স্মার্ট ডিভাইস বনাম বর্তমান প্রজন্ম
মানুষের মধ্যে ত্বরিত যোগাযোগের প্রতিশ্রুতির নাম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। তবে অনেক তরুণ-তরুণীর কাছে এটি এখন ভিন্ন কিছু। এর কারণে তরুণদের মধ্যে বাড়ছে একাকিত্ব। আইফোনে আসক্ত তরুণ এ প্রজন্মকে বলা হচ্ছে আইজেন। দ্য আটলান্টিকের এক প্রতিবেদনে এ প্রজন্মের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর স্মার্টফোনের প্রভাবের বিষয়টি উঠে এসেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখনকার কিশোররা বন্ধুর সান্নিধ্যে কম সময় কাটায়, তাদের মধ্যে ডেটিং কমছে, এমনকি পুরো প্রজন্মের ঘুম কম হচ্ছে। একাকিত্বের এই হার বাড়ায় সাইবার নিপীড়ন, হতাশা, উদ্বেগ এবং আত্মহত্যার ঘটনা বাড়ছে। ‘হ্যাভ স্মার্টফোনস ডেস্ট্রয়েড আ জেনারেশন’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে আইজেন প্রজন্মের খুঁটিনাটি তুলে ধরেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সান ডিয়েগো বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিদ্যার অধ্যাপক জিন টুয়েঙ্গে। প্রজন্মের সঙ্গে প্রজন্মের ফারাক সহজেই চোখে পড়ে। আশির দশকের এক তরুণের পক্ষে বাবা-মাকে বাদ দিয়ে শুধু বন্ধুদের সঙ্গে কয়েক ঘণ্টা শপিংমলে ঘুরতে পারা ছিল কল্পনার বিষয়। এখনকার পাশ্চাত্য কিশোর-কিশোরীরা বন্ধুর সঙ্গে শপিংমলে ঘুরে বেড়ায় স্বচ্ছন্দেই। বাবা-মায়ের সঙ্গেও যদি যায়, তবে ফোন-ট্যাব নিয়ে এতটাই দূরত্ব রাখে যেন ওই যন্ত্রের মধ্যেই আটকে আছে সে। প্রতি মুহূর্তেই চোখ রাখতে হয় পর্দায়। অ্যাথেনা বন্ধুদের সঙ্গে স্মার্টফোনেই সময় কাটায় বেশি। স্ন্যাপচ্যাটে বার্তা দেওয়া-নেওয়া চলতে থাকে। কিন্তু আশির দশকের এক তরুণের কথা চিন্তা করুন, বাসার একমাত্র ল্যান্ডফোনে বন্ধুর সঙ্গে একটু গল্প করার জন্য তাদের কত অপেক্ষায় থাকতে হতো! কমবেশি সবারই প্রযুক্তি পণ্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এটা পুরনো অনেক কিছুকে শেষ করে দেয়। সাম্প্রতিক দশকগুলোয় স্মার্টফোন হলো তার জ্বলন্ত উদাহরণ। আক্ষরিক অর্থে নিলে এটা এরই মধ্যে শতাধিক পণ্যের বাজার ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। নিজেদের পারিবারিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শিক্ষা থেকে ক্রমেই দূরে সরতে থাকে। উদ্ভট ও বিকৃত আচরণকারী ব্যক্তিরা তাদের মডেল বা আইকনে পরিণত হয়। এতে কর্মজীবনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণকালে তাদের অনেকেই বসবাস করতে শুরু করে কল্পনার জগতে। পরিবার ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে নৈতিকতা বা মূল্যবোধ শেখা থেকে হয় বঞ্চিত। তদুপরি তাদের শারীরিক ও মানসিক চাপ নেওয়ার ক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে। অল্পতেই আবেগপ্রবণ হওয়ার প্রবণতা বাড়ে। সামান্য ঘটনায় রেগে যাওয়া বা কান্না করতে দেখা যায়। অনেকে অভিমানে আত্মহত্যার মতো বড় দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে। অন্যদের ডিপ্রেশনে ভোগা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়। কেউ বা হয় মাদকে আসক্ত। অনেকেই হয়ে পড়ে বেপরোয়া জীবনযাপনে অভ্যস্ত। শিশুরা পরস্পর মিলেমিশে ও দলবদ্ধ হয়ে কাজ করতে শেখাটা খুবই দরকারি। কিন্তু তার জন্য স্কুলের অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও অভিভাবকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি। গত এক দশকে শিশুদের বড় করার ধরন ক্রমাগত পরিবর্তন হয়েছে। একই সঙ্গে পাঠ্যসূচি ও সংস্কৃতির পরিবর্তনের মতো বিষয়গুলোও প্রভাব ফেলেছে। তবে স্মার্টফোন ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম যেন ভূমিকম্প তৈরি করেছে। তরুণদের হাতে স্মার্টফোন আসার ফলে এর প্রভাবে তাদের অসুখী করে তুলছে। এমনকি পশ্চিমের কিশোর-তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ডেটিংয়ের প্রবণতা কমে গেছে। বেড়ে গেছে একাকিত্ব, হতাশা। সামাজিক মাধ্যম, মানে ফেসবুক, স্ন্যাপচ্যাট, টুইটার এসব তাৎক্ষণিক যোগাযোগের প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু একের পর এক প্রমাণ দেখাচ্ছে, অনেক কিশোর-কিশোরীর জন্য যত বেশি সামাজিক মাধ্যম, মানে তত বেশি বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি। মানসিকভাবে তারা মিলেনিয়াল প্রজন্মের চেয়ে বেশি নাজুক মনোভাবের পরিচয় দেয়। সৃজনশীল নানা ক্ষেত্রে যারা উল্লেখযোগ্য সফলতা পেয়েছেন তারা জীবনের প্রথম পর্যায়ে অমানুষিক পরিশ্রম করে, নানা ত্যাগ স্বীকার করে আজকের তারকা পর্যায়ে এসেছেন।
জীবনের একটা পর্যায় পর্যন্ত কেউ তাদের চিনত না। সেভাবে পাত্তা দিত না। তখন নীরবে-নিভৃতে তারা প্রত্যাশিত ক্ষেত্রে চর্চা ও সাধনা করে গেছেন। ফলে তারা যখন লাইমলাইটে এসেছেন তখন তা ক্যারি করতে সমস্যা হয়নি। তাদের সফলতা দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই হয়েছে। অনেকে জীবনভর নিরলস চেষ্টা ও সাধনায় সেই অর্জন অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। নানা প্রলোভন বা পরিবর্তিত পরিস্থিতি তাদের বিচ্যুত করতে পারেনি। অন্যদিকে কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই বা সহজে যারা সফলতা পান তাদের আর নিজেদের দক্ষতা ও যোগ্যতা বৃদ্ধির সুযোগ অবশিষ্ট থাকে না। প্রথমদিকে কিছু কাজ দিয়ে গ্রহণযোগ্যতা পেলেও ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারেন না। আবার নতুন কিছু শেখা বা সমৃদ্ধ হওয়ার মানসিকতাও থাকে না। ফলে তাদের তথাকথিত সেলিব্রেটি ইমেজ দ্রুতই পড়তে থাকে। পড়ালেখা, জ্ঞানার্জন, অধ্যবসায় তো আগেই বিদায় নেয়। ফলে এক সময় হতাশা তাদের নিত্যসঙ্গী হয়। নিজেকে স্টার ভেবে তেমন ব্যয়বহুল জীবনযাপনে সচেষ্ট থাকে। কিন্তু আয়-ইনকাম সেভাবে হয় না। তখন কেউ কেউ অন্ধকার গলিতে পা বাড়ায়। কেউ বা জড়িয়ে পড়ে নানা কেলেঙ্কারিতে। এভাবে বহু জীবন অকালে নষ্ট হয় মা-বাবার অতিরিক্ত লোভ বা সংশ্লিষ্টদের দূরদৃষ্টির অভাবে। তাই শক্তিশালী ডিভাইস হাতের নাগালে থাকলেই তার যথেচ্ছ ব্যবহারে সতর্ক হওয়া দরকার। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে হুমকির মুখে ফেলার আগেই বিষয়গুলো নিয়ে ভাবা জরুরি।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
রায়হান আহমেদ : গবেষক ও কলাম লেখক
আরও পড়ুন:
দিকে দিকে মাফিয়াতন্ত্র-২