চট্টগ্রামে নগরবাসীর চাওয়া

সফিক চৌধুরী
০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
চট্টগ্রামে নগরবাসীর চাওয়া

পাহাড়-নদী-সমুদ্রবেষ্টিত অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত হওয়া সত্ত্বেও বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম আজ অনেকটাই বেহাল। একটি শহরের গড়ে ওঠা যেমন তার অধিবাসীদের জন্য অপার সম্ভাবনা আর সুযোগ তৈরি করতে পারে, ঠিক তেমনি অপরিকল্পিত ও উদ্দেশ্যহীন বিন্যাস যে সেই শহরের নগরজীবনকে দুর্বিষহ ও বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ যেন চট্টগ্রাম। একটি শহরের পরিকল্পিত গড়ন ও বিন্যাস এর নাগরিকের প্রতিদিনের নগরজীবনকে প্রভাবিত করে। একটি শহর গড়ে তুলতে হয় তার সামাজিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতার পাশাপাশি ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক অবস্থানকে মাথায় রেখে, সেই সঙ্গে বিশ্বের সমৃদ্ধ ও আধুনিক নগরগুলোর ধ্যান-ধারণাকেও জানতে হয়, তবেই একটি নগর নাগরিকের বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, এই নগরী আদৌ সেভাবে গড়ে উঠতে পারেনি।

চট্টগ্রামের নাগরিকরা দেখছে, তাদের প্রিয় শহর আজ অনেকটাই বিবর্ণ। একটি শহরের সৌন্দর্য, নাগরিকের স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপদ হাঁটার জন্য ফুটপাত একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। শহরের নাগরিক তথা পথচারীদের জন্য সভ্য ও আধুনিক নগরী গড়ে তুলতে চাইলে প্রথমেই তাদের জন্য নিরাপদ ও ঝুঁকিপূর্ণ ফুটপাত নিশ্চিত করা জরুরি। কিন্তু চট্টগ্রাম নগরীতে পথচারীর হাঁটার অধিকার খর্ব করে ফুটপাত দখল যেন চট্টগ্রামবাসীর অলিখিত নিয়তি। নিউমার্কেট, বহদ্দারহাট, চকবাজার, জিইসি, আগ্রাবাদ, ইপিজেড মোড়, আন্দরকিল্লা, আগ্রাবাদ এক্সেস সড়কসহ নগরীর যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ মোড় ও সড়ক তো বটেই, ইদানীং পাড়া-মহল্লার অলিগলিগুলোও ক্রমেই ভ্যান আর হকারে আক্রান্ত। সেই সঙ্গে চট্টগ্রামের প্রধান শেখ মুজিব সড়কের দেওয়ানহাট, চৌমুহনী ও আগ্রাবাদ অংশে ফুটপাত ভাঙা, এবড়ো-থেবড়ো আর যেখানে কিছুটা ভালো তা হকার আর ব্যবসায়ীদের পণ্যে সয়লাব। যা কোনোভাবেই নাগরিকের পায়ে হাঁটার উপযুক্ত নয়। এই সড়কের পাশেই বছর কয়েক আগে নতুনভাবে প্রস্তুতকৃত আগ্রাবাদ এক্সেস সড়কের প্রায় পুরো দেড় কিলোমিটার সড়কের এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত ফুটপাতে তো বটেই, কোথাও কোথাও রাস্তায় পর্যন্ত কাঁচাবাজার, নিত্যব্যবহার্য জিনিস থেকে শুরু করে শখের আসবাব, ব্যক্তিগত গাড়ি মেরামতসহ এমন সবকিছুই চলছে নির্বিঘ্নে! শহরজুড়ে এখন বাজার। কিন্তু এগুলো দেখার যেন কেউ নেই। এমন পরিস্থিতিতে অভাগা পথচারীরা বিশেষ করে নারীরা হাঁটার পথ না পেয়ে যাতায়াতের জন্য স্বল্প দূরত্বেও রিকশাসহ অন্যান্য যানবাহনে চড়তে বাধ্য হচ্ছে, যা একই সঙ্গে তাদের রোজকার বাড়তি খরচের সঙ্গে হাঁটার ব্যায়ামকেও ব্যাহত করছে। এখন প্রশ্ন এসে যায়, তা হলে এই যে নগরীর বিভিন্ন রাস্তা চওড়া ও মসৃণ হলো, সেই সঙ্গে কোথাও কোথাও প্রশস্ত ফুটপাতও তৈরি হলো, তাতে আদতে কার লাভ হলো? প্রশ্ন এসে যায়, ফুটপাতে আদৌ হকার বসবে কেন? এসব প্রশ্নের একটি জবাব হতে পারে, এই সবকিছুই আমাদের দীর্ঘদিনের প্রায় প্রতিটা ক্ষেত্রে জবাবদিহিতাহীন সংস্কৃতিরই ফল।

