বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে পোস্টার স্লোগান-কবিতা ও সংগীতের ভূমিকা
বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ইতোমধ্যে সত্তর বছরের অধিক সময় অতিক্রম করেছে। ভাষা সংগ্রামে ওই সময় পূর্ববাংলার মানুষকে উদ্বুদ্ধকরণের ক্ষেত্রে পোস্টার-স্লোগান-কবিতা ও গান আমাদের জাতীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে জাতিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদে উজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে পোস্টারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
পোস্টার শিল্প বিশ্বব্যাপী ইংরেজি ১৮৭০ সালের পর থেকে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। প্রথমদিকে এটি ছিল বাণিজ্য ও নির্বাচনকেন্দ্রিক। কালের পরিক্রমায় পোস্টার হয়ে ওঠে রাজনৈতিক সংগ্রামের উল্লেখযোগ্য হাতিয়ার। আমাদের দেশেও রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু হলে পোস্টার শিল্পের আবির্ভাব ঘটে। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষাভিত্তিক জাতি হিসেবে বাঙালির আত্মপ্রকাশ ঘটানোর ক্ষেত্রে যথার্থই একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দিন, স্বাধিকার আন্দোলনের চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে সমগ্র জাতিকে স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধকরণের অনন্য উপকরণ। একুশে ফেব্রুয়ারি আমরা খুঁজে পেয়েছিলাম আত্মপরিচয়ের ঠিকানা। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন মূলত সাংস্কৃতিক আন্দোলন হলেও বাস্তবে এটি আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়ে উপেক্ষিত বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা আন্দোলনে উদ্বুদ্ধকরণের মোক্ষম উপাদান হিসেবে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে।
বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে পোস্টার শিল্পীরা দ্রুত পোস্টার লিখে আন্দোলনরত জনতার কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন। ওই সময়ের পোস্টার অঙ্কনকারীদের মধ্যে মুর্তজা বশীর ছিলেন স্বনামধন্য। বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে প্রাপ্ত প্ল্যাকার্ড ও পোস্টারের মধ্যে অধিকাংশই ছিল মিছিলকারী শিক্ষার্থীদের মুখচ্ছবি অথবা উদ্ধত হাতসহ স্লোগানরত তরুণ প্রজন্মের তীব্র প্রতিবাদী ছবি। কোনোটিতে দেখা গেছে, পাকিস্তানির গুলিতে শহীদ বা আহত কোনো সহযোদ্ধাকে কোলে তুলে নেওয়ার স্থির চিত্র। মুর্তজা বশীরের পোস্টারে চিত্রায়িত হয়েছে পাকিস্তানি পুলিশের বন্দুক উপেক্ষা করে মিছিল নিয়ে অগ্রসরমান শিকল-ছেঁড়া যুবক। শিল্পী সালেহ আহম্মদের পোস্টারে ছিল ভাষণদানরত এক তরুণের পাশে দাঁড়িয়ে অন্য এক তরুণ। হামিদুর রহমানের পোস্টারে স্থান পেয়েছে নারী শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অংশগ্রহণের চিত্র। সব পোস্টারের বিশেষত্ব ছিল এবং অঙ্কিত চিত্রগুলোতে তরুণ শিক্ষার্থীদের দ্রোহের রূপ প্রাধান্য পেয়েছিল। বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, সব পোস্টার-ফেস্টুনে স্থান পেয়েছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবি।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের স্লোগানগুলোও তরুণ সমাজকে সংগঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তৎকালীন স্লোগানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলÑ রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, সকল ভাষার সমান মর্যাদা চাই, ছাত্রদের দাবি মানতে হবে, নাজিম-নূরুল আমীন ভাই ভাই- এক দড়িতে ফাঁসি চাই, রাজবন্দিদের মুক্তি চাই, শেখ মুজিবের মুক্তি চাই, আমাদের দাবি মানতে হবে, আরবি হরফে বাংলা লেখা- চলবে না, চলবে না, নূরুল আমীনের কল্লা চাই, নূরুল আমীনের ফাঁসি চাই, মন্ত্রিসভার পতন চাই, নাজিমুদ্দিন গদি ছাড়ো, শহীদ স্মৃতি অমর হোক, শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না ইত্যাদি।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
কবিতায় ভাষা সংগ্রাম : ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট নিয়ে অসংখ্য কবিতা রচিত হয়েছে। এই আন্দোলন কবি-সাহিত্যিকদের কবিতা লেখার ক্ষেত্রে যথেষ্ট উদ্বুদ্ধ করেছে। আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতিতে অন্যান্য শাখার তুলনায় কবিতার মাধ্যমেই ভাষা আন্দোলনের বেশি প্রতিফলন ঘটে। এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রচিত কবিতার সংখ্যা অগণিত। মুক্তিযুদ্ধের কবিতা বাদে বাঙালির কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা ভাষা আন্দোলনে রচিত কবিতার মতো মানুষকে আন্দোলিত করেনি। ভাষা সংগ্রামে রচিত কবিতাসমূহ বাঙালির স্বকীয়তা তথা স্বাতন্ত্র্যবোধকে জাগ্রত করে আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়েছে।
বাঙালি যে শুধু ক্রন্দন-বিলাসী নয়, তারা সংগ্রামীও; প্রয়োজনে বুকের তাজা রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করতে পারে তা এই কবিতাসমূহে চমৎকার প্রতিফলিত হয়েছে। ভাষার জন্য আত্মদানকারীরা মৃত্যুঞ্জয়ী, যত কাল বাংলা ভাষা থাকবে, বাঙালি জাতি থাকবে, ততকাল বায়ান্নর ভাষা শহীদরা জাতির অন্তরের অন্তস্থলে অনুপ্রেরণা হয়ে বেঁচে থাকবেন। তাই কবিদের কবিতায় অকুতোভয় ভাষা শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধার প্রতিফলন ঘটেছে।
সংগীতে ভাষা সংগ্রাম : ১৯৪৭-এ দেশ ভাগের পরেই দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে গঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্বাংশ অর্থাৎ পূর্ব বাংলায় জোরপূর্বক উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার তীব্র প্রতিবাদে মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠার ন্যায্য দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা অর্থাৎ সান্ধ্যআইন ভাঙতে গিয়ে অনেকের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে আন্দোলন আরও ব্যাপকতা লাভ করে। ভাষা শহীদদের স্মরণে সাংবাদিক ও লেখক আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। যদিও এর আগেই ভাষা সংগ্রামের উপর গান রচিত হয়েছিল।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
আটচল্লিশের মার্চে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কর্তৃক উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার ঘোষণার প্রতিবাদে সমগ্র পূর্ববাংলা জুড়ে গণসংগীতের মাধ্যমে আন্দোলনের সূচনা ঘটে। যদিও বাংলা ভাষার পক্ষে রচিত গানগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির পর থেকে।
বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছে, বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে শাণিত করেছে ভাষা সংগ্রাম উপলক্ষে তৈরি পোস্টার-স্লোগান-কবিতা ও গান। যার ফলে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের ভিত্তিমূল প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছে। অমর একুশের ছয় দশকের অধিক সময় অতিক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও একুশের উল্লেখযোগ্য পোস্টার-স্লোগান-কবিতা ও গান সংরক্ষণের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ বা পৃষ্ঠপোষকতা যথাযথ নয়। যার ফলে একুশের আন্দোলনের উপাদানগুলো অধিকাংশই লোকচক্ষুর অন্তরালে অর্থাৎ কেবল পত্রপত্রিকার পাতায় পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাই সেগুলো সংরক্ষণে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ বা পৃষ্ঠপোষকতার বিকল্প নেই। তা না হলে মহান একুশের চতনা ও মূল্যবোধ তথা মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কালপরিক্রমায় হারিয়ে যাবে।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
হাসান-উজ-জামান : কলাম লেখক ও মহাসচিব, মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