নারী ফুটবলাররা সমাজে জাগরণ সৃষ্টি করেছেন
বয়সভিত্তিক আন্তর্জাতিক নারী ফুটবলে খেলোয়াড়রা দেশবাসীকে আরেকটি গৌরবময় সাফল্য উপহার দিয়েছেন। এটি হলো সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতের সঙ্গে যুগ্ম শিরোপা জয়। আর এই বিজয়ের মাধ্যমে অনূর্ধ্ব ১৯ নারী দল অর্জিত শিরোপা ধরে রাখার চ্যালেঞ্জে জয়ী হলো। সাফ বয়সভিত্তিক নারী ফুটবলের আটবারের ফাইনালের সব কটিতেই খেলেছে বাংলাদেশ আর জিতেছে পাঁচটিতে। নতুন কোচ সাইফুল বারীর অধীনে এবারের যুগ্ম জয়টা একটু আলাদা- কেননা নতুন কয়েকজন খেলোয়াড় নিয়ে গঠিত দলটি প্রতিশ্রুতিপূর্ণ ফুটবল খেলেছে। নারী দলের সব খেলোয়াড়, কোচ এবং ম্যানেজমেন্ট স্টাফ সব সদস্যকে অভিনন্দন। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে অদমনীয় মনোভাব, জয়ের ক্ষুধা সম্ভব করেছে বয়সভিত্তিক ফুটবলের মুকুটে আরেকটি পালক সংযোজিত করতে। দেশের হয়ে লড়াই করে মানুষকে আনন্দিত এবং গর্বিত করার চেয়ে বড় কিছু আর হতে পারে না। নারী দলের প্রতিটি জয় সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ইতিবাচক সচেতনতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখছে।
বাংলাদেশ-ভারতের সঙ্গে খেলার নিয়মে চ্যাম্পিয়নশিপ ট্রফি ভাগাভাগি করে নিলেও বাংলাদেশ কিন্তু চার জাতি (বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল এবং ভুটান) চ্যাম্পিয়নশিপে লিগের খেলায় ভারতকে ১-০ গোলে পরাজিত করে ফাইনালে উঠেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ লিগ পর্যায়ে নেপালকে ৩-১, ভারতকে ১-০ গোলে এবং ভুটানকে ৪-০ গোলে পরাজিত করে শক্তিমত্তার পরিচয় দিয়েছে। দক্ষিণ-এশিয়ার বয়সভিত্তিক নারী ফুটবলে বাংলাদেশে দশ বছর ধরে ধারাবাহিকতার সঙ্গে সাফল্য চিহ্নিত হয়েছে নতুন শক্তি হিসেবে। ক্রীড়াঙ্গনে জাগরণ হিসেবে।
কমলাপুরের বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অনুষ্ঠিত ফাইনাল ম্যাচ নির্ধারিত সময় পর্যন্ত ১-১ গোলে ড্র থাকায় এর পর অতিরিক্ত সময়ে খেলা এবং এর পর টাইব্রেকারে গড়ায় এখানেও কেউ কাউকে পেছনে ফেলে এগোতে পারেনি। এর পর শ্রীলংকা থেকে আগত ম্যাচ কমিশনার অজ্ঞতাপূর্ণ অদ্ভুত সিদ্ধান্ত (মুদ্রা নিক্ষেপের মাধ্যমে জয়) মাঠে বিতর্ক এবং নাটকের জন্ম দেয়। এতে আন্তর্জাতিক ফুটবলের সৌন্দর্যে ছেদ পড়ে। ভারত দল মাঠ ছেড়ে চলে গেলেও বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড়রা মাঠে অবস্থান করেন। সাফ ফুটবল ফেডারেশনের জন্য এটি একটি বিব্রতকর অবস্থা। শেষ পর্যন্ত খেলার চেতনাকে সম্মুন্নত রাখার স্বার্থে উভয় দলকে যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হয়। জয় হয়েছে জীবনবোধসম্পন্ন খেলা ফুটবলের। এর পর উভয় দলের অধিনায়ক এবং সহ-অধিনায়কের হাতে ট্রফি তুলে দেন যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রী নাজমুল হাসান।
বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের ‘ডিসপ্লে’ ক্যাবিনেট আলোকিত করে রেখেছে আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে, বিশেষ করে বয়সভিত্তিক ফুটবল থেকে ধারাবাহিকতার সঙ্গে অর্জিত ট্রফিগুলো। দেশবাসীকে জয়ের স্বাদ উপহার দেওয়া শুরু সেই ২০১৫ সালে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ আঞ্চলিক (দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চল) চ্যাম্পিয়ন হওয়া থেকে। তখন থেকে দেশের ফুটবলে নতুন সম্ভাবনার জন্ম। ক্রীড়াঙ্গনে রীতিমতো সামাজিক বিপ্লব। নারীরা প্রমাণ করেছেন ফুটবলে তাদের পক্ষে অনেক দূর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব! খেলার প্রতি আছে নারী ফুটবলারদের প্রচণ্ড আবেগ ও ভালোবাসা। আর এটাই সবচেয়ে বড় শক্তি। আন্তর্জাতিক ফুটবলে নারী দলের সাফল্যের পাল্লা অনেক বেশি ভারী। এটি আশাব্যঞ্জক এবং স্বস্তি। দেশে নারী ফুটবলাররা আন্তর্জাতিক ম্যাচ ছাড়াও ফিফা আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচও খেলেন। ফিফা প্রীতি ম্যাচে জয়ের পরিপ্রেক্ষিতে র্যাংকিংয়ে উন্নতি হয়েছে। এই যে নারী দলের আন্তর্জাতিক ফুটবলে ভালো করা এর পেছনে আছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের শতভাগ অবদান। দেশের নামিদামি ক্লাবগুলোও নারী ফুটবলে পৃষ্ঠপোষকতা করতে চায় না। ক্লাবগুলো নারী ফুটবল দল গঠনকে বোঝা মনে করে। বাণিজ্যিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে নিয়মিতভাবে ফুটবল লিগ আয়োজন সম্ভব হয় না।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
