স্বৈরাচার প্রতিরোধেই ভালোবাসা

প্রভাষ আমিন
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
স্বৈরাচার প্রতিরোধেই ভালোবাসা

১৪ ফেব্রুয়ারি দিনটি অন্যরকম এক উৎসবের প্রাণ নিয়ে আসে বাংলাদেশে। পহেলা ফাল্গুন আর বিশ্ব ভালোবাসা দিবস এখন মিলেমিশে একাকার। সকালে বাসা থেকে বেরোতেই মন ভালো হয়ে গেল। চারদিকে রঙের বাহার। কেউ বাসন্তী রঙের পোশাক, কেউ ভালোবাসার লাল রঙের পোশাকে সাজিয়েছেন নিজেকে। কারও হাতে, কারও মাথায়, কারও খোঁপায় ফুল। উজ্জ্বল, উচ্ছল, রঙিন তরুণ-তরুণীদের দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বইমেলা, বাণিজ্যমেলা, রবীন্দ্রসরোবর সবখানেই যেন ভালোবাসার জোয়ার, রঙের মেলা বসেছে। পহেলা ফাল্গুন বসন্তের আগমনী বারতা নিয়ে আসে। শুধু মানুষের মনে বা পোশাকে উৎসবের রঙ লাগে যেন প্রকৃতিতেও। শীতের জড়তা কাটিয়ে প্রকৃতি জেগে ওঠে নতুন প্রাণ, শিমুল-পলাশে রঙের আগুন লাগে। এক সময় পহেলা ফাল্গুন আসত ১৫ ফেব্রুয়ারি। ক্যালেন্ডার পাল্টে আমরা সেটি ১৪ ফেব্রুয়ারিতে নিয়ে এসেছি। আর ১৯৯৩ সাল থেকে বাংলাদেশে ১৪ ফেব্রুয়ারি পালিত হচ্ছে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস হিসেবে। এই ধন্যবাদটা পাবেন সাংবাদিক শফিক রেহমান। পাশ্চাত্যে অনেকদিন ধরে চলে আসা ভ্যালেন্টাইন ডে’কে বাংলাদেশে ‘বিশ্ব ভালোবাসা দিবস’ হিসেবে প্রচলন করার কৃতিত্বটা তার। এই দিবস সংস্কৃতির সঙ্গে যতটা না আবেগের যোগ, তার চেয়েও বেশি বাণিজ্যের বসতি। ভালোবাসা দিবসে বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি টাকার কার্ড, ফুল, গিফট কেনাবেচা হয়। বাংলাদেশের যশোরের গদখালীর পাইকারি বাজারেই কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়। ভালোবাসা দিবসের সঙ্গে পহেলা ফাল্গুন যোগ হয়ে উৎসবের রঙ দ্বিগুণ হয়েছে, বেড়েছে বাণিজ্যও। প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের দুই সংস্কৃতি মিলে গেছে এক মোহনায়।

শফিক রেহমান ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশে ভালোবাসা দিবসের প্রচলন করেন। কিন্তু তার আগে কি আমরা ভালোবাসিনি? ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবস মানে কিন্তু এই নয় যে, শুধু এই দিনেই ভালোবাসতে হবে। প্রিয়জনকে ভালোবাসতে হবে প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে। তার পরও আমি ‘ভালোবাসা দিবস’ পালনের বিরোধী নই। ভালোবাসা দিবসে একটু আদিখ্যেতা করতে আমার ভালোই লাগে।

কিন্তু ভালোবাসা দিবস আর পহেলা ফাল্গুনের মিলিত উৎসবের আড়ালে হারিয়ে গেছে আমাদের একটা বড় অর্জন। ’৯৩ সালে ‘ভালোবাসা দিবস’ এসে ভাসিয়ে নিয়েছে আমাদের এক গৌরবকে। ১৯৮৩ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ১৪ ফেব্রুয়ারি পালিত হতো স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসেবে, তখনো ভালোবাসা দিবস আসেনি, ফাল্গুনও আসত একদিন পর। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে সেনাপ্রধান এরশাদ। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে টুকটাক প্রতিবাদ হলেও প্রথম বড় প্রতিরোধ হয় ১৯৮৩ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে। মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাতিল এবং সামরিক শাসনের প্রতিবাদে ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি শিক্ষাভবন ঘেরাও কর্মসূচি দেয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের বিশাল মিছিল সচিবালয়ের দিকে রওনা হয়। শিক্ষাভবনের সামনে গেলে পুলিশ গুলি চালায়। তাতে শহীদ হন জাফর, জয়নাল, দিপালী সাহাসহ আরও অনেকে। অনেকের মরদেহ গায়েব করে দেয় পুলিশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে চলে পুলিশের তাণ্ডব। এই খবর ছড়িয়ে পড়লে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এরশাদ সরকার নিষ্ঠুরভাবে দমন করে সে বিক্ষোভ। তবে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সে প্রতিরোধ ছাত্র-জনতাকে সাহস জুগিয়েছে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে দীর্ঘ আন্দোলনে, যা শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছে ১৯৯০ সালে।

আমাদের প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি বা দেখলেও বয়সের কারণে অংশ নিতে পারেনি। আমরা আমাদের যৌবনকে মহিমান্বিত করেছি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে। সংগ্রাম করে আমরা স্বৈরাচারকে হটিয়েছি, গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করেছি। কিন্তু গণতন্ত্র ঠিক পথে চলেনি। স্বৈরাচার এরশাদ এক সময় আওয়ামী লীগ-বিএনপির সঙ্গে জোট করে রাজনীতিতে নিজেদের জায়েজ করে নিয়েছে। স্বৈরাচারের দল আজ ক্ষমতাসীনদের জোটসঙ্গী। আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতায় জাতীয় পার্টি আজ গৃহপালিত বিরোধী দল। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর রাজপথে শহীদ হন নূর হোসেন। তিনি বুকে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’, পিঠে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ স্লোগান লিখে জীবন্ত পোস্টার হয়ে রাজপথে নেমে পুলিশের সহজ টার্গেটে পরিণত হয়েছিলেন। নূর হোসেনদের আত্মত্যাগে স্বৈরাচার নিপাত গেলেও গণতন্ত্র অজও পুরোপুরি মুক্তি পায়নি। একটি কার্যকর ও অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের আকাক্সক্ষা আজও মানুষকে তাড়িত করে।

নতুন প্রজন্ম আজ ভুলে গেছে পূর্বসূরিদের সেই গৌরব। তারা আজ ভালোবাসায় মশগুল, ফাল্গুনের রঙে রঙিন। এই ফাল্গুন একদিন রাঙানো ছিল শহীদের তাজা রক্তে। হেলাল হাফিজ যেমন লিখেছিলেন ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, কোনো কোনো প্রেম আছে প্রেমিককে খুনি হতে হয়।’ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে একটি প্রজন্ম নিজেদের যৌবন উৎসর্গ করেছিল। ভালোবাসা দিবস নিয়ে আদিখ্যেতা দেখে তখনকার একজন ছাত্রনেতা আক্ষেপ করে বললেন, ‘তখন আমাদের ভালোবাসা ছিল আন্দোলন, সংগ্রাম, মিছিলে মিছিলে।’

আমরা ভালোবাসা দিবস পালন করব, ফাল্গুনকে বরণ করব রঙে রঙে, উৎসবের ডালি সাজিয়ে। তবু আমরা যেন ভুলে না যাই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সেই দিনটিকে। আমরা যেন ভালোবাসি আমাদের গৌরবকেও।


প্রভাষ আমিন : বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