বেইলি রোড, হায়!
বাংলাদেশের নবযাত্রায়, ১৯৭২-১৯৭৩ সালে বেইলি রোডের মহিলা সমিতির মিলনায়তনের কারণে এলাকাটি ‘নাটকপাড়া’ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়, থিয়েটার, ঢাকা থিয়েটার- প্রভৃতি সংগঠনের নাম মুখে মুখে। অভিনেতা-অভিনেত্রী ও দর্শক, বয়সে বেশিরভাগ তরুণ-তরুণী। ক্রমে টাঙ্গাইল শাড়ি কুটিরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে পোশাকের বাজার। আমি নিজেও পূজার পোশাক কিনেছি অনেকবার এই এলাকা থেকে। ধীরে ধীরে ফাস্ট ফুডসহ অনেক ধরনের খাবারের দোকানও স্থান করে নেয়। রমজান মাসে ইফতারির বাজার থাকে জমজমাট। খ্যাতিমান সাংবাদিক মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ‘চরমপত্র’ অনুষ্ঠানের মহানয়ক এম আর আখতার মুকুলের বইয়ের দোকানটি আমার মতো অনেকেরই পছন্দের ছিল। সম্প্রতি কয়েকটি অত্যাধুনিক আবাসিক ভবন গড়ে উঠেছে বেইলি রোডে।
প্রতিদিন বিকাল থেকে শুরু হয়ে গভীর রাত পর্যন্ত বেইলি রোডে কেবলই তারুণ্যের সমাবেশ, মিলনমেলা।২৯ ফেব্রুয়ারি লিপ ইয়ার বা অধিবর্ষের রাতে এই বেইলি রোডের একটি ভবন ভয়ঙ্কর মৃত্যুকূপে পরিণত হবে, কে জানত! বেইলি শব্দের অর্থ প্রাকারবেষ্টিত দুর্গাঙ্গন। বেইলি ব্রিজ- বহুল ব্যবহৃত। দ্রুত সংযোজনযোগ্য সেতু- এভাবে আমরা ব্যবহার করি। ঢাকার মন্ত্রিপাড়া সংলগ্ন ‘বেইলি রোড’ নামকরণ কীভাবে হয়েছে, জানা নেই। কিন্তু ‘প্রাকারবেষ্টিত দুর্গাঙ্গন’- কী নিষ্ঠুর পরিহাস হয়ে উঠল ‘কাচ্চি ভাই’ নামের খাবারের দোকানের জন্য। একাকারবেষ্টিত ভবনে প্রবেশ করা যায়, নির্গমের পথ জানা নেই।
স্বল্প সময়ের মধ্যে এত প্রাণ ঝরে গেল, যাদের বেশিরভাগ বয়সে তরুণ। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটের ছাত্রী লামিশা ইসলাম ও ছাত্র নাহিয়ান আমিনও রয়েছে অসহায়ভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়াদের দলে। ২৯ ফেব্রুয়ারি রাত ১০টার দিকে টেলিভিশন স্ক্রলে ‘কাচ্চি ভাই’ খাবারের দোকানে আগুন লাগার খবর দেখে সম্ভবত কেউই ধারণা করতে পারেনি এত প্রাণ হারিয়ে যাবে। আগুন লেগেছিল যে ভবনে, পাশেই বসবাস করছেন এক সাবেক সচিব। উদ্বিগ্ন হয়ে ফোন করি তাকে। রাত সোয়া এগারটায় তিনি বলেন, প্রচণ্ড উত্তাপ অনুভব করছেন। খানিকটা দূরের বাসাতেও অবস্থান কঠিন হয়ে উঠছে। তখন পর্যন্ত প্রায় অর্ধশত নারী-পুরুষ-শিশুর মৃত্যুর খবর জানা ছিল না তার।
প্রকৃতপক্ষে, আমাদের অনেকেরই ধারণা নেই কেমন মৃত্যুকূপ হয়ে উঠছে রাজধানী ঢাকার অনেক অনেক স্থান। মতিঝিল-দিলকুশা, গুলশান, উত্তরা, কারওয়ানবাজার, ধানমন্ডি, বারিধারা- সর্বত্র আকাশছোঁয়া ভবন। দেয়াল দিয়ে ঘেরা নয়, বেশিরভাগ এখন কাচে ঘেরা। এক সময়ে ঢাকার রান্নার জ্বালানি ছিল লাকড়ি বা কাঠ। এর জোগান আসত প্রধানত গাজীপুর এলাকা থেকে। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ সংগ্রাম শুরু হলে ঢাকা পরিণত হয়েছিল মিছিলের নগরীতে। (লেখাটি লিখছি ২০২৪ সালের ১ মার্চ, দুপুরে)।
সে সময়ে লাকড়ির পাইকারি বাজার ছিল বঙ্গবাজার-অমর একুশে হলের সংলগ্ন একটি ফাঁকা স্থানে।১ মার্চ দুপুরে আমি ওই এলাকা অতিক্রম করি স্বাধীনতার জন্য চলমান একটি বিশাল মিছিলের একজন হয়ে। আমাদের নজরে পড়ে লাকড়ির স্তূপ। মুহূর্তে ওই লাকড়ি হাতে হাতে উঠে যায়, হয়ে ওঠে স্বাধীনতা যুদ্ধের ভয়ঙ্কর অস্ত্র। এখন রাজধানীতে রান্না হয় গ্যাসে। প্রধানত পাইপলাইনে সরবরাহ হয়ে থাকে গ্যাস। হাল আমলে সিলিন্ডার ব্যবহার হয় গ্যাসের জন্য। এর সংখ্যা কত, সে হিসাব রাখা কঠিন। কেবল শহর নয়, গ্রামে-গঞ্জেও সিলিন্ডার গ্যাসের ব্যবহার। গাড়িতেও জ্বালানি হিসেবে সিলিন্ডার-গ্যাস ব্যবহার হচ্ছে। গ্রামের হাট-বাজারে গ্যাস সিলিন্ডারের বেচা-কেনা বিস্তর। মহাসড়ক-সড়কে সিলিন্ডার গ্যাসবাহী গাড়ি প্রচণ্ড বেগে ছুটে চলে দিন-রাত। পদ্মা সেতু দিয়ে আমাকে নিয়মিত যাতায়াত করতে হয়। কিছুদিন আগে একটি গ্যাস সিলিন্ডারবাহী ট্রাক সেতুতে বিগড়ে যায়। সেটা দেখে ভয় পাই- প্রশ্ন জেগেছিল, যদি এতগুলো সিলিন্ডার একযোগে সেতুর ওপর বিস্ফোরিত হয়?
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
কক্সবাজারে কুতুপালংয়ে রোহিঙ্গাদের শিবিরেও দেখেছি গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে দেদারছে। কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। গ্যাসের জন্য ব্যবহার করা সিলিন্ডারের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে সময় সময়। রান্নার চুলা, যানবাহন এবং কারখানা ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে ব্যবহার হয় যেসব সিলিন্ডার, উৎপাদক সব প্রতিষ্ঠান কি মান-পরীক্ষায় উত্তীর্ণ? কেন এদের নিয়ন্ত্রণ করা যায় না?
এই যে রাজধানীতে এত কাচের সুউচ্চ ভবন, ইমারতবিধি মানা হচ্ছে কি?
আগুন লাগলে ভবন বা সংশ্লিষ্ট এলাকায় দাহ্য পদার্থ থাকলে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। রাজধানী ও আশপাশে পোশাক শিল্পের কোনো প্রতিষ্ঠানে আগুন লাগলে প্রসঙ্গটি অবশ্যম্ভাবীভাবে ওঠে। কারখানার সবকিছুই যে অতিশয় দাহ্য! রাসায়নিক কারখানা বা গুদামেও একই সমস্যা। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের একটি অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছিলাম এভাবে- ‘চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ড’ বিষয়ে। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ওই এলাকার আগুনে করুণ মৃত্যু হয়েছিল ৭১ জনের। জনবহুল এলাকায় এমন মৃত্যুফাঁদ থাকা উচিত নয়- মতপ্রকাশ করেছিল প্রায় সব ছাত্রছাত্রী। রাজধানীর বাইরে নিয়ে যেতে হবে রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবসা- দৃঢ় মত ছিল।
কিন্তু হায়, অনেক অনেক দুর্ঘটনার তদন্তের পেছনে অর্থ ব্যয় নিছকই অপচয়!
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোড এলাকায় কয়েকটি ভবন রয়েছে, যেখানে কেবলই খাবারের ব্যবসা। প্রতিটি ফ্লোরে বুফে ব্যবস্থা। দুপুর ও রাতে সব টেবিল বুকড। গুলশান-বনানীতেও এমন দৃশ্য। জমজমাট ব্যবসা খাবারের। রমজানে ইফতারের জন্য আগাম বুকিং দিতে হয়। হাল আমলে সেহরীর আয়োজনও করা হচ্ছে। কিন্তু নিরাপত্তা ব্যবস্থা যথাযথ কীনা, সেটা দেখার কেউ যে নেই।
সম্প্রতি সাতমসজিদ রোডের দুটি খাবারের রেস্তোরাঁয় যেতে হয়েছিল ৫৬ বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া একদল ‘ছাত্রছাত্রীর’ সঙ্গে। খাবারের দোকানে পৌঁছানোর লিফটে ওঠা ও নামার জন্য লম্বা লাইন দিতে হয়েছে। বয়সে সবাই প্রায় ৭৫ ছুঁই ছুঁই। এক ভবনে চার-পাঁচটি খাবারের দোকান। সর্বত্র ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই অবস্থা। লাইন দিয়ে বুফে ব্যবস্থায় খাবার নিতে হয়। তখন যদি আগুন লাগত? কিংবা ভূমিকম্প হলে? ভবনের নিরাপত্তা যেমন প্রশ্নবিদ্ধ, একইভাবে খাবারের মান নিয়েও কথা তোলা যায়। কিন্তু বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত যে কয়েক কোটি। তারা চাল-ডাল-চিনি-ভোজ্যতেলের মতো নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে, কিন্তু অভিজাত এলাকার খাবারের মান ও দাম নিয়ে নিশ্চুপ। ভবনগুলো যে মৃত্যুকূপ, সে ভাবনাও খাবারের জন্য অপেক্ষার সময় মনে থাকে না।
ডা. সামন্ত লাল সেনের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বার্ন ইউনিট এখন বার্ন ইনস্টিটিউট। ভয়াবহ বিপদ হিসেবে আসছে ডায়াবেটিস, ড. ইব্রাহিম এটা বুঝতে পেরেছিলেন কয়েক দশক আগে। ডা. সামন্ত লাল সেন অগ্নিদগ্ধ হওয়ার ঘটনা যে দিনে দিনে বাড়বে, সে বিপদ আঁচ করেছিলেন। কিন্তু স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিতে না নিতেই তাকে যে অগ্নি-সন্ত্রাসের এত বড় সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে, সেটা বোধ করি দুঃস্বপ্নেও দেখেননি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুলিশ কর্মকর্তাদের নতুন নতুন অপরাধ মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। বেইলি রোডের ট্র্যাজেডির পেছনে যাদের দায়, তারাও কিন্তু ভয়ঙ্কর অপরাধী। এ ধরনের আরও অপরাধ প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে রাজধানী ঢাকায়, বন্দর নগরী চট্টগ্রামে এবং জেলায় জেলায় এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামেও। যারা এসব অপরাধ সংঘটিত করছে, তারা নিজেদের মনে করছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসন এবং দেশ পরিচালনার দায়িত্ব যাদের ওপর, তারাও কি এমনটি মনে করছে?
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
অজয় দাশগুপ্ত : বীর মুক্তিযোদ্ধা, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক