নববর্ষ উদযাপন ও আমাদের প্রতিজ্ঞা
প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই মানুষ দিন এবং সময়ের বৃহত্তর অংশের ওপর নজর রাখার জন্য বর্ষপঞ্জি তৈরি করেছিল। আদিম বর্ষপঞ্জিগুলো ছিল সাধারণত সৌরচান্দ্রিক। ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত প্রথম বর্ষপঞ্জিগুলো ব্রোঞ্জযুগের। সুমেরীয় বর্ষপঞ্জিটি ছিল প্রাচীনতম, তার পর মিশরীয় বর্ষপঞ্জি, অ্যাসিরীয় বর্ষপঞ্জি এবং এলামাইট বর্ষপঞ্জি। বর্তমানে পৃথিবীর সর্বত্র গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে জুলীয় বর্ষপঞ্জি, হিব্রু বর্ষপঞ্জি, ইসলামি বর্ষপঞ্জি, বিভিন্ন হিন্দু বর্ষপঞ্জি, পার্সি বর্ষপঞ্জি ইত্যাদি বিভিন্ন মধ্যযুগীয় বা প্রাচীন বর্ষপঞ্জি রয়েছে; যেগুলো ধর্মীয় বা সামাজিক উদ্দেশ্যে আঞ্চলিকভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এ ছাড়া বিভিন্ন আধুনিক বর্ষপঞ্জি রয়েছে, যেগুলোর সীমিত ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়; যেমন জাভান বর্ষপঞ্জি, জোক্যো বর্ষপঞ্জি, ফরাসি প্রজাতান্ত্রিক বর্ষপঞ্জি, বাহাই বর্ষপঞ্জি, সৌর হিজরি বর্ষপঞ্জি, পাটাফিজিক্যাল বর্ষপঞ্জি, জুচে বর্ষপঞ্জি।
১৫৫৬ সালের ১০ মার্চ থেকে সম্রাট আকবর কর্তৃক প্রবর্তিত বঙ্গাব্দ এবং ১৫৮২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরীর আদেশানুসারে প্রচলিত গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি বা খ্রিস্টীয় দিনপঞ্জিকা এ দুটোই আমরা ব্যবহার করে থাকি। পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ। বঙ্গাব্দের প্রথম দিন। বাঙালি জাতির ঐতিহ্যবাহী সর্বজনীন লোক উৎসবের দিন। ১ জানুয়ারি বিশ্বব্যাপী ইংরেজি নববর্ষ হিসেবে পালিত হয়ে থাকে। আমরাও সাড়ম্বরে ইংরেজি নববর্ষ পালন করে থাকি। পৃথিবীর সর্বত্রই নববর্ষ একটি ট্র্যাডিশন বা প্রচলিত সংস্কৃতিধারা। এদিন আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেওয়া হয় নতুন বছরকে। অতীতের ভুল-ত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদযাপিত হয় নববর্ষ। কবিগুরু নববর্ষকে আহ্বান জানান এই বলে ‘হে নূতন, এসো তুমি সম্পূর্ণ গগন পূর্ণ করি পুঞ্জ পুঞ্জ রূপে’। আমরাও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলার। নিশ্চয়ই আমাদের এ প্রতিজ্ঞা সীমাবদ্ধ থাকে না একটি বর্ষের মধ্যে। আমাদের ঐকান্তিক ইচ্ছা শুধুই এগিয়ে যাওয়া। কেবল সময়কে অতিক্রম করা নয়। বরং সময়ের সদ্ব্যবহার করে উন্নতির সোপান বেয়ে সর্বোচ্চ শৃঙ্গে আরোহণ করাই আমাদের লক্ষ্য।
সর্বপ্রথম ফ্রান্সের নিকোলাস জোসেফ নট কর্তৃক ১৭৬৯ সালে মোটরচালিত গাড়ি তৈরির আগেও মানুষ যাতায়াত ও মালামাল পরিবহনের জন্য যানবাহন ব্যবহার করত। মানুষ বা পশু দ্বারা চালিত যানবাহন ছাড়াও কেবল উট, ঘোড়া, গাধা বা অন্য কোনো পশুকেও এ কাজে ব্যবহার করা হতো। আধুনিককালে স্থলপথ, জলপথ এবং আকাশপথে অত্যাধুনিক কত যানযাহন চলাচল করছে! একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তার গতি। চীনে ঘণ্টায় ৬০০ কিলোমিটার গতিসম্পন্ন ম্যাগলেভ বুলেট ট্রেন চলাচল ছাড়াও আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে শব্দের চেয়ে পাঁচগুণ দ্রুতগতির সুপারসোনিক বিমান নির্মাণের কাজ চলছে। অথচ নট-এর বাষ্পচালিত ত্রিচক্রযানটি ঘণ্টায় ৩.৬ কিলোমিটার চলতে পারত। তাও আবার একটানা ২০ মিনিট। এর পর ২০ মিনিট থেমে আবার চলতে হতো। ভাবাই যায় না, আমাদের এগিয়ে চলার গতি কত দ্রুততর।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
হ্যাঁ, যানবাহনের গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরাও এগিয়ে চলেছি সম্মুখপানে। বীরদর্পে। মানুষগুলোর সৃষ্টিও যেন সামনে এগিয়ে চলার জন্য। আমাদের চোখ-মুখ, নাক-কান, হাত-পায়ের অবস্থান এবং গঠনও প্রাসঙ্গিক। তাই আমাদের দৃষ্টিও সামনের দিকে প্রসারমান। ইচ্ছা-আকাক্সক্ষা সব এগিয়ে চলার। সব যানবাহনও এগিয়ে চলে সামনে। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মেই আমরা নিরন্তর এগিয়ে চলেছি। আমাদের সমাজ, আমাদের অর্থনীতি, আমাদের শিক্ষা, আমাদের চিকিৎসা, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, আমাদের জীবনযাত্রা, আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা সব এগিয়ে চলছে। এই এগিয়ে চলাটা হলো প্রকৃত অর্থে অবস্থার পরিবর্তন। আর এই আবশ্যিক পরিবর্তিত অবস্থার গর্বিত নামকরণ আধুনিকতা। আমরা এরই ধারাবাহিকতায় প্রতিনিয়ত আধুনিক থেকে আধুনিকতর হচ্ছি। সবাই এই আধুনিকতার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছি বা নেওয়ার চেষ্টা করছি অথবা মেনে নিচ্ছি। কেউ মানিয়ে নিতে বা মেনে নিতে ব্যর্থ হলে পরিণত হচ্ছি বুদ্ধিহীন দলছুট অচল মানুষে।
স্থলপথে যানবাহনের জন্য সুনির্দিষ্ট সড়ক ও রেলপথ থাকলেও অনেকে হয়তো মনে করতে পারেন জলপথ বা আকাশপথে সুনির্দিষ্ট কোনো রুট নেই। প্রকৃত অর্থে জলপথ ও আকাশপথে দৃশ্যত কোনো সড়ক না থাকলেও সব পথেই যানবাহনের সুনির্দিষ্ট রাস্তা বা রুট রয়েছে, যাকে অবলম্বন করে আমরা পৌঁছে যাই নির্দিষ্ট গন্তব্যে; অর্থাৎ লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য বাস্তব প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট পথ। আবার লক্ষ্যহীন যাত্রা মানেই নিশ্চিতরূপে বিভ্রান্তির অতলে নিঃসাড় তলিয়ে যাওয়া। আমরা নিশ্চয়ই মহাবিশ্বের বিশালতায় লক্ষ্যহীন উ™£ান্ত হতে চাই না। প্রশ্ন হলো, আমরা কি জানি সত্যিই আমরা কোথায় যেতে চাই? কতদূর যেতে চাই? কত কম সময়ে যেতে চাই? কোন পথে যেতে চাই? যদি আমরা গন্তব্যহীন শুধুই এগিয়ে যেতে চাই; সে ক্ষেত্রে হয়তো দেখা যাবে ক্লান্তিহীন পথচলায় অচেনা পথ পাড়ি দিয়ে এক সময় আমরা পৌঁছে গেছি নরকের দ্বারপ্রান্তে। আগন্তুকরূপে। অবশ্য এটাও ঠিক, আমাদের অনিবার্য গন্তব্য মৃত্যু। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডও এগিয়ে চলেছে নিশ্চিত ধ্বংসের দিকে। তবে আমাদের ইহজাগতিক লক্ষ্য কখনই তা নয়। আমরা চাই সুন্দর আগামীর অনন্য পৃথিবী। যেখানে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ নেই, অত্যাচার-অবিচার নেই, খাদ্যের জন্য হাহাকার নেই, বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ নেই, চলাফেরায় অযাচিত প্রতিবন্ধকতা নেই, জীবনের অনিশ্চয়তা নেই, নিরাপত্তার কমতি নেই, চিকিৎসার অপ্রতুলতা নেই, শিক্ষার সুযোগের অভাব নেই, সামাজিক অবক্ষয় নেই। সব নেই-এর মাঝে আছে শুধু সুখানুভূতির অপার দ্যোতনা।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
এটি অনস্বীকার্য যে, লক্ষ্যহীন পথ আর পথহীন লক্ষ্য সর্বদাই নিষ্ফল, অকার্যকর। প্রকৃত অর্জনের মাধ্যমে নিজেদের পরিপূর্ণ করে তুলতে প্রয়োজন এ দুইয়ের শ্রেষ্ঠ সুসঙ্গতি বা রাজযোটক। শুধু এগিয়ে চলার গতি নয়, নববর্ষে রাজযোটকের সন্ধানই হোক আমাদের প্রতিজ্ঞা। তবেই আগামী পৃথিবী আমাদের জন্য হয়ে উঠবে অনন্য।
আরও পড়ুন:
দিকে দিকে মাফিয়াতন্ত্র-২
শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ : সচিব, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয়