সীমিত কার্যকরী মুদ্রানীতি
আমাদের এখনো বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ আছে, সেগুলোর মধ্যে বিশেষ করে আর্থিক, বৈশ্বিক এবং অভ্যন্তরীণ। এই চ্যালেঞ্জের মধ্যে গত বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে। নতুন মুদ্রানীতির মেজর একটা টার্গেট হলো মূল্যস্ফীতি। আর এই মূল্যস্ফীতির হার কমিয়ে ৭.৫ শতাংশে আনার লক্ষ্যে নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন এ মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহার ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়ানো হয়েছে। সতর্ক এবং সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি মূল্যস্ফীতি একটু কমায় এবং প্রত্যাশাটাও কমায়, সে দুটি হলো একটু গতানুগতিক একটা পন্থা। এটা আমাদের দেশে মূল্যস্ফীতির চাহিদার কারণে যত না তার চেয়ে বেশি হলো সরবরাহজনিত কারণে। অনেক সময় গুদামজাত বা স্টোরের পণ্য সরবরাহের জন্য বাজারে আসে না। বাজারজাতকরণ সময় মধ্যস্বত্বভোগীদের কারসাজি থাকে। তাদের ব্যবসায়িক কৌশলের কারণে পণ্য বাজারে সরবরাহ করে না। এসব কারণে অনেক সময় মূল্যস্ফীতি বাড়ে। পলিসি রেট বাড়িয়ে দিয়ে এই ধরনের গতানুগতিক মুদ্রানীতি কার্যকরী নয়। দুই বছর দেখেছি। সুদের হার বাড়িয়েছে, স্মার্ট রেট করেছে তাতে কোনো লাভ হয়নি। প্রথম কারণ হলো আমাদের পুরো অর্থনীতিটা ফরমাল সেক্টরের ৫০-৬০%-এর বেশি হবে না, বাকি সবাই ব্যাংকের বাইরে। বাকিরা ব্যাংকের ভেতরে নেই। ফরমালের সঙ্গে কিছু লোক আছে টাকা লেনদেন করে। কিন্তু এর সঙ্গে পলিসি রেটের সম্পর্ক নেই। রেটগুলো তো সংবেদনশীল নয়। পাশ্চাত্য দেশে যেমন আমেরিকা ও ইংল্যান্ডে ১০০% লোক ব্যাংকের অধীনে। ক্যাশলেস সোসাইটি। সবকিছুই তারা নিয়ন্ত্রণ করে।
আমাদের সঞ্চয়পত্রের সঙ্গে পলিসি রেটের তেমন সম্পর্ক নেই কিন্তু সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো হয়েছে, যেটা ভালো হয়নি। যারা ক্ষুদ্র সঞ্চয়ী তাদের আয় কমে গেছে। সরকার ঋণ করে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মাধ্যমে। সরকার চাইলেই কিন্তু টাকা দিতে হবে। এখানে দেখা যাচ্ছে যে, প্রাইভেট সেক্টরে কমবে কিন্তু পাবলিক সেক্টরে কমবে না। তার মানে সরকার ঋণ নিচ্ছে। সরকারের টাকা বিভিন্ন প্রকল্প, সরকারের ব্যয় বহনে যাবে। কিন্তু এগুলো প্রত্যক্ষভাবে উৎপাদনশীল নয়, হয়তো পরোক্ষভাবে করবে বা ভবিষ্যতে করবে সেটা অন্য জিনিস। উৎপাদন খাতে তো খরচ করতে হবে। উৎপাদনশীল খাতে, যেখানে সেবা এবং পণ্য বাজারে আসবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পলিসি রেট এবং ক্রেডিট গ্রোথ যেটাই হোক বেশির ভাগ ক্রেডিট যেতে হবে যেখানে কর্মসংস্থান হবে, যেখানে আমাদের উৎপাদন বাড়বে। যেমন কৃষি উৎপাদন বাড়বে, তা হলে কর্মসংস্থান বাড়বে। কৃষির ক্ষেত্রে যারা প্রডিসার তারাও বেনিফিটেড হবে। দ্বিতীয়ত টাকা অবমূল্যায়ন হচ্ছে, ডলার সংকট হচ্ছে, এদিকে