ভাষা বৈষম্যে বিপদ বাড়ছে

আফছার বাহার
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
ভাষা বৈষম্যে বিপদ বাড়ছে

দেশে সাধারণত অর্থনৈতিক ও লিঙ্গবৈষম্য নিয়েই বেশি কথা হয়। এ দুটির বাইরে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বৈষম্যের মতো কিছু বৈষম্য মাঝে-মধ্যে আলোচনায় আসে। তবে দেশে এরই মধ্যে ভাষাবৈষম্য একটি ভয়ঙ্কর মাত্রা পেয়েছে। এ নিয়ে আলোচনা খুব একটা চোখে পড়ে না। বৈষম্যটি হচ্ছে ইংরেজি ভাষা জানা ও না জানার মধ্যে। পৃথিবীতে যে দেশে রক্তগঙ্গা পার হয়ে মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি আদায় করতে হয়, সে দেশেই এখন ইংরেজি জানা লোকজন সমাজ ও রাষ্ট্রে বিশেষ সুবিধা পাচ্ছে। এর বিপরীতে মাতৃভাষা বাংলা ভালোভাবে জানার পরও শুধু ইংরেজি দক্ষতার অভাবে সমাজের নানা অঙ্গনে মানুষ বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।

এই বৈষম্য এতটাই প্রাতিষ্ঠানিকতা পেয়েছে যে, আমাদের সমাজের প্রায় সব মানুষ এটা মেনে নিয়েছে। যে ইংরেজি জানবে সে বেশি দক্ষ এবং বেশি সুযোগ পাবে- এমন ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। তবে এই ভাষাবৈষম্য শেষ পর্যন্ত আমাদের সর্বনাশের কারণ হতে পারে, সেটা বোধ হয় আমরা বিবেচনায় নিচ্ছি না। একটি বৈষম্য আরেকটি বৈষম্য তৈরিতে সহায়ক হয়। তেমনি এই ভাষাবৈষম্য আমাদের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও লিঙ্গবৈষম্যকেও ত্বরান্বিত করছে।

ভাষাবৈষম্য হচ্ছে মানুষের ভাষাগত দক্ষতার অসমতা। অন্যভাবে বললে, মনের চাহিদা ব্যক্ত করতে গিয়ে কিংবা প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সারতে গিয়ে মানুষ যদি ভাষাগত প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়, সেটাই হচ্ছে ভাষাবৈষম্য। আমাদের দেশে প্রধানত দ্ইু রকম ভাষাবৈষম্য রয়েছে। একটি হচ্ছে ইংরেজি জানা বনাম ইংরেজি না জানা। দ্বিতীয়টি হচ্ছে প্রমিত বাংলা ভাষা ও আঞ্চলিক ভাষার মধ্যে বৈষম্য। প্রমিত বাংলা বা ‘শুদ্ধ বাংলা’ না জানা লোকজনও আমাদের সমাজে নানা বৈষম্যের শিকার হয়। তবে চলনসইভাবে প্রমিত বাংলা বলতে পারলে এ যাত্রায় মোটামুটি উৎরে যাওয়া যায়। কিন্তু ইংরেজি না জানলে যেন ক্ষমা নেই।

পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, স্বাধীনতার আগে আমাদের বাংলা ভাষা ও বাঙালিদেরকে উর্দুর সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছিল। এখন লড়াই করতে হচ্ছে ইংরেজির সঙ্গে। ইংরেজরা আসার আগে এ দেশে রাষ্ট্রভাষা ছিল ফার্সি। তখনও এ ভূখণ্ডের মানুষকে লড়াই করতে হয়েছে ফার্সির সঙ্গে। অর্থাৎ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই ভূখণ্ডের রাষ্ট্রের সঙ্গে সাধারণ মানুষের যোগাযোগের প্রধান প্রতিবন্ধকতা হয়ে থাকে বিদেশি রাষ্ট্রভাষা। স্বাধীনতার ৫০ বছরে সেই প্রতিবন্ধকতা কি দূর হয়েছে? ভাষা হলো মানুষের বোধ ও ভাবের বাহন। সরকারি-বেসরকারি অফিসে সব মানুষ গিয়ে যদি তার প্রয়োজন বা সমস্যার কথা বলতে না পারে, তাহলে সে তার কাজ সারবে কিভাবে?

অলিখিতভাবে আমাদের উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হয়ে গেছে ইংরেজি। যদি উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি বাধ্যতামূলক হতো, তাহলে হয়তো আমরা ‘শিক্ষায় ভাষাবৈষম্য’ সত্ত্বেও ইংরেজি জানা আরও বেশি লোক পেতাম সমাজে। বিদ্যমান বাস্তবতায় উচ্চ শিক্ষায় ইংরেজির দ্বারস্থ হতে গিয়ে বড় অংশটিই মনে করে, কোনো রকম ইংরেজিটা চালিয়ে নিতে পারলেই হয়। ফলে অল্পসংখ্যক শিক্ষার্থী ভালো ইংরেজি জানার কারণে তারাই পরীক্ষায়, গবেষণায় এবং পরবর্তীকালে চাকরি-বাকরিতে অধিকতর সুযোগ-সুবিধা পায়। আবার ইংরেজি না জানার কারণে অনেকে উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয় কিংবা উচ্চশিক্ষা নিলেও এর ফসল ঘরে তুলতে পারে না। আবার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইংরেজি জানা নির্ণায়ক হয়ে ওঠায়, যথার্থ উচ্চশিক্ষাও নিশ্চিত হচ্ছে না। দেশে হরহামেশাই উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে যে প্রশ্ন তোলা হয়, এর পেছনে এটাও একটা কারণ হতে পারে। চাকরিতে প্রবেশের সময়ও উচ্চশিক্ষা বড় নির্ণায়ক হয়ে উঠেছে। অথচ বিদেশিদের সঙ্গে যোগাযোগের প্রয়োজন রয়েছে- এমন ক্ষেত্র ছাড়া সবার ইংরেজি জানাটা জরুরি হওয়ার কথা নয়। এর বড় ক্ষতিটা হচ্ছে- অনেক মেধাবী তরুণ হতোদ্যম হয়ে পড়ে।

দেশে করপোরেট সংস্কৃতির আগ্রাসী ঢেউয়ে এরই মধ্যে ব্যবসায়ী সমাজে যোগাযোগের প্রায় প্রধান ভাষা হয়ে উঠেছে ইংরেজি। বিশেষ বণিক শ্রেণির উচ্চ পর্যায়ে এখন অনেকটাই ইংরেজিতে কথাবার্তা হয়। চাকরির আবেদনপত্র ও জীবনবৃত্তান্ত থেকে শুরু করে অফিস আদেশ, ছুটির আবেদন, ব্যবসায়িক যোগাযোগ, লেনদেনের প্রধান ভাষা হয়ে গেছে ইংরেজি। এমনও দেখা গেছে, দেশের তরুণ শিল্পমালিকরা মোটামুটি ভালো বাঙলা বলতে পারলেও ভালো করে বাংলা লিখতে বা পড়তে জানেন না। গত এক দশকে দেশের অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকানাই উত্তরাধিকার সূত্রে দ্বিতীয় প্রজন্মের হাতে এসেছে। ফলে তাদের যে ইংরেজি নির্ভরতা, তাতে করে সামনের দিনগুলোতে ব্যবসায় ক্ষেত্রে ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে বাংলার মৃত্যু ঘটতে পারে। এর ফলে আপাতত কোনো সমস্যা নেই বলে কারও মনে হতে পারে। কিন্তু নতুন উদ্যোক্তা তৈরি, নতুনদের ব্যবসা সম্প্রসারণ এবং প্রতিযোগিতামূলক ও ন্যায্য ব্যবসা নিশ্চিত করা সামনের দিনগুলোতে কঠিন হয়ে যেতে পারে। এর ফলে সমাজে ব্যবসা বৈষম্য ছাড়াও নানা ধরনের সংকট তৈরি হবে।

ইংরেজি জানার আধিপত্যের ফলে বড় সমস্যার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যক্তির যোগাযোগ কঠিন হয়ে পড়া। স্থানীয় পর্যায় থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত সরকারি অফিস-আদালতে একজন সেবাপ্রার্থীকে প্রথমে অন্যতম যে প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়তে হয়, সেটি হচ্ছে ইংরেজি না জানা। আমাদের লাখ লাখ দোকানদার আছেন, তাদেরকে যখন ভ্যাট-ট্যাক্স দিতে হয়, তখন ইংরেজির আধিপত্যের মুখে তাকে পড়তে হয়। ইংরেজি না জানা বা কম জানার কারণে আমাদের দেশে চিকিৎসা নিতে গিয়েও বৈষম্যের শিকার হয় রোগীরা। টাকার বিনিময়ে তারা প্রেসক্রিপশন ক্রয় করলেও সেটা দেওয়া হয় ইংরেজিতে। ফলে ওষুধের দোকানির ওপর নির্ভর করেই তাকে ওষুধ ক্রয় ও সেবন করতে হয়।

