নারী নির্যাতন কি চলবেই
গবেষণায় দেখা গেছে, একটি দেশের লিঙ্গ সমতার স্তর এবং পারিবারিক সহিংসতার হারের মধ্যে একটি প্রত্যক্ষ এবং তাৎপর্যপূর্ণ পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে। স্বভাবতই লিঙ্গসমতা কম থাকা দেশগুলোতে পারিবারিক সহিংসতার হার অনেক বেশি। তাই নারী নির্যাতনের কথাই শুনতে হয় বেশি। এটা তো সত্যি যে, পুরুষও সহিংসতার শিকার হলে মূল ভুক্তভোগী কিন্তু নারী এবং শিশুরাই। আমাদের সমাজ পরিবারকেন্দ্রিক হলেও পরিবারকে টিকিয়ে রাখার জন্য দক্ষতা বৃদ্ধির কোনো ইনস্টিটিউট নেই, যেখান থেকে পরিবারের সদস্যরা পরিবার তৈরি করার ও পরিচালনা করার প্রস্তুতি নিতে পারে, ট্রেনিং নিতে পারে। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে চিন্তাভাবনাসহ পরিবারকে পরিচালনা করার মতোও স্মার্ট হওয়ার দীক্ষা নিতে হবে বৈকি। সহিংসতা তৈরি না হওয়ার প্রেক্ষাপটের দীক্ষা। কারণ পরিবারে অশান্তি হলে এখনো আমাদের সমাজে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে স্থানীয় মাতবরের কাছে মীমাংসা করতে যায়। যুগের সঙ্গে তাল না মিলিয়ে, সময়ের সঙ্গে সমাজের প্যাটার্ন যে বদলাচ্ছে সেটির ওপর জোর না দিয়ে ট্রাডিশনাল মূল্যবোধের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে মীমাংসা আসলে ফলপ্রসূ হয় না। ফলে সহিংসতার ধরন নানাভাবে প্রস্ফুটিত হচ্ছে!
পরিবারে সহিংসতার সৃষ্টি কেন হয়? পরিবার তো একটি জীবনব্যবস্থা, তা হলে কেন সহিংসতা? মানুষ তো এখন আদিম অবস্থায় নেই! বিশ্ব এখন সভ্য সমাজের দাবিদার! তা-ও কেন সহিংসতা নির্মূল করা যাচ্ছে না? তা হলে আসলেই কি মানুষ সভ্য হচ্ছে নাকি সভ্য হওয়ার মিথ্যে অভিনয়ে আরও বেশি পোক্ত হচ্ছে? আসলে আগে এক ধরনের সহিংসতা ছিল এখন অন্য ধরনের, সহিংসতা তার জায়গাতেই আছে; শুধু প্যাটার্ন বদলেছে।
বর্তমানে গবেষকরা প্রথমেই সহিংসতার যে কারণটি তুলে ধরছেন সেটি হলো- স্যোশাল মিডিয়ায় মাত্রাতিরিক্ত আসক্তির কারণে পরিবারের সদস্যদের একত্রে সময় কাটানো কমে গিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। এগুলো কিছুটা গ্রহণযোগ্য বটে, তবে সবটা নয়।
সত্যি কথা বলতে কী, পরিবারকে টিকিয়ে রাখতে হলে সমাজ ও রাষ্ট্রকেও দায়িত্ব নিতে হবে। স্কুল-কলেজে পরিবারের গুরুত্ব ও পারস্পরিক সম্পর্কগুলোর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তৈরির বিষয়ে পাঠ্যসূচি তৈরি করতে হবে। শুধু তা-ই নয়, পাঠ্যসুচির বাইরেও পারিবারিক বন্ধনের গভীরতা সম্পর্কে জ্ঞান বিতরণের পরিবেশ ও কর্মসূচি থাকতে হবে।
পারিবারিক কলহে ক্রোধ বা লোভের বশবর্তী হয়ে স্বামীর হাতে স্ত্রী কিংবা স্ত্রীর হাতে স্বামী খুন হলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুরা। তারা মা-বাবা দুজনকেই হারায়। কারণ অপরাধ করে একজনকে জেল খাটতেই হয় আর আরেকজন পরপারে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে! মাঝখান থেকে শিশুরা মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে যায়। ফলে সারাজীবন একটি ট্রমার ভেতর তাদের জীবন কাটে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বলছে- ২০২৩ সালের প্রথম পাঁচ মাসে পারিবারিক সহিংসতায় ১৭৮ নারী খুন হয়েছন। শুধু স্বামীর হতে নন, নিজ পরিবারের হাতেও খুন হয়েছেন কিছু নারী, আর সহিংসতার জের ধরে আত্মহত্যা করেছেন পঞ্চান্ন নারী।
আসলে বাস্তব কথা হলো- সবকিছুর পেছনে রয়েছে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। তাই সবার আগে আমাদের প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর। যতই প্রগতিশীলতার কথা বলা হোক না কেন, নারীকে ছোট করে দেখা এখনো সামাজিকভাবে স্বীকৃত। যদিও এরজন্য নারী নিজেই অনেকাংশে দায়ী, অস্বীকার করার উপায় নেই। ২০১০ সালে পারিবারিক সহিংসতা আইন প্রণয়ন হলেও কার্যত এর সুফল তেমন একটা পাওয়া যাচ্ছে না। তাই নারী নির্যাতন বন্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ জরুরি; অন্যথা আগামী প্রজন্মের অর্ধেকই অসুস্থ মানসিকতা নিয়ে বেঁচে থাকবে, যার প্রভাব পড়বে এই সমাজে। এই সমাজকে বাঁচাতে হলে সহিংসতার বিরুদ্ধে আমাদের কথা বলতেই হবে।
এই সময়ের সবচেয়ে অমানবিকতা হলো- নারীর প্রতি অন্যায়-অবিচার, তাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত যৌন সন্ত্রাস। নারী-পুরুষের ক্ষমতা ও সমতার ভারসাম্যহীনতাই এর মূল কারণ। পুরুষ এটা জেনেই বড় হয় যে, নারীর চেয়ে সে শক্তিশালী, নারীকে অবদমন করাতেই তার পুরুষত্ব। নারীর প্রতি বৈষম্যও যে মানবতার লঙ্ঘন, বেশিরভাগ পুরুষই তা জানে না। পুরুষ মনে করে এটা তাদের অধিকার, এখানে অমানবিকতার কিছু নেই!
উন্নত দেশগুলোতে পারিবারিক কলহ বা হত্যাকাণ্ড কতটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে সঠিক পরিসংখ্যান জানা না থাকলেও খবরে যেটুকু উঠে আসে তাতে চিত্রটা এই উপমহাদেশের তুলনায় অনেকটাই ভালো। ভালো হওয়ার প্রথম কারণটা আইন-কানুন ও বিচার বিভাগের সঠিক প্রয়োগ এবং সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও বণ্টনব্যবস্থাও তাদের সামাজিক অপরাধের অনেক সমস্যারই সমাধান করে দেয়; হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত খুব একটা গড়ায় না।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
আমাদের দেশে হত্যাকাণ্ডের যে মোটিভ তাতে পরিষ্কার উঠে আসে দাম্পত্য কলহ, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ, পরকীয়া, যৌতুক, মাদকের মতো বিষয়গুলো। রাজনৈতিক তো আছেই। আর এর প্রতিটি বিষয় আলাদা করে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় আমাদের সমাজব্যবস্থা, শিক্ষা, ধর্ম, আইন- সব কিছুই এর জন্য দায়ী। এর প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে না পারলে এসব হত্যাকাণ্ড নির্মূল করা ততটা সহজ হবে না। মূল সমস্যা এড়িয়ে সমাধান কখনই টেকসই হয় না। আর এই পরিবর্তন আনার দায়িত্ব প্রথমত এ রাষ্ট্রের। এর পরে দায়িত্ব পরিবারের। বিচারব্যবস্থা সঠিক হলে সমস্যা কমতে বাধ্য।
ভাবুন একবার- চব্বিশ বছরের কোনো নারী নিজ বাবা-মা-বোনকে হত্যা করে পুলিশ ডাকে এই বলে যে, ‘তিনজনকে খুন করেছি, তাড়াতাড়ি আসেন, না হলে আরও দুজনকে খুন করব’। আমরা হয়তো ভাবছি সুস্থ মাথার কেউ এরকমটি করতে পারে না; কিন্তু মেয়েটি খুব শান্তভাবেই এসব স্বীকার করেছে। তার মধ্যে মস্তিষ্ক বিকৃতির কোনো লক্ষণের কথা উঠে আসেনি। বরং বেশ পরিকল্পনা করেই নকশা এঁকেছে। শেষ না দেখে যদিও শেষ কথা বলা যাচ্ছে না, তার পরও এ ধরনের হত্যাকাণ্ড আমাদের নানা প্রশ্নের সম্মুখীন করে দেয়। আমাদের সমাজ, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, আমাদের রাষ্ট্র- সবাইকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করায়।
যারা হত্যাকাণ্ডের মামলাগুলো নিয়ে কাজ করেন, তাদের ভাষ্যমতে- দীর্ঘ সময় ধরে বিচারকার্য চলতে থাকার কারণে পারিবারিক সমঝোতার মাধ্যমেই এসব হত্যাকাণ্ডের সুরাহা হয়ে যায়। ফলে অপরাধী কোনো না কোনোভাবে মুক্তি পেয়ে যায়। সমাজে যার প্রভাব মোটেই সুখকর নয়। বিচার কাজগুলো যদি অল্প সময়ের ভেতর সমাপ্ত হওয়ার রেকর্ড থাকত এবং প্রকৃত অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নিশ্চয়তা থাকত তা হলে সমাজে অপরাধের বিস্তার ঠেকানো নিশ্চয়ই সম্ভব হতো। বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ বিভাগের তথ্যমতে- বছরে মোট হত্যাকাণ্ডের ৪০ শতাংশই হলো পারিবারিক হত্যাকাণ্ড।
তবে যে যা-ই বলুক, আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হওয়া অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন হলে খুব ধীরে ধীরে অন্য বিষয়গুলোও অনেকাংশে পরিবর্তন হয়ে যাবে। স্কুল-কলেজের পাঠ্যবইয়ে দুধের সঙ্গে পানি মিশিয়ে লাভের হিসাব না শিখিয়ে মানবিক হওয়ার শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সৌজন্যবোধ, ভদ্রতা, সহিষ্ণুতা ইত্যাদি বিষয়গুলোও যেন চর্চা করা যায়, সেভাবেই পাঠ্যসূচি তৈরি করা এখন জরুরি। সবচেয়ে জরুরি পরিবারে নৈতিক শিক্ষার চর্চা।
আরও পড়ুন:
দিকে দিকে মাফিয়াতন্ত্র-২
গণমাধ্যমে প্রকাশ- নভেম্বরেই দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৩৫৮টি। এর মধ্যে ৪৩টি ধর্ষণের ঘটনা, ৮টি সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও ধর্ষণের পরে দুই নারীকে হত্যা। পরের দিকে একটু কমে এলেও এখনো উদ্বেগজনক। রিপোর্টে বলা হয়- নারী ও শিশু নির্যাতনের সহিংসতারোধে দেশে কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও অপরাধ দমন ও নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্টদের কার্যকর ভূমিকা দেখা যায় না। আসলে নারী নির্যাতনরোধে পারিবারিক ও সামাজিকভাবেও সচেতন হওয়া অত্যন্ত জরুরি। প্রতিটি নাগরিক এ বিষয়ে সচেতন হলে নির্যাতনের হার নিশ্চয়ই শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে।
আনোয়ারা আজাদ : কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক