টনক নড়বে কি
বাংলা ভাষার সূর্য অস্ত যায় না- এমনটিই বলা হয়। প্রকৃতপক্ষে সূর্য সর্বদা বিরাজমান, কখনো উদয় ও অস্তমিত হয় না। বিশ্বের প্রতিটি দেশে, কারও দিন এবং কারও রাত- কেউ না কেউ কথা বলছে কিংবা লিখছে বাংলায়।
বাংলাদেশকে নিয়ে বিভ্রম কেটে যাচ্ছে ক্রমেই। ‘অর্থনীতি : নয় (৯) থেকে এক হাজার (১০০০)- ১৯৭০ থেকে ২০৪০’, সত্তর বছরে এমন পরিবর্তন ঘটতে চলেছে আমাদের এই ভূখণ্ডে, অর্থাৎ বাংলাদেশে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের আগের বছর অর্থাৎ ১৯৭০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জিডিপি বা মোট দেশজ উৎপাদন ছিল প্রায় ৯ বিলিয়ন (প্রকৃতপক্ষে ৮.৯৯ বিলিয়ন) ডলার। এমন একটি ভূখণ্ড, যা অচিরেই যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বব্যাংকের খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়কদের একটি অংশের লেখা ও কথায় ‘বাস্কেট কেস’ হিসেবে অভিহিত হয়। কেউ আরও এক ধাপ এগিয়ে বলতে থাকেন ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’। অথচ ভূখণ্ডটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, এজন্য ত্রিশ লাখ মানুষ আত্মদান করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ ভূখণ্ডের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন স্বাধীনতার জন্য। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াবেই। একদল পণ্ডিত বলতে থাকেন- বাইরের করুণা ছাড়া, ভিক্ষা ছাড়া দেশটি টিকবে না। আর ভিক্ষা দিয়েও লাভ নেই- যা ঝুড়িতে দেবেন, নিচের ফুটা দিয়ে হাওয়া হয়ে যাবে।
কিন্তু সেটা ঘটেনি। দুর্জনের মুখে ছাই- বাংলা ভাষার প্রবাদ। সেটা যে দেশের জন্য সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে, হয়তো প্রবাদের সূচনার সময় ভাবা হয়নি। বিশ্বে ৩০-৩৫ কোটি লোক বাংলায় কথা বলে। কয়েক বছর আগে কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘সানন্দা’ পত্রিকায় একটি চিঠি দেখেছিলাম এভাবে- এক তরুণী লন্ডন থেকে ব্রিটেনের মালিকানাধীন একটি বিমানে কলকাতায় অবতরণ করেন। যাত্রাপথে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্র দেওয়া হলে তার ধারণা হয়, কলকাতার বাংলা ভাষাভাষী যাত্রীদের কথা ভেবেই এ আয়োজন। কিন্তু তার ভ্রম দূর হতে সময় লাগেনি। বিমানের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে ঘোষণা আসে- আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ঢাকা, বাংলাদেশের রাজধানী। ওই তরুণী বুঝতে পারেন যে বাংলাদেশের জন্য, যে দেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা- ব্রিটিশ বিমান কোম্পানি তাদের প্রতি সম্মান দেখাতেই বাংলা ভাষায় প্রকাশিত পত্রিকা রেখেছে।
তবে কথায় বলে- যে জাতি গৌরব ‘ভাঙিয়ে’ চলতে চায়, তার উন্নতি থমকে যায়। বাংলাদেশের গৌরব করার মতো কত কিছুই না রয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে আমাদের মনে রাখতে হবে- সারা রাত নব-নব তারা ফুটাতেই তো আনন্দ!
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
এ পথে চলতে হলে অনেক কিছুই বর্জন করতে হবে, অনেক কিছুই গ্রহণ করে চলতে হবে। ৯ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি ৭০ বছর এমনকি তার চেয়েও বছর দশেক কম সময়ে ১০০০ বিলিয়ন বা এক ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যাওয়া নিঃসন্দেহে বড় অর্জন হবে। কিন্তু এটাও মনে রাখা চাই- দেশের আয়ের ২৬ শতাংশ যদি মাত্র ১০ শতাংশ ধনবান লোকের কব্জায় থাকে, তা হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রশ্নবিদ্ধ হবেই। এখনো বাংলাদেশে ১৭-১৮ শতাংশ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে, এটা লজ্জার বৈকি।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স- এটা সরকারের ঘোষিত নীতি। বাজারে ‘সিন্ডিকেটের’ দাপট-দৌরাত্ম্য কমিয়ে আনা, খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমানো- এসবও টপ প্রায়োরিটি। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের কজন মন্ত্রী-এমপি এ বিষয়ে উচ্চকিত? কৃষকের কাছ থেকে প্রতি কেজি চাল ৪০-৪২ টাকায় কিনে ৬৫-৭০ টাকায় বিক্রি করে যারা নিজেদের সম্পদ রাতারাতি বাড়িয়ে নেয়, তাদের বিরুদ্ধে দল হিসেবে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে? কয়েক বছর আগে পাঠ্যপুস্তক প্রকাশনায় সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানটির এক শীর্ষ ব্যক্তিকে প্রশ্ন করি- আপনারা প্রতিবছর চার কোটির বেশি ছাত্রছাত্রীকে পাঠ্যপুস্তক দেন বিনামূল্যে। অনেক দেশ এমন কল্যাণমুখী কর্মসূচির কথা ভাবতেই পারে না। কিন্তু আমি তো কোনো হিসাবেই প্রাইমারি ও মাধ্যমিক স্কুলে চার কোটি ছাত্রছাত্রীর সমীকরণ মেলাতে পারি না। বেশি শিক্ষার্থী দেখিয়ে একটি মহল সরকারের বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে না তো? বলা বাহুল্য, তিনি নীরব থাকেন।
বাজারে কারসাজি আছে, অনিয়ম আছে, অতি মুনাফালোভ আছে। এসব দমনে সরকারের অঙ্গীকার আছে। এটাও জানা যে, এ ধরনের মন্দ কাজে ব্যবসায়ীদের একটি অংশ জড়িত এবং ছোট থেকে বড় এমনকি অতিকায়, সবাই এর সঙ্গে জড়িত। কিন্তু ব্যবসয়ী সংগঠনের নেতৃত্বে যারা আছেন, তারা কি এ বিষয়ে কোনো দায় বোধ করেন? এটাও জানা যে, ব্যবসায়ীদের নানা সংগঠন ও অ্যাসোসিয়েশন এখন সরকার-সমর্থিতদের নিয়ন্ত্রণে। কাওরানবাজার থেকে কাঁচাবাজার সরিয়ে নিতে গেলে কিংবা নদনদীর তীর দখলমুক্ত করতে গেলে যারা লাঠি-ইটপাথর নিয়ে এগিয়ে আসে পুলিশের মোকাবিলায়, তারা কিন্তু নিজেদের ক্ষমতাসীন দলের জন্য নিবেদিত বলেই জাহির করে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে ডিজিটাল বাংলাদেশ ও স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের কর্মসূচি সামনে এনেছেন। বিশেষভাবে তরুণ সমাজ এ কর্মসূচি লুফে নিয়েছে। করোনাকালে ডিজিটাল বাংলাদেশ আমাদের রক্ষাব্যূহ হিসেবে কাজ করেছে। দুর্ভাগ্য, যে ধর্মান্ধচক্র ডিজিটাল বাংলাদেশ মানতে চায় না, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা অস্বীকার করে, তারা এর ব্যবহার করে কুশলতার সঙ্গে। কিন্তু তার মোকাবিলায় যে আদর্শিক সংগ্রাম দরকার, বিশেষভাবে শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে- দল হিসেবে আওয়ামী লীগ কি সে বিষয়ে সচেতন? গত কয়েক বছরে দলটি ব্যবসায়ী, আইনজীবীসহ বিভিন্ন পেশাজীবীর সমাবেশ করেছে, শ্রমিক ও ছাত্রদের সমাবেশ করেছে। তারা কি সংস্কৃতি কর্মীদের সমাবেশ করেছে? বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর যখন সেই পাকিস্তানি কায়দায় নানাভাবে আঘাত আসছে সুপরিকল্পিতভাবে, দল হিসেবে কি আওয়ামী লীগ তার মোকাবিলায় উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারছে?
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
নির্বাচনে টানা চার মেয়াদে জয় পেয়েছে আওয়ামী লীগ। অর্থনীতিতে যে ধরনের উন্নয়ন বহু বছর অভাবিত ছিল, তা এখন হাতের মুঠোয়। বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি এ সাফল্যকে উপেক্ষা করে জনবিচ্ছিন্ন হয়েছে। তাদের এখন ‘গৃহপ্রবেশ’ ঘটেছে। সরকারকে পেশিশক্তির জোরে, অসাংবিধানিকভাবে হটিয়ে দিতে গিয়ে নিজেরাই হটে গিয়ে গৃহকোণে আশ্রয় নিয়েছে। এটাকে ক্ষমতাসীনরা নিজেদের সাফল্য হিসেবে দেখতেই পারে। প্রতিপক্ষ ভুল পথে চলেছে এবং সরকারপক্ষ সঠিকভাবে চলার কারণে তাদের রুখে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এটাও মনে রাখা দরকার, উন্নত বিশ্বের সারিতে বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে হলে সুশাসন হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। এজন্য করণীয় রয়েছে অনেক। বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দলকে ‘স্মার্ট’ করে তোলা। দলে গণতন্ত্র চর্চায় আরও বেশি মনোযোগ চাই।
সামনে উপজেলা নির্বাচন। এবার দলীয় প্রতীক থাকবে না। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলের প্রতীক বরাদ্দ দেওয়ার অপব্যবহার যাদের কারণে হয়েছে তারা কিন্তু বিভিন্ন পর্যায়ে প্রভাবশালী নেতা হিসেবে বিবেচিত। নিজের লোক রাখতে হবে স্থানীয় সরকারের সর্বত্র- এ চিন্তায় দোষের কিছু নেই। কিন্তু বেছে নিতে হবে দক্ষ, যোগ্য ও স্বচ্ছ ভাবমূর্তির ব্যক্তিকে। আওয়ামী লীগে এবং তার চারপাশে এমন মানুষের অভাব নেই। অতীতে কি এটা করা হয়েছে? এখন কি তা করার চেষ্টা লক্ষ করা যায়? এসব প্রশ্নে অনেকেই নীরব থাকবেন, মাথা ঝাঁকাবেন- যার অর্থ ‘না’। আওয়ামী লীগের টনক নড়বে কি?
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
অজয় দাশগুপ্ত : বীর মুক্তিযোদ্ধা, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক