ব্লকচেইন এবং পিটুপি নেটওয়ার্ক অবিচ্ছেদ্য কি?
শাতোসি নাকামত ২০০৮ সালের এক দিনে তার ব্যক্তিগত গবেষণাকেন্দ্রে ‘ইলেকট্রনিক ক্যাশ বিনিময়’ নিয়ে পর্যালোচনা করা অবস্থায় ব্লকচেইন বিতরণপদ্ধতি নিয়ে এক উপলব্ধিতে অবতীর্ণ হন। মার্কেল ট্রি-এর এক পদ্ধতি নিয়ে কর্মরত অবস্থায় তিনি আবিষ্কার করেন পিয়ার-টু-পিয়ার বা পিটুপি নেটওয়ার্ক এর একটি দ্রুততর পদ্ধতি। পিয়ার-টু-পিয়ার শব্দের অর্থÑ ‘সমকক্ষ’ অর্থাৎ যে ধরনের নেটওয়ার্কিং কম্পিউটারসমূহ এককভাবে সার্ভার বা ক্লায়েন্ট হিসেবে কাজ না করে বরং কাজের প্রকৃতি ও ক্ষেত্রবিশেষ অনুযায়ী সার্ভার এবং ক্লায়েন্ট উভয় হিসেবেই কাজ করতে পারে। পিটুপির নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা ক্লায়েন্ট-সার্ভার ব্যবস্থা থেকে ভিন্ন। কোনো কম্পিউটার যখন অন্য কোনো কম্পিউটারকে সেবা প্রদান করে তখন তাকে সার্ভার বলে এবং এই একই কম্পিউটার যখন অন্য কোনো কম্পিউটার থেকে সেবা গ্রহণ করে তখন তাকে ক্লায়েন্ট বলা হয় আর এ ধরনের নেটওয়ার্ককে সার্ভার-ক্লায়েন্ট সিস্টেম বলা হয়। পিয়ার-টু-পিয়ার নেটওয়ার্কে প্রতিটি কম্পিউটার ডাটা, অ্যাপ্লিকেশন ও রিসোর্স শেয়ারিংয়ের ক্ষেত্রে সমান ভূমিকা পালন করে এখানে কোনো ডেডিকেটেড সার্ভার থাকে না। প্রতিটি কম্পিউটার তার নিরাপত্তা বিধান নিজেই করে থাকে। তা ছাড়া ফাইল অথবা রিসোর্স শেয়ারিংয়ের ক্ষমতা নিজেই বণ্টন করে থাকে এবং এ ক্ষেত্রে সব কম্পিউটারের ক্ষমতা একই ধরনের হয়ে থাকে। পিটুপি নেটওয়ার্কে কম্পিউটার হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যার কোনো সার্ভারের সাহায্য ছাড়া একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগের ভেতর থাকতে পারে। আর এই নেটওয়ার্কে কানেক্টেড থেকে সব ডিভাইস একে অপরের সঙ্গে ডিজিটাল ফাইল আদান-প্রদান করতে পারে। এই নেটওয়ার্ক সাধারণত ফাইল শেয়ারিং করার জন্যই ব্যবহার করা হয়। পিয়ার-টু-পিয়ার নেটওয়ার্ক বাড়ির লনের মতোই কাজ করে, যেখানে বাড়ির কম্পিউটারগুলো একসঙ্গে কানেক্টেড থাকে এবং সবার সঙ্গে সবার ফাইল শেয়ার করা যায়। বাড়ির নেটওয়ার্কে রাউটারের সঙ্গে কানেক্টেড থাকা কম্পিউটারগুলো এক ধরনের হাইব্রিড পিটুপি নেটওয়ার্ক তৈরি করে, যেখানে রাউটার কম্পিউটারগুলোকে ইন্টারনেট অ্যাক্সেস প্রদান করে এবং ফাইল শেয়ারিং বা প্রিন্ট করার সময় কম্পিউটারগুলো সরাসরি নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে। পিটুপি নেটওয়ার্কের কিছু সুবিধা রয়েছে, যেগুলো হলো:
১। পিটুপির ডিজাইন এবং এর রক্ষণাবেক্ষণ পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ সহজ, ২। পিটুপির খরচ তুলনামূলক কম, ৩। উচ্চগতির প্রসেসর-হার্ডডিস্কের প্রয়োজন হয় না; সাধারণ অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করা যায় (সাধারণত উইন্ডোস ৭, ১০)। চিত্র : সার্ভার-ক্লায়েন্ট নেটওয়ার্কিং এবং পিয়ার-টু-পিয়ার নেটওয়ার্কিং ব্লকচেইন প্রযুক্তি একটি নতুন ধরনের ইন্টারনেটের মেরুদণ্ড তৈরি করে, যা পিটুপি নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে; তবে এনক্রিপ্টেড অনুমতি ছাড়া কোনো ডিজিটাল তথ্য কপি অথবা বিতরণ করা যাবে না। সবচেয়ে সহজভাবে বললে ব্লকচেইন বলতে শাব্দিকভাবে শুধুই ব্লকের একটি চেইন বা শৃঙ্খলকে বোঝায়; কিন্তু শব্দগুলোর ঐতিহ্যগত অর্থে নয়। যখন এই পরিপ্রেক্ষিতে ব্লক এবং চেইন শব্দগুলো বলা হয়, তার অর্থ দাঁড়ায় একটি পাবলিক বা সর্বজনীন ডেটাবেজে (দ্য চেইন বা শৃঙ্খল) সংরক্ষিত ডিজিটাল তথ্যের কথা (দ্য ব্লক)। ব্লকচেইন=ব্লক+চেইন এই সিস্টেমে প্রতিটি ব্লক এক একটি অ্যাকাউন্ট, যার প্রতিটি লেনদেন ব্যবস্থাপনা চেইন আকারে পরিচালিত। প্রত্যেকটি ব্লক হ্যাশিংয়ের মাধ্যমে উচ্চমানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
এই উদ্ভাবনাটি এতটাই সাড়া ফেলে দেয় পৃথিবীজুড়ে যে, ব্লকচেইনের মেরুদণ্ড হিসেবে ক্রিপ্টোগ্রাফিকে আখ্যায়িত করা হয়। ক্রিপ্টোগ্রাফিক টেকনোলজি ব্যবহার করে ব্লকচেইন নিয়ে সর্বপ্রথম কাজ করা হয় ১৯৯১ সালের দিকে। তবে ২০০৮ সালে এর প্রকৃত ব্যবহারকে কাজে লাগান সাতোশি নাকামোতো, যিনি ক্রিপ্টোকারেন্সি তথা বিটকয়েনের লেনদেনের জন্য ব্লকচেইন টেকনোলজির ব্যবহার শুরু করেন। বর্তমানে ব্লকচেইনের ব্যবহার সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা বেড়েই যাচ্ছে। ব্লকচেইন মূলত একটি পিটুপি নেটওয়ার্ক তৈরি করে, যেখানে ব্লকচেইনের প্রত্যেকটি ব্লকের ডেটা ইন্টারনেটের সঙ্গে কানেক্ট থাকা যে কোনো ব্যক্তি ব্লকগুলোকে ভেরিফাই করতে পারে। ব্লকচেইন এমন একটি টেকনোলজি, যা খুবই নিরাপদ এবং দ্রুতগামী। নিরাপদ এই কারণে যে, ব্লকচেইন ব্যবহার করে যে ট্রানজেকশন করা হবে, তা হ্যাক করে এর মাঝে গরমিল তৈরি করা অসম্ভব। যদি ব্লকচেইন ব্যবহার করে একজন কাউকে কোনো পেমেন্ট করলেন, তখন সঙ্গে সঙ্গেই এই তথ্যটি এই সিস্টেমের সঙ্গে জড়িত সব কম্পিউটারে পৌঁছে যায়। আর তথ্যটি ভ্যালিডিটি দেওয়ার জন্য ট্রানজেকশনের সঙ্গে পুর্বের ট্রানজেকশনের হ্যাশ যোগ হয়ে যাবে। এভাবে ট্রানজেকশনের হ্যাশটি পরবর্তী ট্রানজেকশনের হ্যাশের পূর্ব হ্যাশ হিসেবে লিংক হয়ে যাবে। এভাবে চেইন সিস্টেম ক্রমাগতভাবে তৈরি হতে থাকে। যদি কেউ ব্লকচেইন টেকনোলজিকে হ্যাক করে এর তথ্যের মাঝে কোনো গরমিল করতে চেষ্টা করে, তবে তা করা অসম্ভব। কারন তা করতে হলে তাকে একই সময়ে হাজার হাজার কম্পিউটার হ্যাক করতে হবে। কারন প্রতিটি ট্রানজেকশন তৈরি হওয়া মাত্রই তার তথ্য হাজার হাজার কম্পিউটারে পৌঁছে গিয়ে ততোধিক ট্রানজেকশন মিলে একটি ব্লক তৈরি করে ১০ মিনিটের মতো সময়ে। তাই একটি ব্লকের সম্পূর্ণ তথ্য পরিবর্তন করতে হ্যাকারের হাতে ১০ মিনিটের কম সময় থাকবে। আর এই সময়েরে মধ্যে হাজার হাজার কম্পিউটার হ্যাক করা নিছক কল্পনা মাত্র। এ ছাড়া খুব কম সময়ের মাধ্যমে লেনদেন সম্পন্ন হচ্ছে বলে হ্যাকিংয়ের ক্ষেত্রটাও অনেক কমে যাচ্ছে। এর ফলে দিন দিন ব্লকচেইনের জনপ্রিয়তা বেড়েই চলেছে। যদিও এর সফলতা ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে; কিন্তু এর ব্যবহার এখন অন্যান্য ক্ষেত্রেও অপার সমভাবনা তৈরি করেছে। ব্লকচেইন পদ্ধতিতে তথ্য সংরক্ষণ করা হয় ডিসেন্ট্রালাইজড নিয়মে। অর্থাৎ যে তথ্যের নিয়ন্ত্রণ কারো কাছে থাকবে না। নিয়ন্ত্রণহীন তথ্যগুলো জমা রাখার দায়িত্ব হচ্ছে এই ব্লকচেইন টেকনোলজির একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ; কিন্তু অপরদিকে বিটকয়েন ব্লকচেইন টেকনোলজির ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল। আর এই টেকনোলজি এমনভাবে তথ্য সংগ্রহ বা আদান-প্রদান করে, যার নিয়ন্ত্রণ তৃতীয় কোনো ব্যক্তির কাছে থাকে না। যেমন কিছু ব্যাংক ব্লকচেইন প্রয়োগের কথা ভেবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে। এভাবে দিন দিন এর ব্যবহার নিয়ে গবেষণা চলছে। উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশ রেলওয়ের অনলাইন টিকিটিংয়ের ক্ষেত্রে মোবাইল অথবা ওয়েব অ্যাপের মাধ্যমে টিকিট কেনা হয়, যেখানে পেমেন্ট গেটওয়ে প্রতি ট্রানজেকশনে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা অতিরিক্ত চার্জ করে। ব্লকচেইন এখানে রেলওয়ের এই পেমেন্ট গেটওয়ের প্রসেসিং ফি থেকে বাঁচানোর সঙ্গে সঙ্গে টিকিটের পুরো প্রক্রিয়াটিই ব্লকচেইনের ভেতর স্থানান্তর করতে পারে, যেখানে দুটি পক্ষ রেলওয়ে সংস্থা এবং যাত্রী। টিকিট একটি ডেটা ব্লক, যা টিকিট ব্লকচেইনে যুক্ত হবে। আর্থিক লেনদেনের রেকর্ড যেমন ব্লকচেইনে ইউনিক, স্বতন্ত্রভাবে যাচাইযোগ্য রেকর্ড (বিটকয়েনের মতো) হিসাবে থাকে, তেমনি আমাদের এই টিকিটও থাকতে পারে। তা ছাড়া আনুসংগিকভাবে ট্রেনের রুট অনুযায়ী যাত্রার বিশদ লেনদেনের রেকর্ড থাকবে। ব্লকচেইনের সম্ভাবনা তৈরি হওয়ার কারণে বর্তমানে এটি অনেক জনপ্রিয় হয়েছে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
ড. তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব : বর্তমানে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক বিজনেস স্কুলে কর্মরত
আরও পড়ুন:
দিকে দিকে মাফিয়াতন্ত্র-২