আগাম ফসল উঠানোর ঝুঁকি নিয়ে ভাবতে হবে
উন্নত বিশ্বে কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহারের বিষয়টি আমাদের সবারই কম-বেশি জানা আছে। প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে আগাম ফসল ফলানোর মাধ্যমে লাভবান হওয়ার একটি সংস্কৃতি আমাদের কৃষিতেও গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে শীতকালীন সবজি আবাদে এটি চোখে পড়ছে বেশি। আগাম সবজি আবাদে অনেক কৃষক নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তন করেছেন। বাজারে সবজির সরবরাহ বেড়েছে। ক্রেতাদের বৈচিত্র্য উপহার দিচ্ছে। কিন্তু এবার আমাদের কৃষিতে নীরবেই যে বিষয়টি চলছে সেটি হলো আগাম সবজি আবাদ নয়। বরং সেটি হলো আগাম সবজি আহরণ। এর যে সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বাজার সরবরাহে এ নিয়ে কেউ ভাবছেন বলে মনে হচ্ছে না।
আমাদের কম-বেশি সবাইকে বাজারে যেতে হয়। যারা নিয়মিত বাজারে যান তারা যদি একটু গভীরভাবে অনুসন্ধান করেন তাহলে যে জিনিসটি চোখে পড়বে সেটি হলো এবার আলু এবং পেঁয়াজের দাম ও সরবরাহের বিষয়টি। এই দুটি ফসল আমাদের ভোক্তাদের সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে। রাজনীতির মাঠ কাঁপানোতেও অবদান থাকে এই ফসলের। পণ্য দুটির দাম বাড়লে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয় জনসাধারণের মাঝে। কিন্তু এ নিয়ে যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ করা বা এর সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে কেউই চিন্তা করছেন না বলে আমার মনে হচ্ছে। সংরক্ষণ, বাজারে সরবরাহ, অতিরিক্ত ফলন হলে দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষকদের সুরক্ষার বিষয়টি কোনো সময়ই নিশ্চিত করা হয়নি।
মৌসুমের এই সময়ে আলু, পেঁয়াজের এই উচ্চ মূল্যের পেছনে অবৈধভাবে দাম বাড়ানোর কারসাজি কাজ করছে কিনা সেটি নিয়ে কেউ ভাবছেন না। তবে এর পেছনে কোনো কারণ আছে কিনা তা খুঁজে বের করতে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। বাণিজ্য সচিবকে এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
শীতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কৃষকরা যারা আগাম আলু এবং পেঁয়াজের আবাদ করেন তাদের ফসল বাজারে আসতে থাকে। নতুন আলুর ভালো দাম পাওয়া যায় বলে কষ্ট এবং ঝুঁকি নিয়ে কৃষকরা আগাম ফসল ফলান। এক পর্যায়ে নিয়মিত ফসল উঠতে থাকলে দাম চলে আসে সবার নাগালে। এমনকি কৃষক ক্ষতির মুখেও পড়ে যান কোনো কোনো মৌসুমে। আগাম নতুন আলুর দাম কেজিতে ১০০ টাকার উপর থাকে বেশ কয়েকদিন। পরে মৌসুমী আলু উঠতে থাকলে তা ১০ টাকার নিচেও আসে কোনো কোনো সময়। পেঁয়াজের ক্ষেত্রেও আগাম পেঁয়াজ বিগত মৌসুম শেষের উচ্চমূল্য কমানোর প্রতিযোগিতায় নেমে নিজেও বিক্রি হয় উচ্চমূল্যে। সেঞ্চুরীর ঘর থেকে নেমে আসে ২০ টাকা কেজিতে। কিন্তু এ বছর এই ফর্মুলাটি কাজ করছে না বাজারে। আগাম জাত শেষ হওয়ার পরও দাম কমার কোনো লক্ষণ নেই বাজারে। আর এই সুযোগে কৃষকরা এখন ফসল পরিপক্ব হওয়ার আগেই ভালো দাম পাওয়ার আসায় অপরিপক্ব ফসল নিয়ে আসছেন বাজারে। এতে কৃষকরা লাভবানও হচ্ছেন। এর চেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছেন মধ্যস্বত্বভোগী ও বাজার কারসাজির সঙ্গে জড়িতরা।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
