একুশের প্রেক্ষাপটে আমাদের সাহিত্য

সেলিনা হোসেন

নিজস্ব প্রতিবেদক
২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
একুশের প্রেক্ষাপটে আমাদের সাহিত্য

বাঙালির আবহমানকালের মূল্যবোধ, জীবনদর্শন নিয়ে পূর্ব বাংলার বাঙালি বর্তমানে একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের অধিবাসী। এই স্বাধীনতা বাংলা ভাষাকে একটি দেশের রাষ্ট্রভাষা করেছে। এই স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা ভাষায় জাতিসংঘে ভাষণ দিয়ে একে আন্তর্জাতিক মর্যাদায় উন্নীত করেছেন। তিনিই সেই বাঙালি যিনি বলেছিলেন- ‘‘ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও বলব- আমি বাঙালি, বাংলা আমাদের দেশ, বাংলা আমার ভাষা, বাংলা আমার নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে।’’ এই স্বাধীনতা লাভের দীর্ঘ পটভূমি আছে। এই পটভূমি স্বল্প সময়ে অনায়াসে তৈরি হয়নি। এর জন্য সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে এই জনগোষ্ঠীকে- ঝরেছে অগণিত মানুষের রক্ত এবং জীবন।

মোটা দাগের টানে কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়।

এক. সাতচল্লিশে দেশভাগের পরবর্তী সময়ে বাহান্নোর ভাষা আন্দোলন পূর্ববঙ্গের বাঙালির একটি বিশাল এবং স্থায়ী সাংস্কৃতিক অর্জন। মাতৃভাষার জন্য এই জীবনদান পৃথিবীর ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা। এ ঘটনা বাঙালির জীবনে এক অমিত সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয়। তাই ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ আমাদের নিকট অতীতের একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।

দুই. এই ভূখণ্ডের বাঙালির পরবর্তী ধাক্কা সামরিক শাসনের নিপীড়ন- সামরিক শাসনের অভিজ্ঞতা তার এই প্রথম এবং কোনো বাঙালি জনগোষ্ঠীকে এ ধরনের নিপীড়নের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছিল কিনা তা আমার জানা নেই, যার ভেতর থেকে সে জনগোষ্ঠীর লেখকরা কুড়িয়ে আনতে পারে গুটিকয় সোনালি শস্যদানা।

তিন. পৃথিবীর কোথাও রবীন্দ্রনাথ রাষ্ট্রযন্ত্রের রোষানলে পড়েননি, যেমন পড়েছিলেন তৎকালীন পূর্ববঙ্গে। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় তথ্যমন্ত্রী রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার নিষিদ্ধ করেছিলেন রেডিও-টেলিভিশনে। পূর্ববঙ্গবাসী তাকে বুকে আগলে রাখার জন্য প্রতিবাদে, বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। রবীন্দ্রসংগীত গাইবার অপরাধে সরকারের হাতে নিগৃহীত হয়েছিলেন কোনো কোনো শিল্পী। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান রবীন্দ্রসংগীত লিখতে পারেন না কেন বলে ধমকেছিলেন লেখকদের তার সরকারি বাসভবনে ডেকে নিয়ে। ১৯৬৯ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ থেকে ছাড়া পেয়ে তার প্রথম ভাষণে বলেন, ‘আমরা রবীন্দ্রনাথের বই পড়বই, আমরা রবীন্দ্রসংগীত গাইবই এবং রবীন্দ্রসংগীত এই দেশে গীত হবেই।’ সাংস্কৃতিক কর্মীদের প্রতিবাদের পাশাপাশি এটি ছিল একটি সুস্পষ্ট রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। শেষ পর্যন্ত মানুষের প্রতিরোধের মুখে নতি স্বীকার করেছিল পাকিস্তান সরকার রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্রে নিষিদ্ধ ঘোষিত রবীন্দ্রসংগীত পুনঃপ্রচারের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে প্রবাসী সরকারের কোনো নির্দেশ ছিল না, তবু মানুষের মুখে মুখে সেই দারুণ দুর্দিনে যে গান উঠে আসে তা রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’ ভুল সুরে, ভুল উচ্চারণে এই গান মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে শক্তি এবং সাহসের প্রতীক হয়ে। রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করে মানুষের এই লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা লেখকদের এক দারুণ সঞ্চয়।

চার. পাকিস্তান সরকারের শোষণ, বঞ্চনা, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং সাংস্কৃতিক পদদলনের প্রতিবাদে নয় মাস স্থায়ী যুদ্ধ বাঙালির জীবনের আকাশছোঁয়া অন্যরকম অভিজ্ঞতা। দেখতে হয়েছে গণহত্যা, বন্দি শিবিরের নিদারুণ অত্যাচার, নারী ধর্ষণ- শিশুর খুলি রাজপথে বেয়নেটের মাথায়। দেখতে হয়েছে গেরিলা অপারেশন, রাতের অন্ধকারে মুক্তিযোদ্ধার জ¦লজ¦লে চোখ। দেখতে হয়েছে স্বাধীনতার পর যুদ্ধশিশু। বিধ্বস্ত দেশ। শুনতে হয়েছে স্বজন হারানোর অর্তনাদ। সইতে হয়েছে বুদ্ধিজীবী হত্যার শূূন্যতা।

পাঁচ. ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ইতিহাসের মহান বাঙালি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে জীবন দিতে হয় সামরিক বাহিনীর কতিপয় সদস্যের হাতে। যিনি ১৯৫৫ সালের আগস্ট মাসে করাচিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান জাতীয় সংসদের অধিবেশনে তার গমগমে কণ্ঠস্বরে স্পিকারকে বলেছিলেন ‘‘স্যার, আপনি দেখবেন, ওরা পূর্ব বাংলা নামের পরিবর্তে পূর্ব পাকিস্তান নাম রাখতে চায়। আমরা বহুবার বলেছি, আপনারা এ দেশটাকে ‘বাংলা’ নামে ডাকেন। বাংলা শব্দটার একটা নিজস্ব ইতিহাস আছে, আছে এর একটা ঐতিহ্য। আপনারা এই নাম পরিবর্তন করতে চাইলে আমাদের জনগণের সঙ্গে আলাপ করতে হবে।’’ তিনিই আবার ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বর মাসে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু দিবসে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বলেছিলেন, ‘‘আর পূর্ব পাকিস্তান নয়, আর পূর্ব বাংলা নয়। শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক ও শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মাজারের পাশে দাঁড়িয়ে জনগণের পক্ষ থেকে আমি ঘোষণা করছি- আজ থেকে বাঙালি জাতির এই আবাসভূমির নাম হবে ‘বাংলাদেশ’।” এই বাংলাদেশে তার কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাই বলে ইতিহাসের নিজস্ব গতি কেউ থামিয়ে দিতে পারে না। বাংলাদেশ তার নিজস্ব পথ খুঁজে নিয়ে চলেছে। উর্বর হচ্ছে তার নিজস্ব মাটি।

যে ক’টি বড় ঘটনার উল্লেখ করলাম এর বাইরে আরও নানা ধরনের বিপর্যয় মোকাবেলা করতে হয়েছে দেশবাসীকে। দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ, মহামারি, জলোচ্ছ্বাস, সাইক্লোন এবং গণঅভ্যুত্থানের মতো অসংখ্য ছোট-বড় ঘটনা এ দেশের মানুষের শান্তি ও স্বস্তির বিপরীতে লৌহ-কঠিন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকার শপথ।

এই পথপরিক্রমার অজস্র অভিজ্ঞতা নিয়ে তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের ভাষা ও সাহিত্য। এই নির্মাণ হাজার বছরের বাংলা ভাষার মূল স্রোতে একটি বড় সংযোজন- যে সংযোজনের ফলে হাজার বছরের বাংলা ভাষার বৈচিত্র্য এবং আয়তন বেড়েছে। এ যাত্রার অনুষঙ্গ নানাবিধ- বিশ্লেষণ করলে বেরিয়ে আসবে কীভাবে এ দেশের ভাষা ও সাহিত্য বাঙালির গৌরবকে শাণিত করেছে, দিয়েছে ব্যতিক্রমধর্মী রচনার মৃত্তিকা।

১৯৪৮ সালের ঢাকার কার্জন হলে অনুষ্ঠিত সাহিত্য সম্মেলনে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বলেন, ‘পূর্ব বাংলার বাঙালিদের ওপর জোর করে উর্দু ভাষা চাপালে তা পূর্ব বাংলায় গণহত্যার শামিল হবে।’ তিনি স্পষ্ট করে বলেন, ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য তার চেয়েও বেশি সত্য আমরা বাঙালি।’