শহরের পরিসরে ধনী-গরিব নির্বিশেষে সব নাগরিকেরই সমান অধিকার, নিম্নবিত্তের জীবিকা অর্জনের গুরুত্বও অনস্বীকার্য। যথাযথ কর্তৃপক্ষ সে দায়িত্ব কীভাবে পালন করবে তা রাজনৈতিক বিবেচনার বিষয়। কিন্তু ফুটপাত দখল করে, নাগরিকের হাঁটার অধিকার ক্ষুণ্ন করে ব্যবসা করার সুযোগ কারও নেই। বছরখানেক আগে দেখেছিলাম, চট্টগ্রামের মেয়রের উদ্যোগে সড়ক-ফুটপাত থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ এবং দখলমুক্ত করতে স্ট্রাইকিং ফোর্স নামিয়েছিল সিটি করপোরেশন। উদ্যোগটি নিঃসন্দেহে ভালো। তাতে সে সময়ে প্রথম দিকে তাদের কর্মতৎপরতা চোখে পড়লেও এখন নগরজুড়ে ফুটপাত ছাপিয়ে অনেক সড়কও হকার, ব্যক্তিগত গাড়ি মেরামত আর ভ্যানের দখলে। এ রকম নানা উদ্যোগে সাময়িক কিছু সুফল হয়তো মেলে। কিন্তু যদি সুশাসন, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা না যায়, সেই সঙ্গে নগরের সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে যদি কাজের কোনো সমন্বয় না থাকে, তা হলে এমন উদ্যোগে সাময়িক হাততালিই হয়তো মিলবে, কিন্তু দিনশেষে সমন্বিত ও টেকসই উন্নয়ন হবে সুদূরপরাহত। আশা করি, কর্তৃপক্ষ তা উপলব্ধি করবে এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমন্বয়ের মাধ্যমে জবাবদিহিতার আওতায় এনে নাগরিকের কাছে জনবান্ধব করে তুলতে সচেষ্ট হবে।

চট্টগ্রাম মহানগরীর প্রায় ক্ষেত্রেই নানা অনাচার আর অনিয়ম, একমুখী সড়কে উল্টোপথে রিকশা, ব্যক্তিগত গাড়ি চলে ইচ্ছেমতো, প্রধান সড়কের মোড়গুলোর চারপাশ দখল করে দাঁড়িয়ে থাকে এলোমেলো রিকশা, পাবলিক পরিবহন, রাইডশেয়ারের হোন্ডা আর ভ্যানগাড়ি, যেন এমনই নিয়ম! এ ছাড়া চট্টগ্রাম মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিয়ে এত জল ঘোলা হয়েছে, তাই সে কথা এখানে আর নাই বা বললাম। সেই সঙ্গে নগরীর বেশিরভাগ উন্মুক্ত নালায় পড়ে প্রাণ হারানোর শঙ্কা আছে এখানকার নাগরিকদের। এই অনাচার-অনিয়মের দায়ভার কার? নাগরিকের জন্য পরিকল্পিত নগরী গড়বে কে? এসব প্রশ্নের পাশাপাশি নাগরিক হিসেবে আমরাও কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারি না। কারণ একটা শহর তখনই সত্যিকার নগর হয়ে ওঠে যখন সেখানে বসবাসরত লোকজন সেই নগরের আইন ও নিয়মকানুন সম্পর্কে সচেতন থাকেন এবং তার জন্য পালনীয় দায়িত্ব বা কর্তব্য সঠিকভাবে মেনে চলেন।

বছর কয়েক আগে অযত্ন আর অবহেলায় দর্শনার্থী হারাতে বসা পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতকে বিশ্বমানের পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে প্রায় শত কোটি টাকা ব্যয়ে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করেছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। সমুদ্রের ঢেউয়ের আদলে তিন স্তরে করা হয়েছে সৈকত পাড়ের ডিজাইন। তৈরি করা হয়েছে ওয়াকওয়ে, লিংক রোড ও এর সৌন্দর্যবর্ধনে ফুলগাছ ও বিশ্রামের চেয়ার। কিন্তু ওয়াকওয়েসহ পুরো সৈকতের বেশিরভাগ অংশই এখন হকারের দখলে, অনেক জায়গায় সৌরবিদ্যুতের পোল আছে, কিন্তু লাইট নেই। সৈকতজুড়ে যেন নিয়ম না মানার এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা আর সৈকত হারিয়েছে তার বর্ণিল রূপ।

পরিকল্পিত নগরীর কথা আমরা বলি, কিন্তু সেই মতো পরিকল্পনা কী আমরা করি? চট্টগ্রামে এখন অনেকগুলো উড়ালসড়ক, যদিও সেগুলো প্রায়ই থাকে ফাঁকা! আমাদের অনেকগুলো সড়কে যানজট এড়াতে মোড়গুলো বন্ধ করে একমুখী করা হয়েছে, কিন্তু পথচলতি মানুষের রাস্তা পারাপারে কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি! তাতে পথচলতি মানুষজন বাধ্য হয়ে ঝুঁকি নিয়ে এলোপাতাড়ি রাস্তা পার হতে গিয়ে যানজটের সৃষ্টি করছে।

আমাদের গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে, নগর উন্নয়ন ও পরিকল্পনা কারও একার পক্ষে সম্ভব নয়। ভবিষ্যৎ নগরীকে আমরা কীভাবে দেখতে চাই, তার লক্ষ্যে বিভিন্ন সেবা সংস্থা ও সেক্টরের মধ্যে সমন্বয় সাধন হতে হবে। দেখা যায়, সিটি করপোরেশনকে পাশ কাটিয়ে সিডিএ বা অন্য কোনো সংস্থা প্রণীত ও বাস্তবায়িত পরিকল্পনার দায়-দায়িত্ব দিনশেষে সিটি করপোরেশনের ওপর বর্তায় বটে, কিন্তু সেসব পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্টতা থাকে না বলে এ ব্যাপারে অনেক ক্ষেত্রেই তারা উদাসীন থাকে। এর ভোগান্তি ভুগতে হয় সাধারণ নগরবাসীকে। শহরের উন্নয়নে আমরা নাগরিকের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করতে পারি না বলেই নাগরিকও থাকে নির্লিপ্ত। পরিশেষে বলতে চাই, বাণিজ্যিক রাজধানীকে সামগ্রিক উন্নয়নের ধারায় এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে আমাদের এখনই উদ্যোগী হতে হবে। দিনশেষে, এই শহর আমাদেরই। আমাদের সুখ-দুঃখের আশ্রয়। শত কষ্টে আর না পাওয়ার বেদনাতেও কাজের শেষে সে আমাদের টেনে নেয় ভালো লাগার এক আবেশে। তাই আমরাও স্বপ্ন বুনি, প্রিয় শহর চট্টগ্রাম হয়ে উঠবে পরিকল্পিত, আধুনিক ও বাসযোগ্য।


সফিক চৌধুরী : লেখক ও বিতার্কিক