দেখা যায়, দেশে ব্যাংকঋণ নিতে গিয়ে যেসব দলিলে স্বাক্ষর করতে হয় ঋণগ্রহীতাকে, তার শর্তগুলো ভালো করে না বুঝেই স্বাক্ষর করতে হয়। কারণ দলিলগুলো ইংরেজিতে। ব্যাংক থেকে পাঠানো খুদে বার্তা শুরু করে, ক্রেডিট কার্ড ও ব্যাংকের স্টেটমেন্ট সবই ইংরেজিতে। এর ফলে গ্রাহকরা না বুঝে অনেক ভুল করে ফেলেন। ব্যাংকগুলোও অনেক সময় গোপন ফি আদায় করে। আমাদের অর্থনীতিবিদরা প্রায়ই বলে থাকেন, দেশে সক্ষমতার পরও বিপুলসংখ্যক মানুষ ব্যাংক হিসাবে টাকা রাখেন না, কারণ তাদের মধ্যে ব্যাংকভীতি কাজ করে। অথচ এই ভীতির পেছনেও ভাষাবৈষম্য কাজ করছে বলে মনে করার কারণ আছে।

ভাষাবৈষম্য সামাজিক বৈষম্য তৈরি করে সন্দেহ নেই। কিন্তু এই বৈষম্য দুর্নীতিকেও উৎসাহিত করে। স্থানীয় পর্যায়ে থানা, হাসপাতাল, সাবরেজিস্ট্রি অফিস এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের শীর্ষ ব্যক্তিদের কথাবার্তায় বা মৌখিক আদেশে প্রচুর ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করা হয়। ফলে সেবাপ্রার্র্থী সাধারণ মানুষ ইংরেজি না জানাকে নিজেদের পাপ মনে করেন।

ফলে এই বৈষম্য অনিয়মের উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে। লক্ষ করলে দেখা যাবে, প্রায় সব সরকারের প্রকল্পের নামকরণ করা হয় ইংরেজিতে। সরকারের প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়নে পিইডিবি প্রোগ্রামগুলো হতে পারে এক্ষেত্রে একটি বড় উদাহরণ। আমাদের পদ্মাসেতু প্রকল্পের প্রতিটি খুঁটি বসানোতে দেশবাসীর নজর ছিল। কিন্তু পদ্মাসেতুর চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রায় দ্বিগুণ বেশি অর্থায়নের প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়নে গ্রহণ করা পিইডিবি-১, ২, ৩ ও ৪ কর্মসূচিগুলোতে কেন নজর রাখল না মানুষ? হয়তো প্রচার সেভাবে হয়নি। তারপরও আর্থিক অংকে মহামূল্যবান প্রকল্পগুলোর প্রতি সাধারণ মানুষের অনাগ্রহের পেছনে দুর্বোধ্য ইংরেজি নামকরণও যে কারণ হতে পারে, সেটা ভাবা দরকার। কারণ এটা সত্য যে, সাধারণ মানুষের নজরদারি ও পর্যাপ্ত তথ্য থাকলে যে কোনো প্রকল্প স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় চলতে বাধ্য।

এ কথা সত্য যে, ইংরেজি আধিপত্য আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজের সুযোগসন্ধানী মানুষকে বেশি অনিয়মের সুযোগ করে দিচ্ছে। এটা ঐতিহাসিক কালের মতোই সাধারণ মানুষকে রাষ্ট্রব্যবস্থাপনা থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। ফলে ভাষাবৈষম্য বজায় থাকায় একটি শ্রেণির সুবিধা হচ্ছে। এর ফলে সমাজের বিকাশ সুষ্ঠু ধারায় হচ্ছে না। অথচ সর্বত্র মাতৃভাষা বাংলার প্রচলন থাকলে দেশের শিক্ষা আরও কার্যকর হতে পারত, আরও বেশি দক্ষ জনশক্তি গড়ে উঠত, সৃষ্টিশীল উদ্যোক্তা পাওয়া যেত। সর্বোপরি মানুষের ক্ষমতায়নের মধ্য দিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্র আরও সমৃদ্ধ হতে পারত।


আফছার বাহার : যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, দৈনিক আমাদের সময়