রেফারি তৈরি, খেলোয়াড় নেই মাঠে
বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা খুব জনপ্রিয় স্লোগান ‘খেলা হবে’। এই স্লোগানের স্রষ্টা নারায়ণগঞ্জের আলোচিত-সমালোচিত সংসদ সদস্য শামীম ওসমান। পরে তার দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নারায়ণগঞ্জের আঞ্চলিক স্লোগানকে জাতীয় স্লোগানে পরিণত করেন। পরে স্লোগানটি আন্তর্জাতিক মর্যাদা পায়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও ‘খেলা হবে’ দারুণ জনপ্রিয়। ‘খেলা হবে’ আসলে স্লোগান নয়, প্রতিপক্ষের প্রতি এক ধরনের হুমকি। দায়িত্বশীল রাজনীতিবিদদের কণ্ঠে এ ধরনের স্লোগানে অনেকে আপত্তি করেছেন। রাজনীতিকে খেলার সঙ্গে তুলনা করা নিয়েও আপত্তি আছে কারও কারও। তবে এসব আপত্তিতে থোড়াই কেয়ার ওবায়দুল কাদেরের। গত ১৯ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত বিজয় দিবসের র্যালিতেও ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘খেলা হবে। কোনো ছাড়াছাড়ি নেই। ৭ জানুয়ারি ফাইনাল খেলা। বিএনপি নেই; তাদের একদফা ভুয়া, বিএনপি ভুয়া, ধানের শীষ ভুয়া। ফাইনাল খেলবে ১ হাজার ৮৯৬ জন। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন। যেখানে দল আছে ২৭টা। খেলার মাঠ বাংলাদেশ।’
যে যাই বলুক, রাজনীতির সঙ্গে খেলার দারুণ মিল আছে। খেলার মতো রাজনীতিতে, মানে নির্বাচনেও জয়-পরাজয় আছে। তবে খেলায় চ্যাম্পিয়নের সঙ্গে রানার্সআপও থাকে। কিন্তু নির্বাচনে দ্বিতীয় বলে কোনো কথা নেই। যিনি জয় পান, তিনি পুরোটাই জিতে নেন। জয়টা এক ভোটে হোক আর এক লাখ ভোটে।
ভালো ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের জন্য একজন ভালো রেফারি, সমতল মাঠ এবং সবার জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা জরুরি। নির্বাচন এলেই তাই ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিয়ে খুব আলোচনা হয়। নির্বাচনের মাঠে রেফারি হলো নির্বাচন কমিশন, আরও নির্দিষ্ট করে বললে প্রধান নির্বাচন কমিশনার। নির্বাচনের আগে আমরা অনেকগুলো বিশেষণ ব্যবহার করি ‘অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য।’ বাংলাদেশে সব ধরনের নির্বাচনই হতে পারে। কিন্তু গ্রহণযোগ্য কখনই নয়। কারণ আমাদের দেশে পরাজয় মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। নির্বাচন যত ভালোই হোক, পরাজিত দল তা মেনে নেবে না। আর এখন তো জয় নিশ্চিত না হলে কেউ নির্বাচনেই আসতে চায় না। দরকষাকষি করে আগেই জয় নিশ্চিত করতে চায়। তাই গ্রহণযোগ্য নির্বাচন বাংলাদেশে ডুমুরের ফুল বা অমাবস্যার চাঁদের মতোই। নির্বাচন কমিশন চাইলে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারে। নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক হবে কিনা, তা নির্ভর করে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। রেফারি মাঠ সমতল করে বসে থাকলেন, সব দল যদি খেলায় অংশ না নেয় রেফারির কী করার আছে? তিনি তো কাউকে জোর করে খেলায় নামাতে পারবেন না। যে কটি দল খেলায় নামবে রেফারিকে তো তাদের নিয়েই খেলা পরিচালনা করতে হবে। নির্বাচনেও তাই। বাংলাদেশে নিবন্ধিত ৪৪টি দলের মধ্যে ২৯টি এবার নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। তাও নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক বলা যাবে না, কারণ রাজপথের প্রধান বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। মূল প্রতিদ্বন্দ্বী অংশ না নিলে নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করে তোলাটাও কঠিন। যদিও আওয়ামী লীগ দলীয় বিদ্রোহীদের ছাড় দিয়ে মাঠে একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবহ তৈরির চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কতটা সফল হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েই গেছে।
বাংলাদেশে সবচেয়ে কণ্টকাকীর্ণ বোধহয় প্রধান নির্বাচন কমিশনারের আসনটি। নির্বাচন যত ভালোই হোক, প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে বিদায় নিতে হয় গ্লানি নিয়ে। শেষ পর্যন্ত তিনি ভিলেনই থাকেন। সংবিধানে থাকলেও বাংলাদেশে এতদিন নির্বাচন কমিশন গঠনের কোনো আইন ছিল না। এবারই প্রথম আইনের আওতায় নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে। কিন্তু বিএনপি এ গঠন প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়নি। তারা কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশনকে মেনেও নেয়নি। বিএনপি গঠন প্রক্রিয়ায় অংশ না নিলে তো বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনবিহীন থাকবে না। বিএনপি অংশ না নিলে তো নির্বাচন বসে থাকবে না। তাই নির্বাচন কমিশন সময়মতো তফসিল ঘোষণা করেছে। নির্ধারিত সময়েই ছেড়ে গেছে নির্বাচনের ট্রেন।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
নিরপেক্ষ বিবেচনায় নির্বাচন কমিশন বিরোধী দলের আস্থা অর্জনে আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। বারবার তাদের সংলাপে ডেকেছে। এমনকি ঘোষণার পরও বিএনপি এলে প্রয়োজনে তফসিল পেছানোর আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিএনপি আসেনি। এখন যারা এসেছে, তাদের নিয়ে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিকে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া কমিশনের হাতে আর কোনো বিকল্প নেই। এখন পর্যন্ত কমিশনের চেষ্টার কোনো কমতি নেই। নির্বাচন কমিশন তার মতো করে ডিসি, এসপিদের বদলি করেছে। নির্ধারিত সময়ের আগে প্রচারণা চালানোসহ আচরণবিধিভঙ্গের ঘটনায় সাকিব আল হাসানের মতো তারকা প্রার্থীকেও কমিশনের সামনে জবাবদিহি করতে হয়েছে। এই প্রথম সরকারি দলের পাঁচ প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন।
ইভিএম বা সিসিটিভির ব্যবস্থা করতে না পারলেও সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে কমিশনের আন্তরিকতার কোনো কমতি নেই। সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্তও হয়েছে। ব্যালট পেপার ছাপার কাজ শুরু হয়েছে। ২৫ ডিসেম্বরের পর ব্যালট পেপার জেলায় পাঠানো হবে। আর কেন্দ্রে পাঠানো হবে নির্বাচনের দিন মানে ৭ জানুয়ারি সকালে। কাজী হাবিবুল আউয়ালের কমিশনকে যথেষ্ট প্রস্তুতই মনে হচ্ছে। তবে নির্বাচন কমিশনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটা হলো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ। বিএনপি নির্বাচনে না এসে সরকার পতনের একদফা আন্দোলন করছে। গত ২৮ অক্টোবরের পর থেকে বিএনপির আন্দোলন সহিংস হয়েছে। শুরুর দিকে বাস-ট্রাক পোড়ালেও এখন তারা ট্রেনে আগুন দিয়ে মানুষ মারছে। দেশ যত নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাবে, বিএনপির সহিংসতা ততই বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিএনপি যে কোনো মূল্যে নির্বাচন ঠেকাতে চাইবে। তাই নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ করা গেলেও শান্তিপূর্ণ রাখা মুশকিল। নির্বাচন কমিশনকে এদিকটাতেই আরও বেশি নজর দিতে হবে। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যারা বাধা দেবে বা সহিংসতা সৃষ্টি করবে, তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিতে হবে।
বাংলাদেশ এখন নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। কিন্তু সমস্যা হলো, মাঠ প্রস্তুত, রেফারি তৈরি; কিন্তু শক্ত খেলোয়াড় নেই মাঠে। নির্বাচন যতই অবাধ, সুষ্ঠু হোক; ফলাফল অনেকটাই পূর্বনির্ধারিত। আওয়ামী লীগ চাইলেও হারতে পারবে না। মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বী যারা আছে, ঘুরেফিরে সবাই আওয়ামী লীগ মনোনীত। কিছু স্বতন্ত্র মাঠে আছে বটে, তবে তারাও দলের অলিখিত অনুমতি নিয়েই লড়ছে। অংশগ্রহণমূলক হচ্ছে না, প্রতিদ্বন্দ্বিতপূর্ণ হওয়ারও সম্ভাবনা নেই, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন তো কখনই সম্ভব নয়। এখন অপেক্ষা একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের। অন্তত এই চ্যালেঞ্জটায় যেন আউয়াল কমিশন জিততে পারে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
প্রভাষ আমিন : বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