অনেক সীমাবদ্ধতা, অনেক সমস্যা এবং প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে বাফুফে চ্যালেঞ্জ নিয়ে বছরের পর বছর নারীদের আবাসিক ক্যাম্প (এই ক্যাম্পকে এএফসি নারী ফুটবল একাডেমি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে) পরিচালনা করছে আর এতে করেই ‘রেজাল্ট’ পাওয়া গেছে। ফুটবল ফেডারেশনের সেই সামর্থ্য নেই বড় স্কেলে পুরো দেশের নারী ফুটবলকে কাভার করার। বর্তমানে দেশে নারী ফুটবলের যে অবস্থা এতে করে বলা মুশকিল নারী ফুটবলে কখন সম্ভব হবে একটা পরিপূর্ণ স্ট্রাকচার ও ‘স্ট্র্যাটেজিক’ রোডম্যাপ তৈরি করা যা নারী ফুটবলের সম্ভাবনাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে।
সব সময় বলা হয়ে থাকে নারী ফুটবলে ‘পোটেনশিয়ালিটি’ অনেক বেশি, ফুটবলে নারীদের ‘পার্টিসিপেশন’ অনেক বাড়ানো উচিত। কিন্তু কীভাবে সম্ভব। পরিকাঠামো কোথায়। নারী ফুটবল নিয়ে আক্ষেপের জায়গা প্রচুর। নারী ফুটবল নিয়ে প্রচুর কথাবার্তা বলা হয়েছে কিন্তু সরকারি পর্যায়ে উদ্যোগের অভাব রয়েছে। কখনো আর্থিক অনুদান ও পরিকাঠামো বিষয়টি অগ্রাধিকারের তালিকায় স্থান পায়নি।
নারী ফুটবলের পথচলা প্রথম থেকেই কঠিন। সামাজিক প্রতিকূল পরিবেশ, প্রকাশ্যে প্রচণ্ড বিরোধিতা, অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবারের বাধা এবং আপত্তি থাকা সত্ত্বেও দৃঢ় মনোবল, ঐকান্তিকতা, সর্বাত্মক চেষ্টা এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বৈষম্যময় ক্রীড়াঙ্গন নারীরা প্রমাণ করেছেন স্বপ্ন পূরণ এবং সাফল্য অর্জনের পথে কোনো বাধাই বাধা নয়Ñ যদি লক্ষ্য স্থির থাকে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
দেশে নারী ফুটবলারদের গল্প একদম ভিন্ন। আর এই জীবনের গল্প সব সময় হƒদয়কে নাড়া দেয়। নারী ফুটবলাররা সমাজের কোন শ্রেণি থেকে, কোথা থেকে উঠে এসে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে দেশকে মহিমান্বিত এবং গৌরবান্বিত করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন এটি ভাবলে শুধু অবাক হওয়া নয় গর্বে বুক ভরে ওঠে। তারা অনুকরণীয় হতে পেরেছেন। তারা চেষ্টা করছেন সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে মনমানসিকতা পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে।
একটি সময় যারা নারী ফুটবলের বিরোধিতা করেছেন, বিভিন্ন যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন, যে পরিবার তাদের মেয়েকে মাঠে আসা থেকে বিরত রাখার সব ধরনের চেষ্টা করেছে, অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ে দিয়ে দিতে চেয়েছে সেই সমাজের মানুষ, পরিবার এখন মেয়ের জন্য গর্ববোধ করে। মেয়ে যে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। নারী ফুটবলাররা পরিবারের পাশে সব সময় দাঁড়িয়েছেন। আর্থিক এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধায় টানাপড়েনের সংসারে কমবেশি স্বস্তি এসেছে। মেয়ের সঙ্গে বাবা-মা ও অন্য আত্মীয়স্বজনের কাছে গুরুত্ব এবং পরিচিতি বেড়েছে। বেড়েছে সমাজ জীবনে কদর। এই যে অনূর্ধ্ব-১৯ সাফ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপা ধরে রাখতে পেরেছে নারী দল এটি হলো সমন্বিতভাবে সবাই মিলে খেলে চ্যালেঞ্জ বিজয়। এর পরও একজনের নাম অসাধারণ হিসেবে ফুটবল অনুরাগীদের মুখে ভীষণভাবে আলোচিত হয়েছেÑ তিনি হলেন সাগরিকা। সাগরিকা ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈলের মেয়ে। মেয়ে যাতে ফুটবল মাঠে না যেতে পারে এর জন্য তার বাবা-মা তাকে বিয়ে দিয়ে দিতে চেয়েছেন। এদিকে সাগরিকার লক্ষ্য একটাই তিনি দেশের হয়ে ফুটবল খেলবেন। আর তাই পরিবারের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে ফুটবলে আত্মনিয়োগ করেছেন। ফল তিনি পেয়েছেন। পেরেছেন দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে, অনূর্ধ্ব-১৯ নারী সাফে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার পেয়েছেন সাগরিকা। সমাজ এবং পরিবারের বাবা-মা এখন মেয়ের সাফল্যে বেজায় খুশি। মেয়ের সাফল্যে বাবা-মায়ের চোখ দিয়ে আনন্দের অশ্রু ঝরেছে। সমাজের মানুষ এখন সাগরিকার অসাধারণ সাফল্যে গৌরবের ভাগীদার।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
ইকরামউজ্জমান : কলাম লেখক ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন। প্যানেল রাইটার ফুটবল এশিয়া।