আর্থিক খাতের অপরাধ ও গোয়েন্দা কার্যক্রম

মনোয়ার হোসেন
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
আর্থিক খাতের অপরাধ ও গোয়েন্দা কার্যক্রম

বাইশ বছর ধরে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বা বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বিএফআইইউ (পূর্বেকার অ্যান্টি মানি লন্ডারিং বিভাগ), তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে অতি সাবধানতার সঙ্গে যার অনেক কিছুই সব সময় দৃশ্যমান নয়। মাঝারি আকারের লোকবল নিয়ে এবং বিভিন্ন সূত্র (ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, রাজস্ব বোর্ড, সংবাদপত্র প্রভৃতি) থেকে প্রাপ্ত তথ্য বা রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে তাদের অনুসন্ধান/তদন্ত পরিচালিত হয় এবং শেষে সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের কাছে সুপারিশ পেশ করা হয় তাদের করণীয় নির্দিষ্ট করে। তবে এই সংস্থার সুপারিশ বা পরামর্শমত পদক্ষেপ উক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহ নেয় কিনা সেই প্রশ্ন পূর্বের মতো এখনো বিভিন্ন মহলে রয়েছে। কারণ ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা আমদানি-রপ্তানি সংস্থা বা বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানগুলো এখন পর্যন্ত প্রচণ্ড ক্ষমতাবান সর্বক্ষেত্রে। ফলে জাতীয় স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট সুপারিশগুলোর বাস্তবায়ন সরকারের প্রবল রাজনৈতিক সদিচ্ছার উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকে। অর্থাৎ সংস্থাটি স্বশাসিত হলেও তার সুপারিশ বাস্তবায়ন সরকারের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল থাকছে।

আর্থিক খাতে, বিশেষ করে ব্যাংকিং উপ-খাতে, সেবার ধরন প্রযুক্তি উন্নয়ন ও ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত পাল্টাচ্ছে। দ্রুত পরিবর্তনশীল ডিজিটাল কৌশল অবলম্বন করে যত রকম অপরাধ আর্থিক খাতে হচ্ছে তত রকম অপরাধ রোধ করার সক্ষমতা থেকে বিএফআইইউ কিছু পিছিয়ে থাকলেও অপরাধের ধরন/পরিমাণ ইত্যাদি নির্দিষ্টকরণের ক্ষেত্রে সংস্থাটি পিছিয়ে আছে তা বলা যাবে না। ডিজিটাল প্রযুক্তিগত জ্ঞান আহরণ এবং অপরাধে প্রযুক্তির ব্যবহার সম্বন্ধে সংস্থাটি অসজাগ নয়। তবে যারা এই অপরাধ করেন তারা অবশ্যই অতি সতর্ক, অগ্রসর এবং শক্তিশালী। আর্থিক খাতের অপরাধ অনিয়ম ইত্যাদি বিষয়ে বিএফআইইউ-এর গত অর্থ-বছরের প্রতিবেদনে (২০২২-২৩) যে চিত্র ফুটে উঠেছে তা ভয়ঙ্কর। প্রতিবেদনটির প্রকাশ উপলক্ষে গত ২০ ফেব্রুয়ারিতে আয়োজিত এক মতবিনিময় অনুষ্ঠানে যে বিষয়টি পরিষ্কারভাবে উঠে এসেছে তা হচ্ছে আর্থিক খাতের চরম অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলায় কাদের ‘অবদান’ বা ভূমিকা, সংস্থাটির সঙ্গে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তুলনামূলক সহযোগিতা, ডিজিটাল অপরাধের প্রবণতা বৃদ্ধি, আমদানি-রপ্তানির আড়ালে অর্থ পাচার, বহির্দেশে সম্পদ স্থানান্তর এবং বর্ধিতহারে সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেন, সন্দেহজনক-অর্থ পাচারের ঘটনা প্রতিবেদন অনুযায়ী পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় অনেক বেড়েছে। সহায়তা সহযোগিতা চুক্তির অভাব থাকায় অনেক দেশ থেকে সহায়তা (তথ্য) প্রাপ্তির সমস্যা রয়ে গেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে তাদের কাছে পাঠানো ঋণ সংক্রান্ত সন্দেহজনক লেনদেনের সংখ্যা ৩৪১ (২০২১-২২) থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫২০টিতে। ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বীমা, ব্রোকারেজ হাউজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিএফআইইউতে সব মিলিয়ে সন্দেহজনক লেনদেন প্রতিবেদন পাঠিয়েছিল ১৪ হাজার ১০৬টি। পূর্ববর্তী বছরে ছিল ৮ হাজার ৫৭১টি।

বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমবর্ধমান। এই অর্থনীতিতে আর্থিক খাতের অপরাধও ক্রমবর্ধমান। যারা আর্থিক অনিয়ম ও অপরাধের সঙ্গে জড়িত তারা শক্তিশালী এবং প্রভাবশালী। এই প্রেক্ষিতে বিএফআইইউর কার্যক্রম পরিচালনা কঠিন এবং ঝুঁকিপূর্ণ। ভবিষ্যতে তা কঠিনতর হবে এই ধারণা অর্থনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চিন্তাকোষ এবং সুচিন্তার অধিকারী সবার। তাদের আশঙ্কা অনিয়মের এই সামান্য চিত্র প্রকাশ সংস্থাটির কার্যক্রম আরও সীমাবদ্ধ করে দেয় কিনা।

মনোয়ার হোসেন : সিনিয়র সাংবাদিক