গড়ে উঠুক ভোক্তার সিন্ডিকেট
‘চালের সিন্ডিকেট ভাঙবে কে/ পলিথিনের সিন্ডিকেটে মালিকের সঙ্গে কে নেই!/নিত্যপণ্যের ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভাঙবে কে?/এই মহালুটপাটের কোনো প্রতিকার নেই/ আলু-পেঁয়াজ ডিমের সরকার নির্ধারিত মূল্য কাগজ-কলমে .../ পাঠক এটা কয়েকটি দৈনিকের হেডলাইন। এসব হেডলাইনের একটিই অর্থ- সব জায়গা সিন্ডিকেটের খপ্পরে আটকা। মূলত বলা যায়- সিন্ডিকেটে আটকা বাংলাদেশ।
এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে অস্বস্তির জায়গার নাম বাজার। কী গরিব, কী নিম্নবিত্ত, কী মধ্যবিত্তÑ সবার কাছেই একটি দীর্ঘশ্বাসের নাম দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। যে বাজারেই যাই, যে পণ্যের দিকেই তাকাই, সবকিছুর দাম ঊর্ধ্বমুখী এবং অসহনীয়।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে বর্তমানে একটি বড় সংকট। কোনো একটি পণ্যের দাম বাড়লে ধারাবাহিকভাবে অন্য সব পণ্যের দাম বাড়তে থাকে। শুধু নিত্যপণ্যের নয়, কোম্পানিগুলোও দাম বাড়ানোর মিছিলে যোগ দেয়। কিছু ক্ষেত্রে যৌক্তিক কারণ থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দাম বাড়ে সিন্ডিকেটের কারণে। সিন্ডিকেট ভাঙতে দেশে শক্তিশালী কোনো আইন নেই। পণ্যের উচ্চমূল্য শুধু বাহ্যিক বা আন্তর্জাতিক বাজারের কারণেই নয়, এর পেছনে আছে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের অভাব, সিন্ডিকেশন, প্রয়োজনীয় মনিটরিং না থাকা ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব। বাজারে সংঘটিত এসব অপরাধ প্রতিরোধে আইনের বড় দুর্বলতাও রয়েছে। আবার কিছু অপরাধের ক্ষেত্রে দণ্ডের পরিমাণও খুব নগণ্য। যে কারণে বেপরোয়া মনোভাব ব্যবসায়ীদের। সিন্ডিকেট গড়ে লুটে নেওয়া হচ্ছে অর্থ, যার মাসুল গুনতে হচ্ছে ভোক্তাদের। বর্তমান আইনে কারসাজি করে কোনো পণ্য বেশি দামে বিক্রি করা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯-এর লঙ্ঘন। ভোক্তা অধিকার আইনে প্রশাসনিক ক্ষমতা দেওয়া আছে, তবে মামলা করার ক্ষমতা নেই। ফলে প্রশাসনিক শাস্তি হিসেবে সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা জরিমানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। বাজার তদারকিতে ভোক্তা অধিকার আইনের আওতায় তৎপরতা সবচেয়ে বেশি হলেও এ আইনে বিচার শেষে সাজা হয়েছে, এমন উদাহরণ কম। কোনো পণ্য অধিক দামে বিক্রির প্রমাণ মিললে এক-দুই হাজার টাকা জরিমানা করে ছেড়ে দেওয়া হয়। ওই পরিমাণ জরিমানা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীর কিছু সময়ের অবৈধ মুনাফার সমান। এছাড়া আইনের অন্য ধারারও প্রয়োগ নেই বললেই চলে।
একটি বাজার অর্থনীতির কার্যকারিতা নির্ভর করে বাজারের চাহিদা-জোগানের নিয়ামকগুলোর মুক্ত, স্বাভাবিক ও প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করার ক্ষমতার ওপর। কিন্তু বাজারবহির্ভূত উপাদানগুলো অনেক ক্ষেত্রে বাজারের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। ধনতান্ত্রিক অর্থনীতিকে মুক্তবাজার অর্থনীতি বলে। এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় দ্রব্যের উৎপাদন, বণ্টন, ভোগ সবই বাজারে দ্রব্যের চাহিদা ও জোগানের পারস্পরিক ক্রিয়া-বিক্রিয়া দ্বারা পরিচালিত হয়। মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সম্পদের ব্যক্তিমালিকানা এবং উৎপাদন ও ভোগের ক্ষেত্রে ব্যক্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা। সম্প্রতি গরুর মাংসের দাম নিয়ে ব্যবসায়ীরা সভা করেছেন বলে জানান মাংস ব্যবসায়ী সমিতি। সভায় সিদ্ধান্ত হয় সরকার নির্ধারিত দাম রাখা যাবে না। কারণ এতে ব্যবসায়ীদের লোকসান হচ্ছে। তাই সিদ্ধান্ত হয়, এখন থেকে বাজারের চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে মাংসের দাম নির্ধারিত হবে। বর্তমান বাজার বিবেচনায় ৭০০ টাকা কেজি বিক্রি হবে। এরপর গরুর মাংসের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা পর্যন্ত। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পর্যবেক্ষণও বলছে, মাসের ব্যবধানে গরুর মাংসের দাম ১০ শতাংশ বেড়েছে।
কোনো কোনো বিক্রেতা ৬৫০ টাকায় বিক্রি করছেন। কম দামে বিক্রি করায় অন্যদের আক্রোশের শিকার হতে হচ্ছে বলে জানান অনেক ব্যবসায়ী। এর মধ্যে রয়েছেন মাংস বিক্রেতা খলিল। তিনি গণমাধ্যমকে বলেছেন, তিনি ৬৫০ টাকায় গরুর মাংস বিক্রি করছেন। কিন্তু কম দামে বিক্রি করায় তাকে ও তার ছেলেকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। নিরাপত্তার শঙ্কায় রাজধানীর শাহজাহানপুর থানায় তিনি জিডি করেন। খলিল বলেন, ‘তিন দিন আগেও ফোনে হুমকি পেয়েছি। অনেক আতঙ্কে আছি।’ এদিকে কম দামে মাংস বিক্রি করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি ছুরিকাঘাতে রাজশাহীর বাঘা উপজেলায় মামুন নামে এক ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য এমনই। সরকারের বেঁধে দেওয়া দাম চ্যালেঞ্জ করে তারা নিজেরা খেয়ালখুশি মতো চলছে। রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধাভোগী এসব নাগরিক আদৌ কি নাগরিক-সুবিধা পাওয়ার দাবি রাখে?
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
অধ্যাপক ম্যাংকিউ সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি উপদেশ দিয়ে লাগামহীন বাজার অর্থনীতির বিকাশ ঘটিয়ে ধনিক শ্রেণির দ্রুত সম্পদ বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছেন, যা শেষতক জাতিকে সংকটাপন্ন করে। তার অণুমাত্রিক বা মাইক্রো অর্থনীতির বইয়ে এ দর্শন দেওয়া হচ্ছে। এক সময় পল স্যামুয়েলসনের বই যেমন বিশ্বে বাজার করেছে, বর্তমানে ম্যাংকিউয়ের বইও অর্থনীতির পাঠ্য হিসেবে সম্ভবত বিশ্বে এক নম্বরে রয়েছে। ম্যাংকিউয়ের মতে, যে কোনো দেশে সরকারের জিনিসপত্রের দাম বেঁধে দেওয়ার কাজটি কখনো অপ্রয়োজনীয়, কখনো অকার্যকর। সে জন্য দাম বেঁধে দেওয়ার কাজ থেকে সরকারের সরে আসা উচিত। এ জাতীয় কাজ কখনো ঘাটতি, কখনো উদ্বৃত্ত সৃষ্টি করে অর্থনীতিতে বিভ্রাট বৃদ্ধি করে।
মূল দর্শন এসেছে অ্যাডাম স্মিথের কাছ থেকে, যিনি বাজারকে সরকারের হস্তক্ষেপমুক্ত রাখতে বলেছেন। তার মতে, মুক্ত চাহিদা ও মুক্ত জোগান বাজারে দ্রব্যসামগ্রীর ন্যায্য দাম ঠিক করে দেবে। সরকার শুধু নৈতিকতার বিষয়টি দেখবে। এখানেই যত গণ্ডগোল। এখন প্রশ্ন এ নৈতিকতার মানদণ্ড কী?
ব্যবসায়ে উচিত-অনুচিত মেনে চলা বা ভালোকে গ্রহণ ও মন্দকে বর্জন করে চলাই হলো ব্যবসায়ের নৈতিকতা। ব্যবসায় সমাজবিজ্ঞানের একটা গুরুত্বপূর্ণ শাখা হওয়ায় এক্ষেত্রে নৈতিকতার বিষয়টি অধিক তাৎপর্যপূর্ণ। মানুষ তার প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবার জন্য ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভরশীল। তাই ব্যবসায়ী যদি উচিত-অনুচিত না মানে, সত্য-মিথ্যার পার্থক্য ভুলে যায়, অস্বাস্থ্যকর পণ্য উৎপাদন ও বিক্রয় করে, পরিবেশ দূষণ করে মূল্যবোধ হারায় তখন ওই সমাজে ব্যবসায় নামক পেশার সম্মান ও মর্যাদা যেমন থাকে না তেমনি সাধারণ মানুষও প্রতারিত হতে হতে ভালো-মন্দ জ্ঞান হারাতে থাকে। তখন সমাজে অনৈতিক পরিস্থিতির জন্ম দেয়।
ব্যবসার ক্ষেত্রে অবশ্য পালনীয় বিষয়গুলো- সব ক্ষেত্রে সততা বজায় রাখা ও নির্ভরতার গুণ অর্জন; শ্রমিক-কর্মীদের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার; পাওনা যথাসময়ে পরিশোধ; প্রতিষ্ঠানের বাইরে বিভিন্ন পক্ষের প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন; স্বগোত্রীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা; পরিবেশ রক্ষায় সাধ্যমতো ভূমিকা রাখা; সরকারি নিয়ম-রীতি মেনে চলা; আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন ইত্যাদি। এছাড়া প্রতারণা, শঠতা ও ধোঁকাবাজির আশ্রয় গ্রহণ না করা; ক্ষতিকর ও বেআইনি পণ্য উৎপাদন বা বিক্রয় না করা; বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি না করা; একচেটিয়া প্রবণতা পরিহার ও মাপে কম না দেওয়া।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
ব্যবসায়ের মানদণ্ডে উপরিউক্ত বিষয়গুলো প্রণিধানযোগ্য। এখানে দেখা যাচ্ছে ব্যবসায়ীরা শুধু সরকারি নিয়মনীতিই ভাঙেন না, দাম্ভিকতার প্রদর্শনীও করে থাকেন। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা বা মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য সম্পদের ব্যক্তিমালিকানা এবং উৎপাদন ও ভোগের ক্ষেত্রে ব্যক্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা বহাল থাকা কি গ্রহণযোগ্য।
সরকারের তরফ থেকে সম্প্রতি গণমাধ্যমকে বলা হয়েছে, সিন্ডিকেটগুলো সব সময় বাজারে কারসাজি করে মূল্যবৃদ্ধির সুযোগ খোঁজে। অবৈধ কারবারিদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনার কাজ চলছে। এক্ষেত্রে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের বাজার তদারকির ক্ষমতা থাকলেও তাদের বিচারিক ক্ষমতা নেই। শুধু জরিমানা করতে পারে।
অধিদপ্তরের বক্তব্য হচ্ছেÑ আমরা কাউকে কারাদণ্ড দিতে পারি না। প্রথম শ্রেণির জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট অথবা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর মামলা করতে হবে। সেখানে কারাদণ্ড হবে। এছাড়া জেলা প্রশাসন থেকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা চাইলে কারাদণ্ড দিতে পারেন। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে বিচারিক ক্ষমতা দিলে ভালো হয়। এখন বাজারে কোথাও সিন্ডিকেট কাজ করছে, কোথাও মুদ্রাস্ফীতির পরিবেশকে কাজে লাগিয়ে অতি মুনাফালোভীদের সক্রিয় করা হয়েছে। ক্রেতা প্রতারণার নানা ক্ষেত্র এখন বাজারে। এসব বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, সরকার নির্ধারিত দামের বেশি বিক্রেতা দাবি করার ক্ষেত্রে কঠোরতর আইন করতে হবে। ভোক্তার কাছেই ক্ষমতা অর্পণ করতে হবে এর বাস্তবায়নের। যৌক্তিক মুনাফা নির্ধারণ করে প্রতিটি পণ্যের দাম নির্দিষ্ট করে ভোক্তাকে অবহিত করতে হবে। সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী ক্রেতা সে দামই পরিশোধ করবে। মুষ্টিমেয় ক্রেতার কাছে জিম্মি নয়, হতে হবে ভোক্তার সিন্ডিকেট। সেই সিন্ডিকেটই পারবে বাজারকে স্থিতিশীল করতে। সেক্ষেত্রে আইনের আরও কার্যকর প্রয়োজন। কঠোর প্রয়োগ প্রয়োজন।
আশরাফুল ইসলাম : আমাদের সময়ের ভারপ্রাপ্ত বার্তা সম্পাদক
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!