একটি জমিতে যদি আলু পরিপক্ব হওয়া পর্যন্ত কৃষক অপেক্ষা করেন তাহলে প্রতি বিঘায় ১ হাজার কেজি আলু উৎপাদন করতে পারেন। কিন্তু বাজারে দেখা যাচ্ছে অপরিপক্ব ও ছোট আলু কৃষকরা সরবরাহ করছেন। এতে করে যে জমিতে ১ হাজার কেজি আলু উৎপাদন হওয়ার কথা সেই জমিতে আলু উৎপাদন হচ্ছে ৫০০/৬০০ কেজি। কিন্তু পরিপক্ব আলু উৎপাদন করলে আরও বেশি সময় মাঠে পরিচর্যা করতে হবে এবং বেশি ফসলে যে দাম পাওয়া যাবে তার চেয়ে বেশি দাম পাওয়া যাচ্ছে সেই ৫০০/৬০০ কেজিতেই। তাই কৃষকরা ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার মুখোমুখি না হয়ে পরিপক্ব হওয়ার আগেই উঠিয়ে ফেলছেন ফসল। এখন বাজারে ৪০/৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে আলু। পরিপক্ব হলে বিক্রি হতে পারে ১০/১৫ টাকা কেজি; সেই হিসাব থেকেই কৃষকরা এমনটি করছেন। অন্যান্য বছর মৌসুমের এই সময়ে পেঁয়াজের ২০/৩০ টাকা কেজিতে চলে আসত। কিন্তু এ মৌসুমে এখনও দাম ৭০/৮০ টাকা কেজি। কৃষকরা তাই পেঁয়াজের ক্ষেত্রেও অপরিপক্ব ফসল তুলে বিক্রি করে ঘরে মুনাফা তুলে নিচ্ছেন।
কৃষকরা আগাম ফসল উঠাতে যেভাবে মনোযোগ দিচ্ছেন সেটি অব্যাহত থাকলে এবার আমাদের দেশের কোল্ড স্টোরেজগুলোতে কোনো আলুর সরবরাহ থাকবে কিনা সেটি নিয়ে ভাবতে হবে। পেঁয়াজের গুদামগুলোও শূন্য থাকে কিনা সেটি দেখতে হবে। কৃষি বিভাগ, বাজার কর্মকর্তা আর প্রশাসন যদি এখনই মাঠে না নামে তাহলে বড় ধরনের ভোগান্তির মুখে পড়তে হতে পারে আমাদের। বিশেষ করে সামনের রমজান মাসে এই দুটি ফসলের অনেক চাহিদা থাকবে। এবারের রোজা ফসল দুটির ভর মৌসুমে হলেও বাজারের লক্ষণ থেকে অনুমান করা যায় ঝুঁকি আছে অনেক। আমাদের জনগণ বিচার-বিবেচনা না করেই অনেক কাজ করেন। যার প্রভাব খারাপই হয় সব সময়। প্রকৃতি আর সম্পদ ধ্বংস করার ক্ষেত্রে আমরা নিজেরাই দায়ী। আর ধ্বংসের মাত্রা যখন আমরা চরম পর্যায়ে পৌঁছাই তখনই সরকার হস্তক্ষেপ করে। আইন তৈরি করে। তারপরও আমরা আইন না মানার মধ্যেই থাকতে পছন্দ করি। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি আমাদের প্রাকৃতিক মিঠা পানির মাছের কথা। ইলিশ মাছের কথাও বলা যায়। আমরা যখন নির্বিচারে পোনামাছ নিধন করতে শুরু করি তখন সরকার আইন করে সেটি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে। জাটকা শিকার থেকে রক্ষার জন্য ইলিশের প্রজনন মৌসুমে ইলিশ শিকার বন্ধ রাখছে। আমার মনে হচ্ছে মাছের ফর্মুলাটি কৃষিতেও ব্যবহার করার সময় হয়েছে।
একটি উদাহরণ দিয়ে বলতে চাই। আমাদের দেশে দিন দিন কাঁচা আমের চাহিদা ও দাম বাড়ছে। পাকা আম ৩০/৪০ টাকা কেজি হলেও অনেক সময় কাঁচা আম ২০০ টাকা কেজিতেও বিক্রি হয়। এখন যদি কাঁচা আমের এই উচ্চমূল্য পাওয়ার আশায় আম বাগানের মালিকরা কাঁচা আম বিক্রি করতে থাকেন তাহলে পাকা আমের কী হবে? পেঁয়াজ এবং আলুর ক্ষেত্রে এবার এমনটিই হচ্ছে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
কৃষি বিভাগের হাতে নিশ্চয় পরিসংখ্যান রয়েছে আমাদের দেশে কী পরিমাণ আলু ও পেঁয়াজ প্রয়োজন। আর আবাদ হয়েছে কতটুকু। আবার আবাদকৃত ফসল যদি যথাসময়ে না তুলে আগাম তোলা হয় তাহলে উৎপাদনের কী অবস্থা হবে। এই বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করে আলু ও পেঁয়াজের আবাদ থেকে উঠানোর সময় নির্ধারণ করে দেওয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে পরিপক্ব ফসল তুলতে গিয়ে যদি কৃষকরা ক্ষতির সম্মুখীন হয় সরকার যাতে তাদেরকে ভর্তুকি দেয় সেই বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। কেউ যাতে কারসাজি না করতে পারে সেটিও দেখতে হবে। আর না হলে কিছুদিন আগেও আমরা ধান ও আলু রপ্তানির কথা বলে এলেও এখন আমদানির দিকে ঝুঁকতে হবে। পেঁয়াজ ও ভোজ্যতেলে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার স্বপ্ন দেখলেও আগাম উত্তোলনের কারণে উৎপাদন ঘাটতি বেড়ে গিয়ে এলসিতে ডলারের চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তাই বিষয়টি নিয়ে এখনই ভাবার সময় এসেছে।
শাহ ফখরুজ্জামান : সাংবাদিক ও আইনজীবী
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!