নতুন যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রীর কাছে আমাদের নতুন আশাবাদ

জাহিদ রহমান
১৫ জানুয়ারী ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
নতুন যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রীর কাছে আমাদের নতুন আশাবাদ

ক্রিকেট আর নারী ফুটবলের বাইরে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে আমাদের অর্জন তেমন কিছু নেই বললেই চলে। বিগত দিনে আন্তর্জাতিক ইভেন্টে ব্যক্তিগত লড়াইয়ে অনেকেই উজ্জ্বলতা ছড়ালেও তা এখন আর দেখা যায় না। এর সর্বশেষ উদাহরণ গত বছর চীনের হাংজুতে অনুষ্ঠিত ১৯তম এশিয়ান গেমস। এই গেমসে ১৭টি ডিসিপ্লিনে ২৭০ জনের বৃহৎ এক বহর নিয়ে বাংলাদেশ অংশ নিলেও দলগত ইভেন্টে কেবল দুটি ব্রোঞ্জপদক মেলে। আর পদক না পেলেও কোনো ব্যক্তিগত ইভেন্টেই আলো ছড়াতে ব্যর্থ হন অ্যাথলেটরা। ক্রীড়াঙ্গনের এই চিত্র অবশ্য অনেক দিনেরই। এশিয়ান গেমস, এসএ গেমস সবখানেই আমরা এখন ব্যর্থ। এখন শুধু এক ক্রিকেটের ওপরই সব আলো। আর মাঝে মাঝে আমাদের জন্য প্রাণময় খবর নিয়ে আসেন সর্বহারা নারী ফুটবলাররা।

বহুদিন ধরেই আমাদের ক্রীড়াঙ্গনে এমন অবস্থা চলমান। ক্রিকেট ছাড়া আর যেন কিছুই নেই। স্বপ্ন আর লড়াই এক ক্রিকেট ঘিরে। উচ্ছ্বাস, ভালোবাসা সবটুকু ক্রিকেটেই আবর্তিত। আর ফুটবল, হকি, কাবাডি, সাঁতার, শুটিং, স্প্রিন্ট যেখানেই হাত দেবেন নিশ্চিত দেখবেন ব্যর্থতা আর ব্যর্থতা। ফুটবলের সোনালি স্মৃতি ফিকে হয়ে গেছে বহু আগেই। নতুন আর কোনো ইতিহাস রচিত হয়নি। ফুটবলে কখনো কখনো একটু-আধটু সাফল্যের কথা শোনা গেলেও দ্রুত তা মিইয়ে যেতে সময়ও লাগে না। আর হকি, কাবাডির-মুখ থুবড়ে পড়ার খবর নিত্য চোখে পড়ে। অ্যাথলেটিক্স এক সময় আলো ছড়িয়েছে দক্ষিণ এশিয়ায়। শাহ আলম, বিমল, মাহবুবÑ রানিং ট্র্যাকের সোনাজয়ী এসব অ্যাথলেটের নাম এখনো সবার হৃদয়ে গেঁথে আছে। কিন্তু এর পর আর কিছুই হয়নি। কেউ কেউ কখনো কখনো সম্ভাবনা জাগালেও লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। গর্বের ইভেন্ট শুটিং নিয়েও এখন আর উচ্চবাচ্য হয় না। অনেকই বলেন, এই ইভেন্টও পথ হারিয়ে ফেলেছে। অথচ এক সময় কমনওয়েলথ গেমস, এসএ গেমস থেকে সোনাজয়ীরা আমাদের অতৃপ্ত আত্মাকে ভরিয়ে দিয়েছে। আসিফের মতো উঁচুমানের শুটার এ দেশেই তৈরি হয়েছে। কিন্তু এখন আমরা আর লড়াই করতে পারছি না।

গত বছরের কথাই ধরা যাক। ক্রীড়াঙ্গন আমাদের জন্য খুব একটা সুখপ্রদ ছিল না। ক্রিকেট আর নারী ফুটবলÑ এ দুটির বাইরে বলা যায় আর কোনো ক্ষেত্রে কোনো অর্জনই চোখে পড়েনি। ক্রিকেটের সবচেয়ে গ্লামারাস আসর বিশ্বকাপ ক্রিকেটে আমরা প্রত্যাশা অনুযায়ী খেলতে না পারলেও ক্রিকেটের অন্যান্য লড়াইয়ে মোটেও খারাপ করিনি। আর ফুটবলে আমরা এখনও তো সেই ভুটান, নেপাল বা মালদ্বীপকে হারাতে পারলেই কেবল খুশি। এর বাইরে কিছুই ভাবার অবকাশ নেই। সে রকম কোনো পরিস্থিতিও তৈরি হয়নি। অথচ এক সময় একই লেভেলে থাকা ভারত এখন অনেক উঁচুমানের ফুটবল খেলছে।

প্রতিযোগিতার বাইরে ক্রীড়াঙ্গনের কিছু ক্ষেত্রে গোলমেলে অবস্থাও বিদ্যমান। বহুবিধ সংকটের কথা এসেছে বারবার। বাফুফের দুর্নীতির বিষয়টি ফয়সালা হয়নি এখনো। বিগত দিনে ফিফার জরিমানার নানা খড়গের মাঝে আবার নতুন জরিমানার খবর এসেছে বাফুফের দপ্তরে। জাতীয় দলের ম্যাচ চলাকালে মাঠে ও গ্যালারিতে উচ্ছৃঙ্খলার জেরে বড় অঙ্কের জরিমানা গুনতে হবে বাফুফেকে। এদিকে ক্রীড়াক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অর্জনের দিক দিয়ে আমরা ব্যর্থ হলেও জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ তথা এনএসসির তালিকায় কিন্তু ফেডারেশনের কোনো অভাব নেই। নানান নতুন নতুন নামের ফেডারেশনে ভরা এনএসসির ওয়েবসাইট। বর্তমানে ৫৪টির মতো ক্রীড়া ফেডারেশনের নাম রয়েছে ওয়েবসাইটে। কিছু নাম অবশ্য কেউ বাপের জনমেও শোনেননি। নতুন নতুন নামে ফেডারেশন বানিয়ে যে ধান্ধা করা যায় সেটা বোধহয় এ দেশেই সম্ভব। অনেকের মতেই শুধু বিদেশ সফরের কৌশল হিসেবে এসব করা হয়। ব্যক্তিগতভাবে অনেকের পাসপোর্ট ভারি হলেও অনেক কথিত ফেডারেশনের কারণে আদতে দেশের কোনো লাভ হয়নি, কোনোদিন হবেও না।

ক্রীড়াঙ্গনে যখন এ রকম অবস্থা তখন নতুন পূর্ণ মন্ত্রী হয়ে এসেছেন বিসিবির সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন এমপি। নব্বইয়ের পর যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় বরাবরই প্রতিমন্ত্রীদের অধীনে থেকেছে। কখনই এই মন্ত্রণালয়ে পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদায় কাউকে দেখা যায়নি। অনেকদিন পর এই মন্ত্রণালয় পেল পূর্ণ এক মন্ত্রী এবং তিনি ক্রীড়াঙ্গনে বহুল পরিচিত এক মুখ। রাজনীতিক এবং ক্রীড়া প্রশাসক হিসেবেও যার জন পরিচিতির কোনো ঘাটতি নেই। বিসিবির সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন এমপি সেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি যিনি অনেক অনেক দিন পর যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে পূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে এসেছেন। এমন মর্যাদায় অভিষিক্ত হওয়ায় তাকে ঘিরে স্বপ্নটাও তাই বেশ বিস্তৃত হয়েছে ক্রীড়াবিদ এবং ক্রীড়াসংশ্লিষ্টদের মাঝে।

নাজমুল হাসান পাপন এমপি কোনোভাবেই ক্রীড়াঙ্গনে নতুন কেউ নন। বিসিবির সভাপতি হিসেবে সেই ২০১২ সাল থেকে তিনি দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ক্রীড়াঙ্গনের একজন প্রশাসক হিসেবে ‘স্পোর্টস ডিপ্লম্যাসি’ সম্পর্কে তিনি খুবই ভালো জানেন। এতদিন তিনি একটি মাত্র খেলার জন্য সজাগ, সক্রিয় থাকলেও এখন অবশ্যই তাকে ক্রীড়াঙ্গনের আদ্যোপান্ত নিয়ে ভাবতে হবে। নাজমুল হাসান পাপন দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়ার পর বিভিন্ন ফেডারেশনের সঙ্গে মতবিনিময়কালে বলেছেন, আগামী তিন বছরের মধ্যে দেশের ক্রীড়াঙ্গনে দৃশ্যমান উন্নতি আনার লক্ষ্যে কাজ করবেন। নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী বিরাট এক আশাব্যঞ্জক কথা বলেছেন।

এ কথা সত্য যে, দুই যুগ ধরে যারা প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন তাদের খেলাধুলার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। মন্ত্রী হওয়ার আগে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কোনো পরিচিতি বা কোনো ধরনের ইন্টারনাল যোগাযোগও ছিল না। ফলে মন্ত্রীদের কথা ও কাজে কোনো নতুনত্ব পাওয়া যায়নি। নাজমুল হাসান পাপন এমপি যেহেতু অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন ক্রীড়া প্রশাসক সেহেতু প্রথমেই তার কাজ হবে সম্ভাবনাময় ডিসিপ্লিনগুলোকে ঢেলে বা কার্যকরভাবে সাজানো এবং রেজাল্ট বেইজড পদক্ষেপ গ্রহণ করা। খেলাধুলার নামে ফেডারেশন বা এনএসসির কর্মকর্তা বা খেলোয়াড়দের বিদেশ ভ্রমণকে সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা। আন্তর্জাতিক ইভেন্টে শুধু সম্ভাবনাময় অ্যাথলেটদের পাঠানো, এর বাইরে জিরো টলারেন্স দেখানো। একই সঙ্গে তৃণমূল থেকে বিভিন্ন ইভেন্টের অ্যাথলেট তৈরির একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল ঠিক করতে হবে। খেলোয়াড়দের সার্বিক চাওয়া-পাওয়াকেও অগ্রাধিকার দিতে হবে। উন্নয়ন বাজেটও বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে।

তিন বছরকে সামনে রেখে নতুন যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রী যে দৃশ্যমান উন্নতির কথা বলেছেন সেটি অসম্ভব কিছুই নয়। এটি দৃশ্যমান হোক আমরাও মনেপ্রাণে কামনা করি। সময় অনেক পেরিয়ে গেছে। প্রতিবেশী অন্যরা এগিয়ে গেলেও আমরা কেবলই পিছিয়ে গেছি। নতুন যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রী সত্যিই ক্রীড়াঙ্গনে বড় ধরনের পরিবর্তন আনবেন বলে আমরা বিশ্বাস করি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পূর্ণমন্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে নাজমুল হাসান পাপন এমপিকে যেভাবে সম্মানিত করেছেন আমরা আশা করি তিনি ক্রীড়াঙ্গনে নতুন নতুন প্রাপ্তি উপহার দিয়ে সেই সম্মানের মর্যাদা ফিরিয়ে দেবেন।


জাহিদ রহমান : ক্রীড়া লেখক ও গবেষক