বেইলি রোডের আগুন : দায় চাপানো ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি
গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও দুর্নীতিসহ নানা বিষয় নিয়ে সমালোচনা থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেক ভালো কারণেও শিরোনাম হয়েছে বাংলাদেশ। অনেক ক্ষেত্রে দেশ উল্লেখযোগ্য হারে এগিয়েছে। বিশেষ করে কাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে চোখে পড়ার মতো। এই সময়ে ঢাকা শহরে অনেক সুউচ্চ অট্টালিকা গড়ে উঠেছে। বড় বড় রাস্তাঘাট, ফ্লাইওভার, এক্সপ্রেসওয়ে একটি আধুনিক শহরের চেহারা আমাদের সামনে তুলে ধরে। কিন্তু এই আপাত আধুনিক শহরে আমরা কতটা নিরাপদ? প্রতিনিয়ত নানা দুর্ঘটনায় মানুষ মরছে এখানে। কমছে না সড়ক দুর্ঘটনা ও অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের সংখ্যা। বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে। সেই সঙ্গে এসব ক্ষেত্রে বাড়ছে বিচারহীনতা। ফলে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে। মানুষ মরছে। ক্ষতি হচ্ছে সম্পদের। যখনই কোনো বড় দুর্ঘটনা ঘটে তখন কিছুদিন হইচই হয়। তদন্ত কমিটি হয়। তদন্তের নামে একে অপরকে দোষারোপ চলে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দু-চারজন আসামি গ্রেপ্তার করা হয়। এক সময় তারা ছাড়াও পেয়ে যায়। তার পর সবকিছু আগের মতো স্বাভাবিক। যেন কিছুই ঘটেনি। আরেকটা দুর্ঘটনার আগ পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকা। কেন এমন হয়? কেন দুর্ঘটনা প্রতিরোধে আগে থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না? কেন দুর্ঘটনার পর দায়ীদের শাস্তি হয় না?
যাদের এসব দেখভাল করার কথা তারা সেই দায়িত্ব কোনোদিনই ঠিকমতো পালন করেন না। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া হয় না। একের পর এক হত্যাকাণ্ড হয় এ দেশে, কিন্তু কেউ শোধরায় না। সব দোষ যেন সাধারণ মানুষের। বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জনের মৃত্যুর পর সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম জানিয়েছেন তার অভিজ্ঞতার কথা। ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ বনানীর এফ আর টাওয়ারে ভয়াবহ আগুনের ঘটনার সময় মন্ত্রী ছিলেন শ ম রেজাউল করিম। ওই অগ্নিকাণ্ডে ২৬ জন নিহত হন। ঘটনা তদন্তে তখন উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়। তদন্তের পর দোষীদের চিহ্নিত করে রিপোর্ট দেয় কমিটি। কিন্তু আজও বিচার হয়নি। ফেসবুক পোস্টে সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী লিখেছেন, ‘বনানীর এফ আর টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ডের বিচার আজও হয়নি। এফ আর টাওয়ারের আগুন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল ভবনগুলোর অব্যবস্থাপনা ও দেখভাল করার দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভিন্ন সংস্থার ব্যর্থতা। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি করেছিলাম একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে। ৬২ জনকে দায়ী করা হয়েছিল ভবন নির্মাণ ও তদারকির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশমতো দায়ীদের সব তথ্য দিয়েছিলাম দুর্নীতি দমন কমিশনকে। অপ্রিয় হলেও সত্য, যাদের দায় নিরূপণ করা হয়েছিল তাদের সবার বিরুদ্ধে মামলা হয়নি। যাদের দায় নিরূপণ করেছিল উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি তাদের চেয়ে নিম্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা ওই দায়ীদের একটি অংশকে অব্যাহতি দিয়ে দিলেন। তাদের জামিন হয়ে গেল। কোনো কোনো আসামিকে একদিনের জন্যও জেলে যেতে হয়নি।’ সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী তার মেয়াদকালে এই ঘটনার বিচার না হওয়ার নেপথ্যের কারণ প্রকাশ না করে এখন কেন করছেন তা অবশ্য তিনি নিজেই ভালো বলতে পারবেন। তবে এটাও এক ধরনের নিজের দায়মুক্তির সাফাই। যেটা আমরা বরাবরই দেখে আসছি। তিনি কেন তার মন্ত্রণালয়ের তুলনামূলক নিচুস্তরের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেন না সবকিছু জানার পরও। তার কী দায় নেই এই বিচার না হওয়ার পেছনে। তবে সাবেক মন্ত্রীর এই স্ট্যাটাসের মাধ্যমে এটাও প্রতীয়মান হয় যে, এ দেশে এসব সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া অতটা সহজ নয়। যেখানে মন্ত্রীর মতো ব্যক্তিও অক্ষমতা প্রকাশ করেন, সেখানে সাধারণ মানুষের বিচার পাওয়ার আশা দুরাশা মাত্র।
