আর্থিক খাতের সংস্কার প্রসঙ্গে

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
আর্থিক খাতের সংস্কার প্রসঙ্গে

বাংলাদেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাতে বকেয়া খেলাপি ঋণের মতো এ খাতের সংস্কারও বকেয়া হয়ে রয়েছে দীর্ঘদিন। শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়ানো আর্থিক খাতের গভীরতা ছাড়া একটি দেশ তার উন্নয়ন আর অগ্রগতিকে টেকসই করতে পারে না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের আর্থিক খাত এখন সবচেয়ে খারাপ সময় অতিক্রম করছে। অবস্থা এমনই যে, ব্যাংক এবং দেশের অন্যান্য মৃতপ্রায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নতুন জীবন দেওয়ার জন্য মার্জারসহ নানা উপায়ের কথা ভাবতে হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে।

অনেক বছর ধরেই ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের অনাদায়ী ঋণের বোঝায় জেরবার হয়ে রয়েছে। পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ যে, নানা অংকের হিসাব করে খেলাপি ঋণ কম দেখাতে নানা কসরত করতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে। বলা হচ্ছে সব মিলিয়ে বাংলাদেশে এখন মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকারও বেশি।

সম্প্রতি বাংলাদেশে তার প্রথম সফর শেষে এক বিবৃতিতে বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অপারেশনস) আন্না বিজার্ড বলেছেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে, জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ও আর্থিক খাতের সংস্কার প্রয়োজন।

সরকারি ব্যাংকগুলোর স্বাস্থ্য দীর্ঘদিন ধরেই খারাপ। এই ব্যাংকগুলো হয়ে উঠেছে বড় বড় খেলাপিদের পৃষ্ঠপোষক। রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিচালক নিয়োগ, ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের অদক্ষতা ও দুর্নীতি, সর্বোপরি ঋণগ্রহীতাদের ক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থাকায় খেলাপি ঋণ আদায় কঠিন হয়ে পড়েছে সরকারি ব্যাংকগুলোর। আরেকটি বড় সমস্যা হলো এই রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিছুই বলতে পারে না, কারণ তাদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য আছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।

এখন বড় সংখ্যায় আছে বেসরকারি ব্যাংক। এই ব্যাংকগুলো অনেকদিন ধরে ভালোই চলছিল। কিন্তু গত ১৫ বছরে জনগণের টাকা নিয়ে ব্যাংকিং করা এসব প্রতিষ্ঠানে মালিক নামের এক শ্রেণির লোকের জমিদারি কায়েম করা হয়েছে। আইনের মাধ্যমে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে ব্যাংকগুলোর দৈনন্দিন কাজে মালিকরা হস্তক্ষেপ করছেন, নিজেরা ঋণ নামে-বেনামে নিচ্ছেন। একজন একক ব্যক্তির হাতে চলে গেছে সাতটির মতো ব্যাংক এবং তার মাধ্যমে প্রায় প্রতিটি ব্যাংক লোপাট হচ্ছে। টাকা ছাপিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হচ্ছে ইসলামী ব্যাংকগুলোকে। ব্যক্তি খাতের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে কোনো না কোনো ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর যোগ আছে এবং এরা সবাই প্রতিপত্তিশালী এবং ক্ষমতা কাঠামোর ভেতরে এদের অবস্থান।

