দ্বাদশ নির্বাচন ও ভবিষ্যতের রাজনীতি
৭ জানুয়ারি ২০২৪-এ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বহু নাটকীয়তা আর তর্ক-বিতর্ক, বিদেশের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর হুমকি-ধমকির মধ্যেও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। যত রকমের বাধাবিপত্তি থাকুক না কেন অতীত পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, কোনো দল ক্ষমতায় থাকলে যত বিরোধিতাই হোক দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলে নির্বাচন প্রতিহত করা সম্ভব হয়নি। যেমন সম্ভব হয়নি ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে অন্যান্য বড় দলের বিরোধিতা সত্ত্বেও নির্বাচন ঠেকানো যায়নি। মাত্র ২১% ভোটার ভোট দিয়েছিল। যদিও অল্প কয়েকটি দলই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল। সংসদে কথিত দুটি দলই ছিল। এর পরে ২০১৪ সালেও বৃহত্তর বিরোধী দলগুলো বিরোধিতা করলেও নির্বাচন ঠেকানো যায়নি।
নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এবারও। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ৭ জানুয়ারি ২০২৪। যদিও বৃহৎ ও ক্ষুদ্র দলগুলো প্রায় ৪ বছর ক্রমান্বয়ে জোরালো আন্দোলন করেও নির্বাচন ঠেকাতে পারেনি বরং বৃহৎ বিরোধী দল বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মী জেলে অবস্থান করছে এবং অন্যদিকে হাজার হাজার কর্মী পলাতক রয়েছে। সরকারি ও তাদের কথিত অনুযোগীরা এক প্রকার নির্বিঘ্নে নির্বাচনের প্রক্রিয়া সমাপ্ত করে সরকার গঠন করে ফেলেছে। তবে এবার শুধু পার্শ্ববর্তী দেশের আকাক্সক্ষাই নয় বিশ্বের পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের হুমকি-ধমকিও ছিল প্রাণিধানযোগ্য। অনেক ধরনের শঙ্কা সত্ত্বেও পরিপূর্ণ রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও রাষ্ট্রীয় যন্ত্র ব্যবহার করে একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। একটানা ১৫ বছর কাটিয়ে ২০ বছর পূর্ণ করতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকার শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে। যেহেতু বিশ্বের তিনটি বৃহৎ শক্তি প্রথম হতেই এই সরকারের বিগত দুই নির্বাচন- ২০১৪ ও ২০১৮ কে সর্বতো ত্বরিত স্বীকৃতিতে দেরি করেনি এবারও অনেক সমস্যাসংকুল নির্বাচন হলেও পূর্বতন ধারা বজায় রেখেছে।
এবারের নির্বাচন ২০১৪, যাকে ভোটারবিহীন নির্বাচন বলা হয় কারণ ৩০০ আসনের ১৫৩টি আসন বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়। বিশে^র গবেষকরা এই নির্বাচনকে ব্যর্থ আখ্যায়িত করলেও সরকার পূর্ণ মেয়াদে দেশ পরিচালনা করেছে। ওই নির্বাচন বিরোধীরা কথিত সহিংস আন্দোলনের মধ্য প্রতিহত করার চেষ্টা করেও ঠেকাতে পারেনি। অবশ্য ওই নির্বাচন যে সুষ্ঠু হয়নি তা এখন সরেজমিনে প্রমাণ করার প্রয়োজন নেই। ওই নির্বাচন হয়েছে দিনে-রাতের মিশ্রণে যা এখন সরকারি দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ হতে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের মুখেও চর্চিত। অবশ্য এবারের নির্বাচন ও প্রধান বিরোধী দল এবং সমমনা দল বিবর্জিত তাই এবার নির্বাচনের ভিন্ন আঙ্গিক প্রত্যক্ষ করা গিয়েছে। এবারের নির্বাচনের ধরন (মডেল) আগের দুটির ধারেকাছেও নেই। প্রচুর নতুনত্বের মধ্যে বাংলাদেশে এই ধরনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো, যা মোটামুটি একদলীয়ই বলা যায়।
এবার বিরোধী দলসহ বহু দল, বলতে গেলে ২৬টির কাছাকাছি নিবন্ধিত এবং প্রায় সমসংখ্যক অনিবন্ধিত নতুন অথচ ইতোমধ্যেই বেশ পরিচিত হয়ে ওঠা দলগুলো নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে বৃহত্তর বিরোধীদের সাথে সংঘবদ্ধ হয়েছিল। তথাপি সরকার সমস্ত শক্তি নিয়োগ করে নির্বাচন সম্পন্ন করেছে। নির্বাচন বন্ধ, পেছানো অথবা বিরোধী দলকে ন্যূনতম ছাড় না দিয়ে নির্বাচন সম্পন্ন হয়। বলতেই হবে অনেকটা নির্বিঘ্নে, ২০১৪ সালের মতো তেমন পরিস্থিতি হয়নি।
অবশ্য এবারের নির্বাচন, নির্বাচনপরবর্তী পরিবেশ এবং এ নির্বাচনের মডেলের সুদূরপ্রসারী প্রভাবের কিছু বিষয় আলোচনার দাবি রাখে। প্রথমত এই নির্বাচনটি বলা যেতে পারে একপাক্ষিক, যদিও কাগজে-কলমে ২৮টি নিবিন্ধত দল, যার মধ্যে বেশ কয়েকটি দৃশ্যত ফরমায়েশি দলও রয়েছে, অংশগ্রহণ করে। তবে সরকারি দল আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় পার্টিই প্রধান। যদিও জাতীয় পার্টিও প্রায় বিলুপ্তির পথে, আর কোনো দলকে ধর্তব্যের মধ্যে নেওয়া যায়নি। আর ছোট তিনটি দল যেগুলো এত দিন চর্চার মধ্যে ছিল সেগুলোও হয়তো বিলুপ্তির আবর্তে পড়েছে। এর মধ্যে সাম্যবাদী দল, বহু বছর ধরেই মাঠে নেই এবং ওয়ার্কার্স পার্টি যদিও আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় তাদের প্রতীক নিয়ে নিভু নিভু অবস্থায় ছিল। এবারের নির্বাচনে তার অবস্থানের আরও অবনতি হয়েছে। সরকারি দলের প্রতীক নিয়েও বিলুপ্তির পথে তেমনি। বহুল চর্চিত জাসদ এবং এর প্রধান প্রাক্তন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর ভরাডুবির পর অস্তিত্ব সংকটে। আগামীতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে খুঁজেও পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। একমাত্র জাতীয় পার্টি, হাবুডুবু খাবার পথে, ছাড়া এবার অংশগ্রহণকারী আর কোনো পুরাতন দলের অস্তিত্ব নেই যদিও বিগত পনেরো বছর বিরোধী জোটের রাজনীতিতে বিশ্বাসী কল্যাণ পার্টিপ্রধানের উপস্থিতি। এই নির্বাচন বোধকরি একটি বৈচিত্র্যময় বহুদলীয় ব্যবস্থায় একটি নির্বাচন, অনেকটাই একদলীয় আদলে নির্বাচন, কারণ যেসব সাক্ষীগোপালের মতো পার্টি অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল তাদের সাকল্যে প্রদত্ত ভোটের এক শতাংশ পেয়েছে কিনা সন্দেহ রয়েছে। হয়তো পূর্ণাঙ্গ পরিসংখ্যান বের হলে সঠিক চিত্র পাওয়া যাবে। তবে অতীতেও, বিশেষ করে ২০১৮র নির্বাচনেও এরূপ চিত্র পাওয়া যায়। ২০১৮ সালে, যাকে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন বলা যায়, সেখানে ৩৯ দল অংশগ্রহণ করলেও তিনটি দল ৫ শতাংশের উপরে, দুটি ২ শতাংশের নিচে এবং বাকি দলগুলো ১ শতাংশের নিচে ভোট পেয়েছিল। সেসব দলকে জনগণ মনে রেখেছে কিনা সন্দেহ রয়েছে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
২০২৪ সালে বহু বাদ-বিবাদের মধ্যের নির্বাচনের পদ্ধতি ভিন্নতর হলেও দলীয় হিসাব প্রায় একই প্রকার। এবার সরকারি দল ২০১৪-এর অভিজ্ঞতা ঠেকাতে দলীয় নির্ধারিত প্রার্থীর বাইরে দলের বিধিনিষেধ শিথিল করে অংশগ্রহণ উন্মুক্ত করে স্বতন্ত্র এবং কথিত ডামি (যার বাংলা প্রতিরূপ নকল) হিসেবে। সাথে সামান্য পরিচিত ও অপরিচিত কথিত ২৬টি দল (আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি বাদে)। মোট প্রার্থী ছিল ১৯৬৯। এই সংখ্যাটিকে দেখানো হয়েছিল অংশগ্রহণমূলক চিত্র তুলে ধরতে। এর মধ্যে প্রায় ১২৫ জন জাতীয় পার্টি, যারা সরকারি দলের আশ্বস্ত ২৬টি আসনের বাইরে নির্বাচন হতে সরে দাঁড়ায়। এ সংখ্যাসহ ১৪৪১ প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে, যা মনে হয় এ যাবৎ একটি রেকর্ড। এর মানে ৭৩ শতাংশ প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। প্রাপ্ত পরিসংখ্যান মোতাবেক ২৮টি দলের মধ্যে ২১টি দলের সব প্রার্থীই জামানত হারিয়েছে। এটি এ পর্যন্ত বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে রেকর্ড।
এরই প্রেক্ষিতে একক দলের নির্বাচন, অন্তত ফলাফলে তাই বলে, হিসাবে লিপিবদ্ধ থাকবে। প্রাপ্ত ফলাফলে সরকারি দল আওয়ামী লীগ দলের প্রতীকপ্রাপ্ত, বলা যায় দলীয় প্রার্থীদের আসনের মধ্যে ২২৫টি আসন এবং একই দলের কথিত স্বতন্ত্র এবং ডামি প্রার্থীদের ৬১, জাতীয় পার্টি, যদিও ২৬টি আসন সরকারি দল দিয়েছিল, পেয়েছে ১১টি এবং কল্যাণ পার্টি ১টি বাকি দুটি সিটের নির্বাচন স্থগিত। পরে অনুষ্ঠিত হবে।
উপরের তথ্য হতে পরিষ্কার যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদে তিনটি দল, যদি না কল্যাণ পার্টির এক প্রার্থী কোনো দলে যোগ না দেয়, দেখা যাবে তারা সবাই সরকারি দলের অনুকম্পাধীন। বাদবাকি স্বতন্ত্র ৬১ প্রার্থীর প্রায় প্রত্যেকেই সরকারি দলের সদস্য, যদি না তাদের সদস্যপদ কোনো পর্যায়ে আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের ৪৭ ধারা অনুযায়ী বাতিল না হয়। যদিও সম্ভাবনা কম, সেক্ষেত্রে এদের আর দুটি দলের কোনো একটিতে যুক্ত হতে হবে আথবা অভিভাবকহীন স্বতন্ত্র থাকতে হবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এমন হওয়ার সম্ভাবনা কম। কথিত স্বতন্ত্রদের কেউই দলের বাইরে যেতে চাইবে না। কারণ এমন সদস্যদের ভবিষ্যৎ রাজনীতির যে মৃত্যু হয় তার অঢেল দৃষ্টান্ত রয়েছে।
এ বিশ্লেষণের পর যে প্রশ্নটি সামনে এসেছে সেটা হলো অন্তত একটি আদল দেওয়ার জন্য ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দল কারা হবে? তবে একটা অভিনব বিরোধী দল দেখা যাবে মনে হয়। যদি জাতীয় পার্টি ১১ জন সদস্য নিয়ে বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, প্রায়োগিক প্রচলন যাই থাকুক, তা হলে বাকি ৬১+১এর ভূমিকা কী হবে? হয়তো এসব প্রশ্নের উত্তর কয়েক দিনের মধ্যেই পাওয়া যাবে। তবে এবারের সংসদ একটি ব্যতিক্রমধর্মী হতে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
এবারের নির্বাচন অনুষ্ঠানের পূর্বেই বলেছিলাম যে, শুধু ভোটার দিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের সংজ্ঞা আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয় না। গণতান্ত্রিক বিশ্বে তেমনই হয়েছে। ভোটের শতাংশ নিয়েও যথেষ্ট বির্তক রয়েছে, ২৮ না ৪২% শতাংশ- এই বিতর্কের আনুষ্ঠানিকভাবে প্রমাণও দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। তবে দেশি ও বিদেশি গণমাধ্যম ও প্রত্যক্ষদর্শীরা এ যাবৎকালের সবচাইতে কম ভোটারের উপস্থিতির কথা বলছে এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়াতেও এমনই নথিভুক্ত হয়েছে।
এ নির্বাচনের পরবর্তী জের বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেক প্রশ্ন রেখে যাবে। আওয়ামী লীগের মতো বড় ও প্রাচীন দলে এই নির্বাচনে অংশগ্রহণের পর যে বিভক্তি দেখা গিয়েছে দলের মধ্যে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে। জাতীয় পার্টি, যাকে তৃতীয় বৃহত্তর পার্টি হিসেবে গণ্য করা হতো, অস্তিত্ব বিলীনের পথে দলের মধ্যে বিভক্তি আসন্ন। যেমনটা সত্তরের দশকে জাসদ-এর হয়েছিল। আগামীতে জাতীয় পার্টি ধর্তব্যের মধ্যে থাকবে বলে মনে হয় না।
অপরদিকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবারও নির্বাচনে না আসবার সিদ্ধান্ত, অবশ্য ২৮ অক্টোবরে সন্ত্রাসী ঘটনা না হলে গতিপ্রকৃতি কী হতো তা ধোঁয়াশাই রইল, সত্ত্বেও বড় ধরনের ভাঙনের মুখে পড়েনি। অপরদিকে বিগত বছরগুলোতে ইসলামিক আন্দোলন, যারাও নির্বাচনে বাইরে রয়েছে। যথেষ্ট রাজনৈতিক শক্তি সঞ্চয় করেছে। বাড়িয়েছে নিজেদের ভোটব্যাংক। এবারই প্রথম বাংলাদেশের প্রাচীন বাম দলগুলো এই নির্বাচনের বাইরে থেকেছে। তার সাথে বেশ কয়েকজন তরুণ নেতৃত্বে পরিচালিত নতুন দল নিজেদের জায়গা করতে সক্ষম হয়েছে। কয়েকটি পুরাতন দল যেমন এলডিপি ও জাসদ-এর একাংশ বাইরে রয়েছে। কাজেই আগামী সময়ে সরকারবিরোধীরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন কতখানি সরগরম রাখবে তা দেখবার বিষয় হবে।
এ নির্বাচনের আরেকটি ফল মনে করা হয় যে অনেক পরিচিত নেতার, সরকারি দলসহ এমন নির্বাচনে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক জীবনের শেষ অধ্যায় হতে পারে।
আরও পড়ুন:
দিকে দিকে মাফিয়াতন্ত্র-২
যাই হোক, বিশ্লেষণটি সংক্ষিপ্ত। তবে দেশের এই নির্বাচনসহ বাকি দুটো নির্বাচন ২০১৪-২০১৮তে গবেষণার প্রচুর তথ্যউপাত্ত পাওয়া যাবে।
সরকারের সামনে অর্থনৈতিক, সুশাসন, ব্যাপক দুর্নীতি ও ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের সাথে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ হবে জটিলতম বিষয়।
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন : সাবেক নির্বাচন কমিশনার, সাবেক সেনা কর্মকর্তা, নির্বাচন ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