নতুন চিন্তাভাবনায় প্রিমিয়ার লিগ কতটা আশাবাদী

ইকরামউজ্জমান
১২ জানুয়ারী ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
নতুন চিন্তাভাবনায় প্রিমিয়ার লিগ কতটা আশাবাদী

২০০৭ সাল থেকে শুরু হয়েছে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ। পেশাদার ফুটবল আসর। চলমান ২০২৩-২৪ লিগ হলো ১৬তম ফুটবল উৎসব। এবারের লিগের স্পন্সর এবিজি বসুন্ধরা গ্রুপ। অনেকগুলো মৌসুম পেরিয়ে আসার পর এবারই প্রথম কয়েকটি বাস্তবধর্মী চিন্তাভাবনা, পরিকল্পনা এবং যৌক্তিক পরিবর্তনকে বাস্তবে বাস্তবায়িত করার পাশাপাশি দায়বদ্ধতা, জবাবদিহিতা এবং সুশাসন নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে দশটি দল নিয়ে প্রিমিয়ার লিগের খেলা মাঠে গড়িয়েছে। খেলা হচ্ছে পাঁচটি ভ্যানুতে ‘হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে’ পদ্ধতিতে। তবে সুন্দর ফুটবল উপযোগী মসৃণ মাঠ বসুন্ধরা কিংস অ্যারেনা (২০২২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়েছে) ছাড়া একটিও নেই। ফুটবল লিগ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার ক্ষেত্রে এটি ফুটবল ফেডারেশন এবং পেশাদার লিগ কমিটির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রাক্তন ফুটবলার সালাম মুর্শেদীকে সরিয়ে পেশাদার লিগ কমিটির দায়িত্ব নেন ফুটবল ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট কাজী সালাউদ্দিন। ১৪ মাস পর ২০২৩ সালের ৩০ নভেম্বর তিনি দায়িত্ব ছাড়েন। এর পর লিগ কমিটির চতুর্থ চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সহসভাপতি, দেশের সবচেয়ে সফল ক্লাব বসুন্ধরা কিংসের সভাপতি এবং ঢাকা মহানগরী লিগ কমিটির প্রধান ইমরুল হাসানকে।

বাফুফের সভাপতি মিডিয়াকে বলেছেন, প্রিমিয়ার লিগ পরিচালনা বিশাল কাজ। এখানে পূর্ণ মনোযোগ প্রয়োজন। সভাপতি হিসেবে সেটা আমার জন্য কঠিন। আমি মনে করি ইমরুল হাসান অনেক দক্ষ, ফুটবলের প্রতি তার অনুরাগ অনেক বেশি, এ সময়ে তার চেয়ে যোগ্য কেউ নেই এ পদের জন্য। তিনি টিমওয়ার্কে বিশ্বাসী এবং রিজান্ট ওরিয়েন্টটেড। উদ্যোগী সংগঠক হিসেবে তার পরিচিতি আছে।

দায়িত্ব পাওয়ার পর ইমরুল হাসান বলেছেন ‘আমি আমার কাজে নিরপেক্ষতা দেখাব।’ মিডিয়াকে বলেছেন, সংস্কার দরকার ফুটবল ফেডারেশনের চিন্তাভাবনা ও পরিকল্পনায়। আধুনিকতার সঙ্গে তাল মেলাতে গেলে আমাদেরও বিশ্ব ফুটবলের দলবদলের সময়টাকে আলিঙ্গন করতে হবে। সেটা হয় না বলে ক্লাবগুলো ইচ্ছা থাকলেও ভালো মানের বিদেশি খেলোয়াড় আনতে পারে না। আবার মৌসুম ঠিকঠাক না হলে বা পেছালে ক্লাবগুলোকে বাড়তি টাকা গুনতে হয় বিদেশি ফুটবলারদের জন্য। তাই মৌসুম এবং দলবদলের সময় প্রতিবছর যেন একই থাকে, সেই উদ্যোগ নেওয়া খুব জরুরি। বাফুফের চেয়ারে বসে নিজেদের নানা স্বার্থ বা ক্লাবের ঊর্ধ্বে উঠে বৃহত্তর ফুটবলের শুভ চিন্তা না করতে পারলে কাক্সিক্ষত শুভদিন ফিরবে না। ঘরোয়া আসরকে অর্থবহ এবং ফলপ্রসূ করতে হলে চিন্তার দৈন্য থেকে বেরিয়ে এসে পরিবর্তনের সপক্ষে মিছিলে সবাইকে অংশ নিতে হবে। আর এর জন্য স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে ফুটবলের বৃহত্তর স্বার্থে। পরিবর্তন আনার জন্য কাজ করতে হয়। পরিবর্তন আসতে সময় লাগতে পারে। তবে মন থেকে বিশ্বাস করতে হবে পরিবর্তন সম্ভব। পরিবর্তন সব সময়ই একটা লম্বা সফর।