বিভিন্ন উপায়ে মালিকরা এগুলো থেকে টাকা বের করে নিচ্ছেন, পাচার করছেন, আত্মসাৎ করছেন। কিন্তু ব্যাংকগুলোকে নিয়ন্ত্রণমূলক কাঠামোর মধ্যে রাখা, যাতে এগুলো সুষ্ঠুভাবে চলতে পারে, সেদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নজর দেয়নি। সুশাসনের ছিটেফোঁটাও নেই এ খাতে। বেসরকারি ব্যাংকে মানুষ টাকা রাখে, তবে এরা স্বার্থ দেখে শুধু মালিকদের। অর্থাৎ একটা সিস্টেম দাঁড়িয়ে গেছে যে, ব্যাংকগুলোর দায়বদ্ধতা জনগণের প্রতি নয়, কেবল মালিক গোষ্ঠীর প্রতি। গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষা করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। ব্যাংক ও আর্থিক খাতে সংস্কারের প্রথম পদক্ষেপ হবে এগুলোতে মালিকদের উপস্থিতি কমিয়ে ফেলা। বাংলাদেশের আর্থিক খাতের সবচেয়ে বড় অপশাসন হলো এখানে মূলত পরিচালকরাই ব্যাংকের মালিক, গ্রাহকরা নন এবং তারা ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের কাজে সব সময় বাগড়ে দেন। আইন করে মালিকদের যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সেটা কেড়ে না নিলে এ খাত বাঁচবে না। ব্যাংক ও আর্থিক খাতের ওপর সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর ছাড়তে হলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে বিলুপ্ত করতে হবে। এর মাধ্যমে বড় বড় রাঘববোয়ালরা ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর রাজনৈতিক চাপ তৈরি করে পুরো আর্থিক খাতেই একটা দুরবস্থা সৃষ্টি করেছে। এর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ পাবে। ক্ষমতায়িত করার পর গভর্নরকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে অর্থ মন্ত্রণালয় সংক্রান্তবিষয়ক সংসদীয় কমিটির কাছে রিপোর্ট করার ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। সঞ্চয় আহরণের পুরো কাজটি ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর ছেড়ে দিয়ে সরকারি সঞ্চয় অধিদপ্তর লুপ্ত করাও একটি বড় সংস্কার হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংককেও অনেক বেশি বিকেন্দ্রীকরণের কথা চিন্তা করতে হবে। বড় বড় ঋণখেলাপি আর দুর্বৃত্তকে কিছু করতে না পারলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ক্রমেই নিজের হাতে অনেকগুলো ক্ষমতা নিয়ে আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ১৯৪৭ সালের বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইনে চলার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন যুগের সমস্যা সমাধান করতে পারছে না। চিকিৎসার জন্য বাইরে গেলে ডলারের প্রয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে যেতে হবে কেন? বিদেশে সামান্য অর্থ বিনিয়োগ করতেও অনুমোদন লাগে। তাহলে ক্রেডিট কার্ডের সীমার বাইরে নিতে হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে যেতে হয়। এসব থেকে সরে আসতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী খেলাপি ঋণে কী পরিমাণ সুবিধা দেওয়া হবে সেটা পুরোটা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ওপর। ফলে ব্যাংক মালিকরাই এখন ঠিক করছেন কে খেলাপি আর কে খেলাপি না। এতে করে জালজালিয়াতি, অনিয়ম আর প্রতারণাই নিয়ম হয়ে গেছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যবসায়-বাণিজ্যের প্রসার ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ব্যাংক ও আর্থিক খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। অথচ সেই ব্যাংকিং খাতের স্বাস্থ্য ক্রমাগত দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে যাচ্ছে। আমাদের দুর্বল শাসন কাঠামো, মালিকদের দৌরাত্ম্য ও প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতায় এটা হয়েছে। ব্যাংকিং খাতের নানা কেলেঙ্কারির ঘটনার পেছনে রয়েছে দুর্বৃত্তদের প্রতি রাজনৈতিক প্রশ্রয়, দুর্বল ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবস্থাপনার চর্চা ও যথাযথ অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণের ঘাটতি। ব্যাংক ও আর্থিক খাতের চলমান সংকটাবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সমস্যা ও চ্যালেঞ্জগুলো সরকারের উচ্চ পর্যায়েও জানা। সমাধানের উদ্যোগ প্রয়োজন। স্বল্প ও মধ্যম মেয়াদে পরিকল্পনা গ্রহণ করে আইনগত ও কাঠামোগত সংস্কার একেবারে জরুরি হয়ে পড়েছে।


সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা : প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন