জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ

শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ

বড় হয়ে কী হতে চাও অথবা তোমার জীবনের লক্ষ্য কী- ছোটবেলায় এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হননি এ রকম মানুষ পাওয়া ভার। রচনার জন্য ‘Aim in Life’ তো পড়তেই হয়েছে। ছাত্ররা ডাক্তার, নার্স অথবা শিক্ষক ছাড়া আর কিছু হতে চেয়েছে এমন খুব একটা শোনা যায়নি বা দেখা যায়নি। ডাক্তার অথবা নার্স হলে রোগীর সেবা করা যাবে, গরিবদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দেওয়া যাবে। আর শিক্ষকতা হলো মহান পেশা, তারা মানুষ গড়ার কারিগর। এতে মানুষকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার সুযোগ পাওয়া যাবে। কেউ কেউ হয়তো পাইলট হতে চেয়েছে। কারণ মুক্ত বিহঙ্গের মতো হৃদয় পাখনা মেলে সীমাহীন আকাশে ওড়া যাবে। পৃথিবীতে আরও কতশত পেশা বা কর্ম আছে। সেগুলোতে কারও লক্ষ্য নেই। তা হলে প্রশ্ন জাগে ওসব কর্মে যারা সম্পৃক্ত তারা লক্ষ্য ছাড়া বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে কর্মে নিয়োজিত? সে ক্ষেত্রে তাদের কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করা নিশ্চয়ই বাতুলতামাত্র। তবে যারা ডাক্তার হয়েছেন তাদের সবার ডাক্তার হওয়ার লক্ষ্য ছিল কিনা অথবা শিক্ষকদের মধ্যে সবার লক্ষ্য শিক্ষক হওয়া ছিল কিনা এটি একটি বড় প্রশ্ন। যদি তাই হতো তা হলে সেবার ব্রতের ডাক্তারদের বিরুদ্ধে অবহেলা, গাফিলতি, ব্যবসায়িক মনোভাব, প্যাথলজি কমিশন বাণিজ্যের মতো অভিযোগের পাহাড় থাকত না। আবার শিক্ষকদের প্রোজ্জ্ব¡লিত আলোয় ঘোর অমাবস্যায়ও অন্ধকারের লেশমাত্র খুঁজে পাওয়া যেত না।

মানুষ স্বপ্ন দেখে, কল্পনায় ভাসে- আমি যদি ধনী হতাম, ক্ষমতাবান হতাম, কোম্পানির মালিক হতাম, দামি গাড়ির, বাড়ির মালিক হতাম, সেরা কোম্পানির বড় কর্মকর্তা হতাম আরও কত কী! এগুলো হলো স্বপ্ন, কল্পনা। আর কেউ যদি এই স্বপ্নগুলো থেকে নির্দিষ্ট করে কোনো কিছুকে পাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তখন সেটা হবে লক্ষ্য। ছোটবেলায় পরীক্ষার খাতায় অথবা কারও প্রশ্নের উত্তরে যারা জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন তাদের কতজন লক্ষ্যার্জনে সফল হয়েছেন তার সঠিক হিসাব হয়তো কারও কাছে নেই, তবে সংখ্যাবিচারে এটি ব্যতিক্রম বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে নিঃসন্দেহে। অনেক সফল ব্যক্তিকেও বলতে শুনেছি তিনি যা হয়েছেন ছোটবেলায় কখনো তা হতে চাননি বরং জীবনে অন্য কিছু হতে চেয়েছিলেন। তবে কি আমরা ছোটবেলায় ভুল লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি অথবা লক্ষ্য নির্ধারণের কোনো কার্যকারিতা নেই?

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএ প্রোগ্রামের অধীনে ১৯৭৯ সালে একটি গবেষণা চালানো হয়। সেখানে একটি শ্রেণির সবাইকে লিখিত ও নির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করতে বলা হয়। সেখানে ৮৪ শতাংশ শিক্ষার্থীর কোনো লক্ষ্য ছিল না, ১৩ শতাংশ শিক্ষার্থীর অলিখিত লক্ষ্য ছিলো এবং বাকি ৩ শতাংশ শিক্ষার্থীর লিখিত লক্ষ্য ছিল। দশ বছর পর তাদের ইন্টারভিউ নিতে গিয়ে দেখা যায় যে, যে ১৩ শতাংশ শিক্ষার্থীর অলিখিত লক্ষ্য ছিল তাদের উপার্জন লক্ষ্যহীন ৮৪ শতাংশ শিক্ষার্থীদের থেকে দ্বিগুণ। কিন্তু যে ৩ শতাংশের লিখিত ও নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল তাদের উপার্জন ছিল ১৩ শতাংশ অলিখিত লক্ষ্যধারীর চেয়েও প্রায় ১০ গুণ। এতে লক্ষ্য নির্ধারণের কার্যকারিতা শতভাগ প্রমাণিত। বিজ্ঞজনরা যথার্থই বলেন, ‘যদি লক্ষ্য থাকে অটুট, বিশ্বাস হৃদয়ে, হবেই হবে দেখা, দেখা হবে বিজয়ে।’

তা হলে বলতেই হয় লক্ষ্য নির্ধারণে আমাদের ভ্রান্তি আছে। ডাক্তার হওয়ার আকাক্সক্ষায় মুখে যদিও আমরা সেবার কথা বলছি, প্রকৃত অর্থে টাকা কামানোই আমাদের মনোবাসনা। মানুষ তো দেখেই শেখে। অর্থনীতির ভাষায় একে বলে ‘প্রদর্শন প্রভাব’। সেজন্যই উচ্চমাধ্যমিকে বসার পর পরই ছেলেমেয়েদের ভর্তি নিয়ে বাবা-মায়েদের দুচোখের পাতা এক হয় না। আর এ সুযোগে কোচিংয়ের রমরমা বাণিজ্য, সঙ্গে চিকিৎসা ব্যবসাটাও।

আমরা সচরাচর একটা বিষয়কে যেভাবে দেখি তার চেয়ে একটু ভিন্নভাবে যদি তাকে ব্যাখ্যা করি তা হলে কেমন হয়? ধরুন একজন সেলসম্যান যেভাবে কোনো পণ্য ক্রেতার কাছে বিক্রি করেন সে রকম ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষা বিক্রি করেন শিক্ষক। জীবিকার তাড়নায় নিয়তির খেলায় তার পেশার তরী ভিড়েছে শিক্ষকতায়। মাসোহারা নিয়ে অন্য দশটা চাকরির মতো তিনিও শিক্ষকতার চাকরি করেন। তিনি তার নিজস্ব জ্ঞান, আদর্শ বা দর্শন ছাত্রদের মাঝে ভালোবেসে বিতরণ করেন তা নয়। প্রাতিষ্ঠানিক সুনির্দিষ্ট শিক্ষাই তিনি বিক্রি করেন। সব ক্রেতাকে যেমন সেলসম্যান চেনেন না, তেমনি সব ছাত্রকেও শিক্ষক চেনেন না বা জানেন না। কোনো একজন ছাত্র যদি সমাজে কিছূ একটা হয়ে বসে, আর সে ছাত্র যদি স্যারকে সামনে পেয়ে কদমবুচি করে আশীর্বাদ কামনা করে তখন স্যারের বুকটা গর্বে ভরে ওঠে। তারস্বরে চিৎকার করে জগৎকে তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন- আমারই ছাত্র আজ কত বড় হয়েছে দেখ! ছাত্রটিও আবেগে গদগদ হয়ে বহু বছর পর লোক দেখানো মর্যাদার উচ্চাসনে শিক্ষককে মান্যতা দেওয়া শুরু করে শিক্ষাগুরু বলে। অথচ ছোটবেলায় যে দর্জি আব্রু ঢাকার জন্য কাপড় বানিয়ে দিয়েছেন অথবা যে কামলার ঘাম ঝরানো ফসলে ক্ষুধা নিবৃত্ত করেছেন তাদের মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করার কথা কেউ কি কখনো চিন্তা করেছেন? নিশ্চয়ই নয়।

এটাই হলো শিক্ষকের মর্যাদা। যা আমরা যুগ যুগ ধরে শুনে আসছি। প্রিয়নবী মুহাম্মদ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা জ্ঞান অর্জন করো এবং জ্ঞান অর্জনের জন্য আদব-শিষ্টাচার শেখ। এবং যার কাছ থেকে তোমরা জ্ঞান অর্জন করো, তাকে সম্মান করো’ (আল-মুজামুল আওসাত, হাদিস নং : ৬১৮৪)। কবি গোলাম মোস্তফা বলেছেন, ‘সকলের মোরা নয়ন ফুটাই, আলো জ্বালি সব প্রাণে/নব-নব পথ চলিতে শেখাই-জীবনের সন্ধানে/পরের ছেলেরে এমনি করিয়া শেষে/ফিরাইয়া দেই পরকে আবার অকাতরে নিঃশেষে।’ একজন প্রাজ্ঞ, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সত্যিকারভাবে শিক্ষকই সমাজকে বদলে দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারেন। আদর্শ শিক্ষকই শুধু আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করতে পারেন।

এটি বাস্তব সত্য যে, ছোটবেলা থেকেই দিশাহীন-লক্ষ্যহীন অথবা কপট লক্ষ্য নিয়েই চলছে মানুষ। সমাজের বেহাল হলেও এখানেই তৈরি হচ্ছে সব পেশার মানুষ- ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, খেলোয়াড় ইত্যাদি। তারা হচ্ছে কিন্তু হচ্ছে না। তবে কি মানুষের জীবনের কোনো লক্ষ্য থাকার প্রয়োজন নেই? না, ঠিক তা নয়। আবশ্যিকভাবে প্রতিটি মানুষের জীবনের একটা লক্ষ্য থাকা উচিত। শুধু ডাক্তার হওয়া, ইঞ্জিনিয়ার হওয়া বা শিক্ষক হওয়া বা অন্য কোনো পেশার কর্মজীবী হওয়া জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত নয় বরং তার চেয়ে একটু বেশি হওয়া জরুরি। ডাক্তার হলে একজন আদর্শ ডাক্তার হওয়া, শিক্ষক হলে একজন আদর্শ শিক্ষক হওয়া, ব্যবসায়ী হলে একজন আদর্শ ব্যবসায়ী হওয়া, রাজনৈতিক নেতা হলে একজন আদর্শ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হওয়া, একজন শিল্পী হলে আদর্শ শিল্পী হওয়া, একজন খেলোয়াড় হলে আদর্শ খেলোয়াড় হওয়া ইত্যাদি। যে কাজেই নিজেকে নিয়োজিত করেন না কেন, সে কাজকে তিনি যেন প্রার্থনা জ্ঞান করেন। অর্থাৎ যে কর্মে বা পেশায় তিনি নিয়োজিত হবেন তার কর্ম, নীতি-নৈতিকতা ও জীবনাদর্শের দ্বারা তার ব্যক্তিগত ও কর্মময় জীবনকে মুখরিত করে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠাই হলো আসল কথা। সর্বোপরি একজন মানুষের জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত সার্থক মানুষরূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা। আর এ লক্ষ্য নির্ধারণের পরিবেশ তৈরি করা এবং ছাত্রদের উদ্বুদ্ধ করাই হলো আদর্শ শিক্ষকদের মহান কাজ।


শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ : সচিব, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