অযাচিত আশঙ্কা অচিরেই দূরীভূত হোক

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী
১৭ জানুয়ারী ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
অযাচিত আশঙ্কা অচিরেই দূরীভূত হোক

স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে সংঘটিত মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন বা বর্তমান রাশিয়ার ভূমিকা ছিল অনবদ্য। আন্তর্জাতিক সমর্থনের ভিত্তিতে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় উঁচু মার্গের শুভাকাক্সক্ষী হিসেবে তাদের অবদান শুধু ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে না; যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ পুনর্গঠনে, বিশেষ করে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামকে কার্যকর করতে তাদের দুঃসাহসিক অভিযান চিরস্মরণীয়। পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক-শিক্ষা-সংস্কৃতিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতা বাঙালি জাতি এখনো কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে। নিকট-অতীতে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল নিজেদের মনঃপূত না হলে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে আরব বসন্তের মতো ঘটনা ঘটিয়ে বাংলাদেশের পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল করার পরবর্তী প্রচেষ্টা চালাতে পারে বলে সতর্ক করেছেন। তিনি আরও জানান, প্রধান শিল্পগুলো আক্রমণের শিকার হওয়ার পাশাপাশি সরকারি কর্মকর্তারা ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে নাগরিকের গণতান্ত্রিক ইচ্ছার প্রতিফলনে বাধাগ্রস্ত করেছেন এমন প্রমাণহীন বিষয়েও অভিযুক্ত হতে পারে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সব সচেতন নাগরিক মানবতার প্রশ্নে উচ্চকিত থাকলেও সরকারপ্রধান ও সরকারের নানামুখী অপতৎপরতা কর্তৃত্ব-আধিপত্যবাদের কদর্য চরিত্রকে বিশ্বব্যাপী উন্মোচন করে থাকে। উন্নত বিশ্বের সর্বোচ্চ মানবাধিকার হরণকারী দেশগুলোর কথিত মিত্রশক্তি ধরিত্রীর বুকে নিরপরাধ-নিরীহ-অসহায় মানুষদের নিপীড়ন-নির্যাতন কোন ধরনের মানবতাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে; কিছুতেই তা বিজ্ঞজনের বোধগম্য নয়। নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে হত্যা-গণহত্যায় প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ-সমর্থন বিশ্ববিবেককে চরম আর্তনাদে শুধু নিপতিত করছে না; ধর্ম-বর্ণ-দল-মত-অঞ্চল নির্বিশেষে পৃথিবী নামের এই গ্রহের প্রতিটি মানুষ অন্তরের গভীর থেকে এদের জঘন্য অপকর্মের বিরুদ্ধে সোচ্চার ও অহরহ ধিক্কার জানিয়ে আসছে। গণতন্ত্র-মানবিকতা-অসাম্প্রদায়িকতার মিথ্যা বুলি উচ্চারণে এরা যে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাস-নৈরাজ্য এবং বিভিন্ন দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরিতে পারদর্শী; এ সম্পর্কে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।

আমাদের সবার জানা, একবিংশ শতাব্দীতে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে বড় বিপ্লব ‘আরব বসন্ত’। ২০১০ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে আরব বিশ্ব ও উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের জনগণের নানামুখী দাবির পরিপ্রেক্ষিতে যে বিক্ষোভ-আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল; পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলোর ব্যাপক প্রচারণায় তা বিশ্বব্যাপী আরব বসন্ত হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। আরব বসন্তের শুরু হয় ২০১০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ ডিসেম্বর তিউনিশিয়ায় মোহাম্মদ বোয়াজিজি নামের এক ফল বিক্রেতা পুলিশের দুর্নীতি ও দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদে গায়ে আগুন দিয়ে আত্মাহুতি দেওয়ার মধ্য দিয়ে। পরে বৃহৎ আকারে তার রেশ ছড়িয়ে পড়ে আলজেরিয়া, বাহরাইন, ইরান, জর্ডান, মিশর, লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেনসহ বিভিন্ন আরব দেশে এবং ইরাক, কুয়েত, মৌরিতানিয়া, ওমান, সৌদি আরব, সোমালিয়া ও সুদানে ছোট পরিসরে বিক্ষোভের ঘটনা ঘটে। আরব বসন্তের গণআন্দোলনের ফলে ২০১১ সালের ১৪ জানুয়ারি তিউনিশিয়ার শাসক বেন আলীর পতন ঘটে এবং ইসলামিক দল ইনাদাহ ক্ষমতায় আরোহণ করে। একই বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি মিশরের শাসক হোসনি মোবারকের ৩০ বছরের এবং ২০ অক্টোবর লিবিয়ার মুয়াম্মার আল-গাদ্দাফীর মৃত্যু হলে ৪২ বছরের শাসনের অবসান হয়। বিভিন্ন সংস্থার তথ্যানুযায়ী, নজিরবিহীন এই গণবিক্ষোভে দেড় লাখেরও বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটে। আরব বসন্তের মাত্র পৌনে দুই বছরে লিবিয়া, মিশর, তিউনিশিয়া, বাহরাইন ও ইয়েমেনের গণ-আন্দোলনের ফলে মোট দেশজ উৎপাদনের ক্ষতি হয়েছে ২ হাজার ৫৬ কোটি ডলার। প্রচলিত ধারণা যে, আরব বিশ্বের এই গণঅভ্যুত্থানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় মিত্র রাষ্ট্রগুলোর অস্ত্র সরবরাহ এবং প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রনায়কদের পতন ঘটাতে এসব আন্দোলন সফল হয়েছিল।

রেনেসাঁ-শিল্পবিপ্লব-ফরাসি বিপ্লবসহ পৃথিবীর ইতিহাস পরিবর্তনকারী বিপ্লবগুলো সাধারণ মানুষের মুক্তি, অধিকার-ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় যথার্থ অর্থে সার্থক হলেও যে লক্ষ্য-উদ্দেশ্যে আরব বসন্ত সংঘটিত হয়েছিল তা কতটুকু কার্যকারিতা পেয়েছে তার বস্তনিষ্ঠ বিশ্লেষণ প্রয়োজন।

লিবিয়ায় মুয়াম্মার আল-গাদ্দাফীর সময়কালে গণতান্ত্রিক অধিকার না থাকলেও সাধারণ জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণ ও জীবনযাত্রার মান নিশ্চিত ছিল। কিন্তু আরব বসন্তের পর লিবিয়ার সাধারণ জণগণের হাতে পশ্চিমারা অস্ত্র তুলে দিলে লিবিয়ায় গৃহযুদ্ধ দেখা দেয়। ন্যাটোর হস্তক্ষেপের কারণে লিবিয়ার কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়ে এবং বিভিন্ন অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে নানা গোষ্ঠীর শাসন গড়ে ওঠে যা এখনো বিরাজমান। ফলে লিবিয়ার সাধারণ মানুষের জীবন আজ চরম বিপর্যস্ত। আরব বসন্তের ঢেউ লাগা সিরিয়ায় প্রতিনিয়ত অগণিত নারী-শিশুর রক্তের স্রোত আরব বসন্তের মূল্য দিচ্ছে। দীর্ঘ ক্ষমতায় থাকা আসাদ সরকারকে উৎখাত করার জন্য বিদ্রোহকারী সাধারণ জনগণকে মার্কিনিরা অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা দিয়ে আন্দোলনকে আরও বেগবান করলে দেশটি গৃহযুদ্ধে নিপতিত হয়। চারদিকে মৃত্যু আর লাশের উৎসব, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে বেড়ে উঠছে অপুষ্টিতে চরম আক্রান্ত শিশুগুলো।

বাশার সরকারের পরাজয়ের মুহূর্তে রাশিয়া ও ইরান সমর্থন জানালে গৃহযুদ্ধ দীর্ঘায়িত হয়ে এখনো চলমান। যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু এবং লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে শরণার্থী শিবিরে বসবাস করছে। আরব বসন্ত সিরিয়ার সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে তাদের স্বাভাবিক জীবন ধ্বংস করে দিয়ে কেড়ে নিচ্ছে হাজার হাজার তাজা প্রাণ। জাতিসংঘের মতে, বাসারবিরোধী লড়াইয়ে শুরু থেকে এ পর্যন্ত দুই লাখ ৪০ হাজার মানুষ নিহত এবং ১ কোটি ১০ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়েছে। ৭৬ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির ভেতরেই অমানবিক পরিস্থিতির মধ্যে বসবাস করছে। প্রায় ৪০ লাখ সিরিয়ার নাগরিক জর্ডান, লেবানন ও তুরস্কে শরণার্থী হিসেবে জীবনযাপন করছে। একইভাবে ইয়েমেন ও বাহরাইনে সরকার পরিবর্তন হয়ে জন্ম নিয়েছে নতুন জঙ্গিগোষ্ঠী। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা পর্যুদস্ত হওয়ার পরও ফিরে আসেনি আরব বসন্তের কাক্সিক্ষত লক্ষ্য এবং নিশ্চিত হয়নি সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার।

বিশ্লেষকদের মতে, আপাতদৃষ্টিতে এ গণজাগরণকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে চলা দমন-পীড়ন, স্বাধীন মতপ্রকাশের অভাব, বেকারত্ব-হতাশা, অনিয়ম-দুর্নীতি, ব্যক্তি বা পরিবারবিশেষের ক্ষমতা আঁকড়ে থাকায় ক্ষোভের বহির্প্রকাশ হিসেবে দেখা হলেও ঘটনার গভীরে ভিন্ন বাস্তবতাও রয়েছে। আরব বসন্ত ছিল গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের মূলা ঝুলিয়ে মধ্যপ্রাচ্যকে অস্থিতিশীল করে পশ্চিমা বিশ্বের অর্থলিপ্সুতায় ভরপুর অস্ত্র ব্যবসা, তেল আমদানি ও তাদের মদদপুষ্ট শাসকের ক্ষমতায় বসানোর একটি এজেন্ডা মাত্র যা বর্তমান বিশ্বের সামনে অতি সুস্পষ্ট। যদিও তারা তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে বহুলাংশে সফল। মূলত যেসব দেশে আরব বসন্ত এসেছিল পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে, সেসব দেশে কার্যত কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন হয়নি। আরও বেড়েছে বিভেদ-সংঘাত-জনগণের হতাশা ও রক্তপাত। কী দিয়েছে আরব বসন্ত? বা স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন, তার ফল কি হত্যা-গণহত্যা-গৃহযুদ্ধ-দুর্ভিক্ষ? এমন সব প্রশ্নই এখন আরববিশ্বে ঘুরপাক খাচ্ছে। এই নির্মমতার শেষ কোথায় সে সম্পর্কেও তারা অবগত নন। হয়তো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি পশ্চিমাদেরই হাতে। এখন দেখার বিষয় মধ্যপ্রাচ্যকে আর কতদিন আরব বসন্তের মূল্য পরিশোধ করতে হয়।

বিশ্ববাসী সম্যক অবগত আছেন, গত ৭ অক্টোবর ২০২৩ ফিলিস্তিনের সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে দীর্ঘকাল ধরে পরিচালিত যুদ্ধের অংশ হিসেবে হামাসের ইসরাইল আক্রমণকে কেন্দ্র করে ইসরাইলের পক্ষ থেকে গাজা ও পশ্চিম তীরে নৃশংসতম হত্যা-গণহত্যার দৃশ্যাদৃশ্য ভয়ঙ্কর রূপ পরিগ্রহ করেছে। বিশ্বের কতিপয় ক্ষমতাধর কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রনায়কের প্রত্যক্ষ মদদ ও আধুনিক সামরিক সহযোগিতা অব্যাহত রেখে নারকীয় তা-বের নজিরবিহীন দৃশ্যপট তৈরি করে চলছে।

সামগ্রিক পর্যালোচনায় এটি স্পষ্ট যে, অশুভ পরাশক্তি হীনস্বার্থ উদ্ধারে যে কোনো সময় যে কোনো দেশে সরকার পরিবর্তনের আড়ালে অস্ত্র বিক্রি এবং যুদ্ধরত রেখে পুরো দেশ বিপর্যস্ত করতে অপতৎপরতায় লিপ্ত থাকে। প্রতিশোধপরায়ণতা-প্রতিহিংসা-বিরোধ-বিচ্ছেদের কুৎসিত অপপ্রচার এবং জনগণের বিরুদ্ধে জনগণকে দাঁড় করিয়ে ভয়ঙ্কর পরিবেশ সৃষ্টির পাঁয়তারা তাদের স্বভাবজাত। ৭ জানুয়ারি দেশে সুষ্ঠু-অবাধ ও শান্তিপূর্ণভাবে সুসম্পন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং তার ফলে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল মনোভাবাপন্ন দল-ব্যক্তির সমন্বয়ে সরকার গঠন যুগান্তকারী মাইলফলক। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অকুণ্ঠ সমর্থনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠনে জনগণ ও গণতন্ত্রের বিজয় ঘোষিত হয়েছে। এখনো কথিত নির্বাচনবিরোধী দেশি-বিদেশি অপশক্তির অভিশপ্ত চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র নানাভাবে অনুভূত। দেশের আপামর জনগণের ঐক্যবদ্ধতায় অতীতে এদের সব দেশবিরোধী কর্মযজ্ঞের বৈরী অভিজ্ঞতার কাঠিন্যে সব ধরনের কূটকৌশল পরাস্ত হবেই ইনশাআল্লাহ। মোদ্দা কথা আরব বসন্তের মতো কোনো ঘটনার আবির্ভাব বাঙালি জাতি যে কোনো মূল্যে পরাভূত করবেইÑ এই আশাবাদ ব্যক্ত করা মোটেও অমূলক নয়।

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়