এভাবেই সাহিত্যের ভেতর দিয়ে আমরা জীবন অভিপ্রায়ের এবং একই সঙ্গে শিল্প অভিপ্রায়ের লক্ষ্য স্থির করেছি। আমাদের কোনো দ্বিধা ছিল না। অন্যদিকে ইসলামি সংস্কৃতির ভাবনাপুষ্ট এবং উগ্র মুসলিম জাতীয়তাবাদে বিশ^াসী বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ পাকিস্তানের স্বার্থে রবীন্দ্রনাথকে বর্জন করার কথা অবলীলায় ঘোষণা করেছিলেন। প্রচুর আরবি-ফার্সি শব্দের ব্যবহার করে ইসলামি সাহিত্য রচনা করার ক্ষেত্র তৈরি করেছিলেন। এসবের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের লেখকদের শক্ত পায়ে নিজেদের অবস্থানে দাঁড়াতে হয়েছিল। একটু পেছনে ফিরে তাকিয়ে বলতে চাই বিশের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা, বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন এবং পরবর্তীকালে প্রগতি লেখক ও শিল্পীসংঘ ঢাকাকেন্দ্রিক বাঙালি মুসলিম লেখকদের সৃজনশীলতার ক্ষেত্র তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। সংগঠিত চিন্তা এবং জীবন-যাপনের নানাবিধ মৌল উপাদান সাহিত্যের প্রাথমিক শর্ত। এই শর্তকে পূরণ করে জাতির জীবন জিজ্ঞেসার অন্বেষা এবং নান্দনিক বোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ঘটনাসমূহ। অসংখ্য ঘটনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পূর্ববাংলার মানুষকে তার অস্তিত্বের মূলটুকু খুঁজে নিতে হয়েছে সাতচল্লিশ-পরবর্তী সময়ের শুরু থেকে একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের বাসিন্দা হিসেবে। যে ভূখণ্ডের রাজধানী ঢাকার জন্ম মোঘল শাসকদের হাতে মধ্যযুগে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে প্রতিষ্ঠিত কলকাতা নগরী থেকে যার বিকাশ সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারায়।

নদীবাহিত এই বদ্বীপ অঞ্চল ছিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক আশ্চর্য মধুর জীবন সম্মিলন। নদী প্রভাবিত করেছিল মানুষের জীবনযাপন- আতিথেয়তায়, মমতায়, সারল্যে এ ভূখণ্ডের মানুষ ছিল শান্ত ধীরলয়ে প্রবাহিত নদীর মতো। আস্তে আস্তে রাজনৈতিক সামাজিক মিথস্ক্রিয়ায় বদলে গেল জীবনের নানা দিক। নানা সংঘাত মেলবন্ধন ঘটাল মানুষের জীবনের সরল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে। এ সবের ভেতরই তার সাহিত্য বিমূর্ত হয়েছে জীবনকে দেখার সমগ্রতায়। সংঘাতের ছোট ছোট ধাপগুলো পেরিয়ে পাকিস্তান আমলে এ ভূখণ্ডের বাঙালি মুখোমুখি হয়েছে নিজের অস্তিত্বের সংকটের। একদিকে তাকে এই সংকটের মোকাবেলা করতে হয়েছে রাজনৈতিকভাবে, অন্যদিকে এই সংকটের বিপন্নতার ভেতর দিয়ে এগিয়েই সাহিত্যের শিল্পকে ছুঁয়ে দেখার জন্য হাত বাড়াতে হয়েছে।

সাহিত্য ধারণ করে জীবনের সবটুকু। যদি সে জীবন শান্ত, স্থির পরিস্থিতিতে গতিশীল ধীমান হয়, তবে তার সাহিত্য হবে এক রকম। হবে সম্পর্কের টানাপোড়েন, ভালো-মন্দের দ্বন্দ্ব, ব্যক্তিক সংকট, মানবিকতার চিত্র এবং আরও অসংখ্য অনুভব-উপলব্ধির শৈল্পিক বিন্যাস। আর যদি তা না হয় তবে সেখানে যোগ হবে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক দোলাচলের রক্তভরা উপাদানসমগ্র। বাংলাদেশের সাহিত্য এ দু’টো দিককেই ধারণ করেছে। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ সবকিছুর ভেতর ব্যক্তির জীবনদর্শন, সত্য উপলব্ধির গভীরতম বোধ যেমন আছে, তেমন আছে রাষ্ট্রিক সংকটের বিশ্লেষণ, প্রতিরোধের ভাষা, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কঠিন উচ্চারণ এবং ধর্মকে রাজনীতির ব্যবসায় টেনে আনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে নিজস্ব একটি গদ্যভঙ্গি তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সাহিত্য তার শক্ত জমিন খুঁজে পায়।

একুশের ভাষা আন্দোলনের পর থেকে বাংলা সাহিত্যের শতাব্দী জুড়ে বহমান মূল স্রোত থেকে একটি ভিন্ন ধারা নির্মাণ করে এগিয়ে এসেছে।

সেলিনা হোসেন : কথাসাহিত্যিক