যে খুবই একটা মনোযোগ দিয়েছে, সেটা মনে হলো না। ক্রলিং পেগের মধ্যে কীভাবে ম্যানেজ করব ফরেন এক্সচেঞ্জ রেট সেটা সম্পর্কে বলা হয়েছে। কীভাবে আর্থিক হিসাবের ঘাটতি কমাবেন, কীভাবে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনবেন সেটা নিয়ে তেমন কথা নেই। এটা এক ধরনের আপদকালীন একটা মুদ্রানীতি, যেখানে বৈদেশিক মুদ্রার নিয়ন্ত্রণ একবারে শিথিল করতে চাচ্ছে না। হঠাৎ করে আবার রেট কোথায় চলে যায় তার তো ঠিক নেই। ক্রলিং পেগের মাধ্যমে বৈদেশিক বিনিয়োগ, প্রবাসী আয় বাড়াবে সেটা কোথায়? যতক্ষণ না ইনফ্লো বাড়বে ততক্ষণ তো ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট নেগেটিভ বা ঋণাত্মক থাকবে।
দেশের ভেতরে বড় বড় শিল্প ও ব্যবসা তো এখন পুঁজিবাজারে যায় না। এখনো ব্যাংকের ওপর নির্ভর করে। এটা দুঃখজনক এবং নৈরাশ্যজনক অবস্থা। সরকারের উচিত রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনা, সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংক স্পেশাল কিছু করতে পারে। যেমন আমাদের গার্মেন্টশিল্পটা উন্নয়ন করেছে পণ্যের বন্ডেড ওয়্যারহাউস, ব্যাক টু ব্যাক এলসি এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্রেডিট ইডিএফ দিয়ে অনেক প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে সরকারকেও কিছু ভার বহন করতে হয়েছে। খাদ্যদ্রব্য, ইলেকট্রনিকস, ফার্মাসিউটিক্যালস, চামড়া, সিরামিক এগুলো তো রপ্তানি করার জন্য প্রণোদনা দিতে অসুবিধা কী? প্রণোদনা দিলে উপকারী হতো। শুধু একটা সেক্টরের অর্থাৎ গার্মেন্টের ওপর নির্ভর করলে হবে না।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
আমাদের অনেক স্মল ইন্ডাস্ট্রি পণ্য রপ্তানি করে। তাদের সহযোগিতা দিলে তারা এগিয়ে যেতে পারে। যেমন চীন পৃথিবীতে তারা এমন কোনো পণ্য মনে হয় না রপ্তানি করে। ওদের পণ্যগুলো তৈরি হয় বিভিন্ন ও ছোট ও মাঝারি ইন্ডাস্ট্রিতে। ওরা ছোটখাটো ইন্ডাস্ট্রিতে বিনিয়োগ করে। সবকিছুই তারা রপ্তানি করে মুনাফা অর্জন করে। এখানে সার্বিকভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতির সঙ্গে অর্থ, বাণিজ্য, খাদ্য, কৃষি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সম্মিলিতভাবে কার্যক্রম নেওয়া অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়েছে। খাদ্যদ্রব্য আমদানি করে তার পর মেশিনারি ও কাঁচামাল আমদানি করা সম্পর্কে তো নতুন মুদ্রানীতিতে নজর দেখলাম না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতির সঙ্গে কৃষি মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয় এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সমন্বিতভাবে কাজ করলে সার্বিকভাবে তখনই উন্নয়নের পথটা সুগম হবে, মুদ্রানীতির সাফল্য তখনই দেখা যাবে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক; অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়