আমরা বিশ্বাস করি প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলো যদি আরও ভালো ফুটবল উপহার দিতে পারে এতে করে মাঠে দর্শক বাড়বে। দর্শক খেলা দেখে খুশি হবে। বাড়বে ফুটবলের প্রতি টান এবং ভালোবাসা। বাড়বে ক্লাব সমর্থন এবং আনুগত্য। একটি সময়ে ঢাকার ফুটবল ছিল উত্তেজনার তুঙ্গে। ২৫-৩০ বছর ধরে ফুটবল আর সামাজিক জীবনে সেই ঢেউ তোলে না। তাই বলে মানুষ ফুটবল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তা কিন্তু নয়। এখনো ঘরোয়া ফুটবলের আসরে ক্রিকেটের ঘরোয়া আসর থেকে অনেক বেশি দর্শক সমাগম হয়। এখনো ফুটবল সাধারণ মানুষের নির্মল বিনোদনের প্রধান উৎস। ফুটবলে সচেতনতা বেড়েছে। বেড়েছে দর্শকদের রুচির মান। ভালো এবং খারাপ খেলার পার্থক্য তারা বোঝেন।

বাঙালির প্রিয় ফুটবল ঐতিহ্যের অধিকারী। কয়েক বছর ধরে সেই ফুটবল ধুঁকছে এটি মেনে নিতে হচ্ছে। ফুটবলের গৌরব ক্ষয়ে যাওয়ার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ আছে। আর এর দায় কিন্তু ফুটবলসংশ্লিষ্ট সবার। অর্থাৎ সংগঠক, খেলোয়াড়, প্রশিক্ষক, ক্লাব এবং ফুটবল ফেডারেশন। ফুটবল ঘিরে নেই সমষ্টিগত স্বপ্ন। নেই নৈতিক মূল্যবোধ। পারস্পরিক বিদ্বেষ, বিভাজন ক্ষমতার লড়াই ফুটবলকে সব সময় অস্থির করে রেখেছে। যুক্তিযুক্তপূর্ণ উদ্যোগেও সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে চান না। ফুটবল হারিয়ে ফেলেছে সহজাত ঔদার্য ও সহিষ্ণুতা। ফুটবলে নেই আদর্শিক অবস্থান। বিভিন্ন রকম অনৈতিক জালের মধ্যে আটকে আছে ফুটবল। দায় অস্বীকারের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হচ্ছে না বলেই ফুটবলে স্থিতি আসছে না। ফুটবল চত্বরে বিরাজ করছে সব সময় এক ধরনের অস্থিরতা। আর এই অস্থিরতার কালো মেঘ থেকে ফুটবলের সূর্য বের হতে পারছে না।

দেশে ফুটবলের অভিভাবক হলো ফুটবল ফেডারেশন। দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে ফেডারেশন ফুটবলের বৃহত্তর স্বার্থে বিভিন্ন উদ্যোগ এবং কর্মসূচিতেও ক্লাবগুলোকে আন্তরিকভাবে সঙ্গে পায় না। অথচ ক্লাব ফুটবল চর্চার আসল প্রাণ। ক্লাবগুলোই তো ফুটবলকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে দেশে দেশে। সুপ্ত প্রতিভাকে মেজে-ঘষে নতুন নতুন খেলোয়াড় সৃষ্টি করছে। আমাদের ফুটবল চত্বরে সাংগঠনিক দুর্বলতা, দূরদৃষ্টিতার অভাব এবং অযোগ্যতা ক্লাব থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে প্রকটভাবে লক্ষণীয়। আর এগুলো মোটা দাগে দেশের ফুটবল উত্তরণে অন্তরায় হিসেবে বলা হচ্ছে।

বছরের পর বছর ধরে গতানুগতিক ও বিশৃঙ্খলভাবে গড়ানো প্রিমিয়ার লিগকে আধুনিকতার সঙ্গে সম্পৃৃক্ত করে সময়ের চাহিদা পূরণ এবং মানুষের প্রত্যাশাকে বাস্তবায়িত করতে হলে সংশ্লিষ্ট মহলের সবার লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য হতে হবে এক ও অভিন্ন। নতুন উদ্যোগগুলোর উদ্দেশ্য হলো প্রিমিয়ার লিগের খেলাকে আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং আকর্ষণীয় করে তোলা। যাতে করে দর্শকরা স্বপ্রণোদিত হয়ে আবার অতীতের মতো মাঠে ছুটে আসেন।

দর্শকরা ফুটবলে পরিবর্তন দেখতে চান। দেখতে চান নতুন কিছু। আগেই উল্লেখ করেছি, ফুটবল নিয়ে তাদের ভাবনা-চিন্তা এবং প্রত্যাশা অন্যরকম। এ অবস্থায় অপেশাদার দৃষ্টিভঙ্গি আর অযত্নে ফুটবল চলতে পারে না। ফুটবলে মানুষ দেখতে চাচ্ছেন পরিবর্তন আর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পরিকল্পনার বাস্তবায়ন। খেলাটি আবার হৃদয় থেকে হৃদয়ে দাগ কাটুক। পেশাদার ফুটবল লিগ পরিচালিত হোক শৃঙ্খলা, যুগোপযোগী এবং ন্যায়নিষ্ঠভাবে।

ইমরুল হাসানের লিগ কমিটি এবার নতুনত্বের মাধ্যমে লিগ শুরু করেছে। এত বছর ধরে লিগ শুরু হয়েছে বর্তমান চ্যাম্পিয়নের সঙ্গে সর্বনিম্ন দলের ম্যাচ দিয়ে। এবার শুরু হয়েছে রীতিসিদ্ধতা ভেঙে দ্বৈবচয়ন সূচিতে। এতে করে লিগে শেষের দিকে পাতানো খেলার যে অপতৎপরতা নিয়ে প্রচুর কথাবার্তা হয় আশা করা যাচ্ছে এবার সেই ধরনের পরিস্থিতিতে উদ্বুদ্ধ হবে না। পাতানো ম্যাচ বন্ধের জন্য বিশেষ নজরদারি বাড়ানো হবে। মাঠে বিতর্কমুক্ত রেফারিং চান সবাই। রেফারিরা যাতে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেন এবং আইনের বাঁশি বাজান এজন্য এবার থেকে প্রতি ম্যাচে রেফারিকে পুরস্কৃত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রেফারি নির্বাচিত করবে রেফারিজ অ্যাসোসিয়েশন। লিগে প্রতি ম্যাচে দেওয়া হচ্ছে সেরা ফুটবলারের পুরস্কার। প্রতি রাউন্ডের সেরা খেলোয়াড়ও নির্বাচন করা হবে। এতে ভোট দিতে পারবে দর্শকরা। তৈরি করা হয়েছে একটি ওয়েবসাইট। এই ওয়েবসাইটে লিগের সব খবর এবং তথ্য পরিবেশিত হবে। লিগের দ্বিতীয় পর্ব শুরুর আগেই আগামী মৌসুমের সূচি এবার দিয়ে দেবে লিগ কমিটি যাতে ক্লাবগুলো প্রস্তুতি নিতে পারে। এবার থেকে প্রতিটি খেলার পর পর ম্যাচ কমিশনারের রিপোর্ট অংশগ্রহণকারী দলের ম্যানেজাররা পাচ্ছেন, এতে করে কটা হলুদ কার্ড, কটি লাল কার্ড এবং গোলসহ সব তথ্য তারা দুই ঘণ্টার মধ্যে হাতে পাচ্ছেন। অতীতের মতো লুকোচুরি খেলা বন্ধ হয়েছে। একটি সূত্র জানিয়েছে, লিগ কমিটি স্বাধীনতা, ফেডারেশন কাপ এবং লিগ ছাড়াও আরেকটি টুর্নামেন্টের কথা ভাবছে। এই টুর্নামেন্টে শুধু স্থানীয় খেলোয়াড়রা অংশ নিতে পারবেন। এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে এটি হবে দেশের ফুটবলে ইতিবাচক ঘটনা। ২০২৩-২৪ মৌসুমের ফুটবল জমে উঠুক। ফুটবলকে ঘিরে মানুষের আস্থা বাড়ুক।


ইকরামউজ্জমান : কলাম লেখক ও বিশ্লেষক; সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি, এআইপিএস এশিয়া; আজীবন সদস্য বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন; প্যানেল রাইটার ফুটবল এশিয়া