শুরু হলো ভাষার মাস

ড. আতিউর রহমান
০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
শুরু হলো ভাষার মাস

আজ থেকে শুরু হলো ভাষার মাস। এই মাস বাঙালির প্রাণের মাস। বিশ্বব্যাপী এই চেতনার বিস্তার ঘটিয়েছে আমাদের অমর একুশে। আজ তাই একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। ডিজিটাল প্রযুক্তির কল্যাণে আজ বাংলা ভাষা বিশ্ব ভাষায় পরিণত হয়েছে। হোয়াটস্অ্যাপ, ভাইবার, ‘এক্স’ (সাবেক ‘টুইটার’), ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম এবং ফেসবুকে আজ বাংলা ভাষার যে বিস্তৃত পদচারণা তা অস্বীকারের উপায় নেই। সারা বিশ্বেই আজ বাঙালির বসবাস। ছোট ছোট বাংলাদেশ আজ লন্ডন, নিউইয়র্ক, সিডনি কিংবা দুবাইতে দেখতে পাই। এসব নগরে বাংলা ভাষা চর্চা ও বাঙালি সংস্কৃতির অনুষ্ঠানমালায় দুই বাংলার বাংলাভাষীদের অংশগ্রহণ প্রমাণ করে মাতৃভাষা কোনো ভৌগোলিক সীমানা মানে না। বিদেশেও নতুন প্রজন্ম মাতৃভাষায় যাতে সংস্কৃতিচর্চা করে তার উদাহরণ এসব বিশ্বনগরীতে আমি নিজ চোখেই দেখেছি। বইমেলাসহ তাদের মাতৃভাষা চর্চার নানা অনুষ্ঠানে আমি অংশগ্রহণ করে বাঙালি হিসেবে গর্ববোধ করেছি। আর প্রযুক্তির গুণে আমরা বিশ্বজুড়ে বাঙালির বাংলা ভাষা ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের চর্চার ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট নিরন্তর খুঁজে পাব। ওটিটিতে দুই বাংলার চলচ্চিত্র ও নাটক যেমন নতুন করে তাদের প্রাধান্য বিস্তার করে চলেছে তাতে এই ভেবে আশান্বিত হই যে, বাঙালির মাতৃভাষাপ্রীতির জয়যাত্রা নতুন সময়ে বরং আরও জোরদার হচ্ছে।

এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুক ভাষার মাসের শুরুর দিনটিতে সেই প্রত্যাশাই করছি। আরও ভালো লাগছে যে, বিশ্বজুড়েই অনলাইনে আমরা বাঙালির সম্মিলিত সাংস্কৃতিক সম্পদ রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, বঙ্গবন্ধু, সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, উত্তম কুমার, সুচিত্রা সেন, তপন সিনহা, গৌতম ঘোষ, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, ঋতুপর্ণ ঘোষ, কবি শাসমুর রাহমান, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসুসহ অসংখ্য নান্দনিক ব্যক্তিত্ব ও কবি-সাহিত্যিকদের সৃষ্টিশীল কর্মের সন্ধান এখন আমরা অনলাইনেও পাচ্ছি। আর সাম্প্রতিক সময়ের শিল্পী-সাহিত্যিক-চলচ্চিত্রকারদের বাংলা ভাষায় অনলাইন মঞ্চে দাপিয়ে বেড়ানোর কথা নাই বা বললাম। বাংলা ভাষাকে ‘ইন্টারঅপারেবল’ ফন্টে অনলাইনে যুক্ত করায় শুধু তরুণদের জন্য নয়, আমাদের মতো বয়সে প্রবীণদেরও বাঙালির সাংস্কৃতিক সম্ভার হাতের মুঠোয় এসে গেছে। তাই মনে প্রশ্ন জাগে, যদি বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে রক্ত না ঝরত, ভাষাশহীদদের অনুপ্রেরণায় যদি স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতার রক্তস্নাত সংগ্রামে আমাদের তরুণরা এগিয়ে না আসত, লাখ লাখ শহীদ যদি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তাজা রক্তে বাংলাদেশের মাটিকে উর্বর না করত, এই আত্মত্যাগের ডাক যদি ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত এবং পরবর্তী সময়ে বায়ান্নর ভাষার লড়াইয়ে বঙ্গবন্ধুও তার সহনেতারা জেল-জুলুম অগ্রাহ্য করে মরণপন্ন নেতৃত্ব না দিতেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণ ফসল বাংলাভাষী আধুনিক এক রাষ্ট্র বাংলাদেশে সৃষ্টি না করতেন তা হলে কী বাংলা ভাষার দেশজ ও বিশ্বব্যাপী এই নান্দনিক চর্চার দুয়ার খুলে যেত? বিশেষ করে বাঙালি জাতির পিতা শ্রেষ্ঠতম বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলা ভাষাপ্রীতি ও বাংলা শিল্প-সাহিত্যের প্রতি গভীর ভালোবাসায় সিক্ত নান্দনিক নেতৃত্বের পরশ বাঙালি না পেত তা হলে কি উদারনৈতিক বাংলাভাষী এই রাষ্ট্রের উদ্ভব সম্ভব ছিল?

এ প্রশ্নগুলো আজকের দিনে তুলছি এ কারণে যে, বঙ্গবন্ধুর সেই নিরন্তর নান্দনিক নেতৃত্বের কথা আমরা এই ভাষার মাসেও কতটাই বা উপলব্ধি করি। তরুণ প্রজন্মের কাছে কী এই নেতৃত্বের মহতী অর্জনের কথা কতটা আন্তরিকতার সঙ্গে বিভাজনে ক্লিষ্ট আজকের বাংলাদেশে তুলে ধরছি? অথচ অস্বীকার করি কী করে যে, বাঙালির জীবনে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন এক কালজয়ী ঘটনা? আমরা এ-ও জানি যে, পূর্ববাংলার মধ্যবিত্ত সন্তানরা বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন মায়ের ভাষার সম্মান রক্ষার জন্য। এবং তারা তা করেছিলেন একটি উদারনৈতিক অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ার আকাক্সক্ষা থেকে। তারা এমন একটি অর্থনীতির প্রত্যাশা করেছিলেন যেখানে কৃষক সন্তানরাও বাংলা ভাষায় শিক্ষা লাভ করতে পারবেন এবং কর্মসংস্থান লাভের সুযোগ পাবেন। একই সঙ্গে একটি ধর্মনিরপেক্ষ স্বদেশ-চিন্তার যুক্তিগ্রাহ্য পটভূমি তৈরির আকাক্সক্ষা তৎকালীন পূর্ববঙ্গে দানা বেঁধে উঠেছিল এই ভাষা আন্দোলনের হাত ধরেই। সেই পটভূমিতেই আসলে দাঁড়িয়ে যায় বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ।

আমাদের গবেষণায় ধরা পড়েছে যে, প্রথমে ভাষা আন্দোলন এবং পরবর্তী সময়ে ৬-দফা অনুপ্রাণিত ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বে অসহযোগ আন্দোলন এবং সর্বশেষ মুক্তিযুদ্ধে কৃষক, শ্রমিক, নিম্নআয়ের কর্মচারী, ছাত্র-শিক্ষক, কবি-সাহিত্যিকসহ মধ্যবিত্তের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছেন, অঙ্গ হারিয়েছেন, সম্ভ্রম হারিয়েছেন তারাও ছিলেন কৃষক-শ্রমিক ও মধ্যবিত্তের সন্তান। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের এরা ছিলেন সমশ্রেণির সহযাত্রী। আকাক্সক্ষার সম্মিলন ঘটায় মুক্তিযুদ্ধে যারা বিপুলভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের শ্রেণি বিন্যাসের সঙ্গে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের দারুণ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। উভয় আন্দোলনের অংশগ্রহণকারীদের প্রত্যাশা ছিল তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ীই স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান ও উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি হবে। অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, জাতির পিতার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে ১৯৭২ সালের সংবিধান এবং প্রথম পঞ্চবার্ষিকীর (১৯৭৩-৭৮) মূল লক্ষ্য ছিল তাদের ওই প্রত্যাশা পূরণের চমৎকার দুই দলিল। সাধারণ মানুষের বহুমাত্রিক অধিকার নিশ্চিত করার যে দলিল সংবিধানের অবয়বে তৈরি করা হয়েছিল তা ছিল সার্বিক মুক্তির দলিল। অর্থনীতি-সমাজ-রাজনীতি ও সংস্কৃতির চৌহদ্দিতে মনুষ্যত্বের গৌরব অর্জনের সেই স্বাধীনতা বাস্তবে কী করে অর্জন করা সম্ভব তার রূপরেখা দেওয়া হয়েছিল প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায়। ওই পরিকল্পনায় মোট বিনিয়োগের সর্বোচ্চ বরাদ্দ ২৪ শতাংশ কৃষি খাতের জন্য দেওয়া হয়েছিল। এর পরের বরাদ্দ ছিল শিল্প, অবকাঠামো এবং শিক্ষা খাতে। ভাষা আন্দোলনের বিস্তৃত অর্থনৈতিক পটভূমিতে বিকাশিত বাঙালির সংস্কৃতি ও রাষ্ট্র স্বপ্নের পূর্ণ বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধুর সরকার সীমিত সম্পদ সত্ত্বেও মূলত ‘মাটি ও মানুষে’র ওপর ভরসা করে অর্ন্তভুক্তিমূলক উন্নয়নের রূপরেখা এঁকেছিলেন প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায়। তার স্বপ্ন ছিল মাতৃভাষার মর্যাদার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত মানবসম্পদ উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সংস্কৃতির কাক্সিক্ষত রূপান্তর। ভূমিসংস্কার ও আধুনিকায়নের মাধ্যমে খাদ্যোৎপাদন বাড়িয়ে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের গ্লানি থেকে সাধারণ মানুষকে মুক্তি দেওয়ার পাশাপাশি তিনি কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের চাওয়ামতো শিক্ষা সংস্কারেও ব্রতী হয়েছিলেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরেই বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রসার ঘটেছিল আড়াইগুণ। মাথাপিছু আয় বেড়েছিল তিনগুণের মতো। সারা বিশ্বের সঙ্গে তিনি মর্যাদার সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। শিক্ষা ও রাষ্ট্রের ভাষা বাংলায় রূপান্তরে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিলেন। এমনকি বিচারিক ভাষাকেও বাংলা করতে চেয়েছিলেন।

কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য, বঙ্গবন্ধুর দেখানো সেই স্বপ্নযাত্রা বিশ্বাসঘাতকদের হস্তক্ষেপে হঠাৎ করেই থেমে যায়। আর এর পরের দুঃখ-ভারাক্রান্ত স্বদেশের ‘উল্টো পথে’ হাঁটার কথাও আমরা জানি। অনেক চড়াই-উৎরাইয়ের পর বাংলাদেশ ফের হাঁটছে সমৃদ্ধির পথে। রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা ছাড়াও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জও কম নয় আজকের চলার পথেও। আমরা এখন ফের এক অস্থির সময়ের মুখোমুখি। দীর্ঘদিন পরে বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুকন্যার হাত ধরে মুক্তিযুদ্ধের চাওয়া-পাওয়ার আদলে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের পথে ফিরলেও সেই পথে এখনো হাজারো পাথর বিছানো। অর্থনৈতিক বৈষম্য, কতিপয়তন্ত্রের ‘পোয়াবারো’, দুর্নীতির কালোছায়া, ন্যায়ভিত্তিক শাসনের চ্যালেঞ্জ, সর্বগ্রাসী বিদেশি ভাষা ও সংস্কৃতিপ্রীতি ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে প্রায়ই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। তদুপরি উচ্চ মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের মনে অশান্তি ও হতাশা দানা বাঁধাতে বেশ খানিকটা ইন্ধন জোগাচ্ছে বলে মনে হয়। এই হতাশা ও অশান্তি দূর করতে হলে আমাদের অবশ্যই ফিরে যেতে হবে ইতিহাসের দোরগোড়ায়। প্রচলিত উন্নয়ন প্রচেষ্টাকে ঐতিহ্য, জাতীয় অর্জন ও আত্মমর্যাদা-আশ্রিত করতে হলে আমাদের ইতিহাসের দায়কে হৃদয়ে ধারণ করতে হবে। আর বাঙালির ইতিহাসের বড় মাইলফলক হচ্ছে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ। আর সেজন্যই বলতে চাই যে, বাংলাদেশে ইতিহাসও হতে পারে উন্নয়নের এক বড় উপকরণ। কেননা আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য মানুষের সাম্যের কথা বলে। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সিক্ত এই ইতিহাসের গৌরবগাথা মানুষকে দুঃখের দিনে এক হওয়ার অভিজ্ঞতার কথা বলে। এই ইতিহাস মানুষকে এক হওয়ার প্রেরণা দেয়। আর সম্মিলিত মানুষমাত্রই সৃজনশীল মানুষ। আর নিরন্তর সৃজনশীলতাই কাঙ্ক্ষিত অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের ক্ষেত্রকে আরও প্রসারিত করে। এটিই হতে হবে আমাদের দেশের উন্নয়নের মূল কথা। আখেরে উন্নয়ন সব মানুষের। একুশ ও একাত্তরের চাওয়াও তাই।


ড. আতিউর রহমান : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর