নের জন্য নারীর ক্ষমতায়ন জরুরি

৮ মার্চ ছিল আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ছিল ‘নারীর সমঅধিকার, সমসুযোগ এগিয়ে নিতে হবে বিনিয়োগ’। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন অঞ্চলে নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা, তাদের কাজের প্রশংসা এবং ভালোবাসা প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে নারীদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সাফল্য অর্জনের উৎসব হিসেবেই পালন করা হয়। আন্তর্জাতিক নারী দিবসটি বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশে বিশেষভাবে পালন করা হয়। তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশও। প্রথম ১৯০৯ সালে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হয়। ওই বছর ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রথম আমেরিকায় নারী দিবস উদযাপন করা হয়েছিল। সোশ্যালিস্ট পার্টি অফ আমেরিকা নিউইয়র্কে ১৯০৮ সালে বস্ত্র শ্রমিকরা তাদের কাজের সম্মান আদায়ের লক্ষ্যে ধর্মঘট শুরু করেন। নির্দিষ্ট সময় অনুযায়ী কাজ আর সমমানের বেতনের দাবিতে চলে হরতাল।

নারী আন্দোলনের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় নারী সমাজের যথেষ্ট অগ্রগতি সাধিত হলেও লিঙ্গ সমতার বিষয়টি এখনও পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এ চিত্র শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর সর্বত্র দৃশ্যমান। অথচ দেশ কিংবা সমাজের উন্নয়ন নির্ভর করে জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক অবদান ও অংশগ্রহণের ওপর। অর্থাৎ সমাজের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারীদের অংশগ্রহণ ছাড়া কাক্সিক্ষত উন্নয়ন সম্ভব নয়। বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে সত্য; কিন্তু তা কাক্সিক্ষত মাত্রার অনেক নিচে অবস্থান করছে। শুধু তাই নয়, নারী নির্যাতন ও বঞ্চনাও উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা সম্ভব হয়নি। দেশের নারী সমাজ এখনও নানা ধরনের পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নির্যাতন-বঞ্চনার শিকার। শিল্পক্ষেত্রে নারী শ্রমিকের বঞ্চনা একটি আলোচিত বিষয়। যৌতুক প্রথা, বাল্যবিবাহ, ধর্মীয় কুসংস্কার, পারিবারিক জীবনে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের আধিপত্য, প্রথা, পুরনো ধ্যান-ধারণা আমলের মনোকাঠামো ইত্যাদি নারী অগ্রগতির পথে বড় বাধা। এসব অতিক্রম করার নিরন্তর প্রচেষ্টা চলছে দেশে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নেওয়া হচ্ছে নানা উদ্যোগ। কিন্তু আবহমানকালের প্রথাগত সামাজিক চিত্রটি একেবারে মুছে ফেলা সম্ভব হয়ে উঠছে না।

বিশ্বজুড়ে নারীদের অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজন, প্রশমন এবং সবার জন্য আরও টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ে তোলাই ছিল সবার লক্ষ্য। জলবায়ুু সংকট এবং দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসের পরিপ্রেক্ষিতে লিঙ্গ সমতার অগ্রগতি একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম বড় বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ। জলবায়ু পরিবর্তন এবং স্থায়িত্বের সমস্যাগুলো আমাদের পরিবেশ, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের উপর গুরুতর এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছে এবং অব্যাহত থাকবে। যারা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এবং প্রান্তিক অবস্থার মধ্যে রয়েছেন তারা এগুলোকে গভীরভাবে এর প্রভাবগুলো অনুভব করেন। নারীরা ক্রমবর্ধমানভাবে পুরুষদের তুলনায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে স্বীকৃত হচ্ছেন।

দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী, জাতীয় সংসদের স্পিকার নারী, নারী সমাজের উন্নয়নের জন্য এর চেয়ে বড় ইতিবাচক শর্ত আর কী হতে পারে? বাংলাদেশের সংবিধানসহ বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতিমালায় নারীর রাজনৈতিক-সামাজিক ক্ষমতায়ন ও অংশগ্রহণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। জাতীয় জীবনে নারীর যথাযথ মর্যাদা ও স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকার জাতিসংঘ সিডও সনদসহ বেশকিছু আন্তর্জাতিক নীতি ও সনদে স্বাক্ষর করেছে। এতকিছুর পরও কেন পিছিয়ে থাকবে নারী? অনেক দেশে লিঙ্গ সমতার ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। বাংলাদেশেও এটা সম্ভব। প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং সেই সদিচ্ছা বাস্তবায়নে দৃঢ় প্রত্যয়। জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও আধুনিক শিক্ষার প্রসার হতে পারে এ সংক্রান্ত কর্মসূচি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ উপায়।

এই নারী দিবসের অঙ্গীকার বাস্তবায়নে আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে এবং আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে। বিভিন্ন সময়ে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর, আশপাশের বাস্তব অবস্থা পর্যবেক্ষণে নারী নির্যাতনের যে চিত্র আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হয় তা তীব্রভাবে আমাদের প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি কী বা কী হওয়া উচিত? সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি নারীর অধিকার সুরক্ষার বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসে। অনেকের জন্যই সুস্থভাবে সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকাকে সুদূরপরাহত বলেই মনে হয়।

আমরা সবাই জানি এখনো যথাযথভাবে নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে আমাদের সবার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। নারীর প্রতি সমাজ ও রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি যার চর্চা শুরু হয় পরিবারের মধ্য থেকেই। আমাদের সমাজে এখনো কন্যার চেয়ে পুত্র অধিকতর কাম্য ও আদরণীয় এবং সে কারণেই পুত্র সন্তানকেই অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার প্রবণতা শুরু হয় পরিবারেই। বোনের তুলনায় ভাই যখন যা চাইবে তাই তাকে পেতে হবে। ভাই-বোনের সামনে আদর্শ থাকেন বাবা-মা। ঘরের ভেতরে শাসনের হেরফের, স্কুল-কলেজ পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা, কৈশোর, তারুণ্য আর যৌবনে নারী-পুরুষের সম্পর্ক, তারপর একেবারে ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে সর্বত্রই এই অগ্রাধিকারের দ্বন্দ্বই নারীর ওপর টেনে আনে নির্যাতনের ধারা। নারীর তুলনায় সর্বত্র পুরুষকে বেশি পেতে হবেÑ প্রতিষ্ঠিত এই ধারণা থেকে আমাদের প্রত্যেকের নিজ নিজ জায়গা থেকে কাজ করতে হবে।

নারীর প্রতি নানা রকম বৈষম্য, তার অধিকারের অস্বীকৃতি কিন্তু এরকম কিছু কিছু খুব বাস্তব ও বৈষয়িক কারণেই এসেছেÑ যা যুগে যুগে নারী জাতিকে কঠিন অত্যাচারের শিকার হতে হয়েছে।

অনেক বছর ধরেই অনেক আকর্ষণীয় প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করা হলেও বাস্তবে এর কোনোটিই সফলতার মুখ দেখেনি। নারী বরাবরের মতোই থেকেছে অধিকারবঞ্চিত, ক্ষেত্রবিশেষে অধিকতর। এর কারণ হলো, আমাদের মননে যা ক্রিয়াশীল তা হলো নারীকে বাঁচিয়ে রাখা, অধিকার দেওয়া নয়। এ সমাজে নারীরা শারীরিকভাবে যতটা না নির্যাতিত তার চেয়ে ঢের বেশি হয় মানসিক নির্যাতনের শিকার। পদে পদে তাকে অপমান সইতে হয়। লজ্জার কথা হলো, এ সমাজ এখনও আমরা নারীকে মানুষ হিসেবে যে সম্মান দেওয়া প্রয়োজন তা দিচ্ছি না এবং নারীর মানবাধিকারকে সমানভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না।

তবে বর্তমান সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের সফল বাস্তবায়নের ফলে নারী উন্নয়ন আজ সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি, বিচারবিভাগ, প্রশাসন, কূটনীতি, সশস্ত্রবাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, শান্তিরক্ষা মিশনসহ সর্বক্ষেত্রে নারীর সফল অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশ ক্রমান্বয়ে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে নারীর সমঅধিকারের বিষয়টি সংবিধানে নিশ্চিত করেছেন। নারী তার মেধা ও শ্রম দিয়ে যুগে যুগে সভ্যতার সব অগ্রগতি এবং উন্নয়নে করেছে সমঅংশীদারিত্ব। আর তাই সারা বিশ্বে বদলে যাচ্ছে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি। এখন নারীর কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে, বৃদ্ধি পাচ্ছে স্বীকৃতি। লিঙ্গ সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ এখন রোল মডেল।

জেন্ডার রেসপন্সিভ বাজেটের মাধ্যমে নারীর প্রতি বৈষম্য হ্র্রাস ও সুযোগের সমতা সৃষ্টি। জেন্ডার বাজেটের যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে নারীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়ন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে লিঙ্গ সমতা, শিশু ও মাতৃ-মৃত্যু হ্রাস, স্বাস্থ্য ও টিকা দানের ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। নারীর আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির মাধ্যমে নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন দৃশ্যমান হয়। এজন্য দরকার নারীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি, উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা ও সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা এবং আর্থিক বরাদ্দ নিশ্চিত করা।

হীরেন পণ্ডিত : প্রাবন্ধিক ও গবেষক