বেইলি রোডে দুর্ঘটনার পরও সারা শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শত শত অবৈধ রেস্টুরেন্ট এখনো দিব্যি তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। নিশ্চিত করে বলা যায়, পুরান ঢাকার নাজিরাবাজারসহ অন্যান্য এলাকায় গায়ে গায়ে লাগানো রেস্টুরেন্টগুলোর কোনোটার বিরুদ্ধেই কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। বছরের পর বছর ধরে এসব প্রতিষ্ঠান কোনো ধরনের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছাড়াই ব্যবসা করে যাচ্ছে। খিলগাঁওয়ে সাম্প্রতিক সময়ে গড়ে ওঠা অসংখ্য রেস্টুরেন্টের প্রায় সবগুলোই আবাসিক ভবনে। রাজউক খিলগাঁওয়ের এসব ভবনকে বাণিজ্যিক সনদ না দিলেও ব্যবসা করতে কারও কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। ফায়ার সার্ভিস বলছে, মাঝে মাঝে দু-একবার নোটিশ দেওয়া ছাড়া আর কিছু করার ক্ষমতা তাদের নেই। প্রায় একই অবস্থা ধানমণ্ডির সাতমসজিদ রোডে। সারি সারি রেস্টুরেন্টে হাজার হাজার মানুষের আনাগোনা প্রতিদিন। কোনো কোনো ভবনের প্রায় পুরোটাতেই গড়ে উঠেছে নানা ধরনের রেস্টুরেন্ট। এমনই একটি ভবনের নকশা করেছেন প্রখ্যাত স্থপতি মুস্তাফা খালিদ পলাশ। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে ভবনটিতে না যেতে তিনি সতর্ক করেছেন নগরবাসীকে। তিনি জানিয়েছেন, ‘ভবনটির অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ক্রমান্বয়ে ভয়াবহভাবে অবনমিত করা হয়েছে। ফায়ার ডোর খুলে ফেলা হয়েছে। ফায়ার স্টেয়ারে স্টোর রুম হয়েছে। যত্রতত্র গ্যাস সিলিন্ডার রাখা হচ্ছে। অনুপেন্সি সার্টিফিকেট না নিয়েই চলছে দেদার ব্যবসা। অনুমোদন বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে হলেও এর ব্যবহারে বড় রকমের ব্যত্যয় ঘটিয়ে সার্বিকভাবে অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ রেস্তোরাঁ ভবনে রূপান্তর করা হয়েছে।’ অথচ নাকের ডগায় এমন ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের বিরুদ্ধে রাজউক, ফায়ার সার্ভিস, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ দায়িত্বে থাকা কোনো সংস্থাই কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। যেন আরেকটি বেইলি রোড কাণ্ড ঘটে যাওয়ার অপেক্ষায় সবাই।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, কোথাও কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে বা আগুনে মানুষ মারা গেলে সঙ্গে সঙ্গে দেখভালের দায়িত্বে থাকা সরকারি সংস্থাগুলো এক সুরে কথা বলতে থাকে। সবার তখন এক কথা, এ অনুমতি ছিল না, সে সনদ নেই ইত্যাদি ইত্যাদি। সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেও তাই। মানুষ মরলেই বলা শুরু হয়ে যায়, চালকের লাইসেন্স নেই, গাড়ির ফিটনেস ছিল না, নির্ধারিত গতির চেয়ে বেশি জোরে চলছিলÑ এসব মুখস্থ করা বুলি আওরাতে থাকে। বেইলি রোডের বেলায়ও এর ব্যতিক্রম দেখছি না। রাজউক বলছে, ভবনটিতে রেস্টুরেন্ট করার অনুমতি ছিল না। ফায়ার সার্ভিসের বক্তব্য, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা পর্যাপ্ত ছিল না। তিনবার নোটিশ দেওয়ার পরও ব্যবস্থা নেয়নি ভবন মালিক বা রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষ। সিঁড়িতে রাখা ছিল গ্যাস সিলিন্ডার। দুর্ঘটনার পর এসব অনিয়ম এখন সামনে আনা হচ্ছে। আনছেন কারা? যাদের এসব অনিয়ম দেখার কথা ছিল তারা। তা হলে তারা এতদিন কোথায় ছিলেন। যদি এসব অনিয়মের কথা তারা জানতেনই তবে ব্যবস্থা কেন নেননি। যারা এসবের দায়িত্বে ছিলেন কিন্তু যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করেননি, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। মামলার ক্ষেত্রেও বরাবরই এসব কর্মকর্তাকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়। বেইলি রোডের আগুনের ঘটনায় দায়ের করা মামলার ক্ষেত্রে এটার ব্যতিক্রম হয়নি। ভবন মালিক ও ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও যাদের দায়িত্বে অবহেলার কারণে এতগুলো মানুষের মৃত্যু হলো মামলায় তাদের কাউকেই আসামি করা হয়নি। আবার দায়িত্ব ছাড়ার পর নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করাও কোনো সমাধান নয়। কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলার জন্য শীর্ষ ব্যক্তি হিসেবে যার এসব বিষয়ে তদারকি করার কথা কিন্তু যথাযথভাবে তদারকি করেননি, তাকেও আনতে হবে জবাবদিহিতার আওতায়। তা না হলে কেবল ভবন মালিক, রেস্টুরেন্টের মালিক, গাড়ির মালিক ও চালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে এসব দুর্ঘটনা রোধ করা যাবে না।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
আহমেদ সাগর : সাংবাদিক ও লেখক
আরও পড়ুন:
পাকিস্তানে বহুতল শপিংমলে আগুন, নিহত ১১