বিজয়ের মাসে নারী ফুটবলারদের সাফল্য
অগ্রহায়ণের হেমন্তরাঙা সোনালি অপরাহ্ণ গড়িয়ে সন্ধ্যা তৃপ্তি আর আনন্দের স্বাদে ভরপুর হয়ে উঠেছিল। নগরীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে, অনেক দূর পর পর ফিফা দুটি আন্তর্জাতিক প্রীতিম্যাচ দেখতে ছুটে গিয়েছি কমলাপুর স্টেডিয়ামে সিঙ্গাপুর জাতীয় নারী দলের বিপক্ষে। ম্যাচ দুটি (১ ও ৪ ডিসেম্বর) শুধু আশার জন্ম দেয়নি; অযথা বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক চিন্তা, আলোচনা ও কৌতূহল জিজ্ঞাসারও উত্তর দিয়েছে। সচেতন মহলের বক্তব্য হলো এখন সামনে তাকানোর সময়। দুটি খেলাতেই কয়েক হাজার দর্শক খেলা দেখে বাড়ি ফিরে গেছে ফুটবলের প্রতি আগ্রহ জানান দিয়ে। তবে নারী ফুটবলকে মিডিয়া তেমন গুরুত্ব দেয়নি। তারা ব্যস্ত ক্রিকেট নিয়ে।
বিজয়ের মাসে নারী জাতীয় ফুটবল দল দেশবাসীকে আন্তর্জাতিক ফুটবলে দাপুটে (প্রথম খেলায় ৩-০ ও দ্বিতীয় খেলায় ৮-০ গোলে পরাজিত। বাংলাদেশ দলের জালে সিঙ্গাপুর কোনো বল প্রবেশ করাতে পারেনি) জয়ের স্বাদ উপহার দিয়েছে। নারী জাতীয় দলের খেলোয়াড়, কোচ ও টিম ম্যানেজমেন্টকে অভিনন্দন ২০২৩ সালের মহান বিজয়ের মাসকে আরও রাঙানো এবং মহিমান্বিত করার জন্য। গত বছর জাতীয় নারী দল দক্ষিণ এশীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রমাণ করেছে আঞ্চলিক ফুটবলে বাংলাদেশ নারী দল সেরা।
স্বাধীন বাংলাদেশে বাঙালি জাতির ৫২ বছরের ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাসে নারী ফুটবল যেভাবে প্রতিকূল পরিবেশ ও পরিস্থিতির বিপক্ষে লড়াই করে মাঠে এসেছে, এটি সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে একটি বিপ্লব। উদ্যোমী ও সাহসীদের এই বিপ্লব পুরো জাতির মুখ উজ্জ্বল করেছে; জাতিকে স্বপ্ন দেখতে অনুপ্রাণিত করেছে; ফুটবলে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে।
লেবাননের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক ফিফা প্রীতিম্যাচ খেলার জন্য সব আয়োজন সম্পন্ন করার পরও খেলতে যাওয়া সম্ভব হয়নি সেখানকার বর্তমানে বিরাজমান অনিশ্চিত ও অশান্ত পরিবেশের জন্য।
র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশ ১৪২ আর সিঙ্গাপুর ১৩০। নারী ফুটবলে সিঙ্গাপুর ১২ ধাপ এগিয়ে আছে। দুই দেশের মধ্যে ফিফার দুটি আন্তর্জাতিক প্রীতিম্যাচ। কাগজ-কলমে একটি দলের সঙ্গে আরেকটি দলের পার্থক্য বোঝাতে গিয়ে র্যাংকিংয়ে কে এগিয়ে, কে পিছিয়ে আছে উল্লেখ করা হয়। খেলা তো হয় মাঠে। মাঠে যাদের ফিটনেস, স্ট্যামিনা, আত্মবিশ্বাস থাকে এবং যারা টেকনিক্যালি, ট্যাকটিকসের দিক থেকে সাউন্ড ও জয়ের ক্ষুধা ধারণ করেন, মাঠে সবাই মিলে পরিকল্পনামাফিক গোছানো ফুটবল খেলেন এবং গোলের সুযোগ কাজে লাগাতে পারেন- তারাই জয়ের মুখ দেখেন।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
বাংলাদেশ নারী দল প্রথম খেলায় জিতেছে ৩-০ গোলে। মাঠে লক্ষণীয় হয়েছে বুদ্ধিদীপ্ত পাস, দ্রুত জায়গা পরিবর্তন করে হাই প্লেসিং ফুটবল। হেড কোচ টিটুর স্বপ্ন সময়ের মধ্যে এগুলো অনেক বড় সাফল্য। বাংলাদেশ দল ৩-০ গোলে জিতেছে। তবে স্কোরলাইন আরও বড় হলে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। খেলা তো পুরোপুরি ডমিনেট করেছে স্বাগতিক দল। প্রথম তিন মিনিটের মধ্যে দলকে এগিয়ে দিয়েছেন (১-০) আফিফা খন্দকার তার ‘হেড’ গোলের মাধ্যমে। এর পর দুটি গোল করেছেন তহুরা। দল জিতেছে সম্মিলিত নৈপুণ্যের মাধ্যমে।
ছয় বছর আগে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ নারী দল সিঙ্গাপুর নারী দলের কাছে ৩-০ গোলে পরাজিত হয়েছিল। ওই তুলনায় এখনকার নারী জাতীয় দল অনেক বেশি শক্তিশালী ও ‘কমপেক্ট’ ফুটবল খেলে।
প্রথমবারের মতো নারী দল দক্ষিণ এশিয়া ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ২০২২ সালে। চলতি বছর জুলাইয়ে নেপালের বিপক্ষে দুটি ফিফা প্রীতিম্যাচে ড্র করেছে। এর পর প্রথমবারের মতো এশিয়ান গেমসের ফুটবলে অংশগ্রহণ। বাংলাদেশ এশিয়ান গেমসের গ্রুপ পর্যায়ের খেলায় ৮-০ গোলে পরাজিত হয়েছে জাপানের কাছে। জাপান তো অতীতে নারী বিশ্বকাপেও চ্যাম্পিয়ন হওয়া দল। জাপানের বিপক্ষে ৮-০ গোলে পরাজয় অস্বাভাবিক কিছু নয়। শক্তিশালী ভিয়েতনামের কাছে পরাজিত হয়েছে নারী দল। ভিয়েতনাম তিন বছর তাদের জাতীয় নারী দলকে একসঙ্গে প্রশিক্ষণ দিয়ে এশিয়ান গেমসের ফুটবলে নামিয়েছে। বাংলাদেশ ড্র করেছে গ্রুপের খেলায় (১-১) নেপালের বিপক্ষে। হেড কোচ সাইফুল বারী টিটু অল্প সময় পেয়েছেন দলটিকে মেজে-ঘষে মাঠে নামানোর। তিনি ফুটবল ‘সেন্স’ থেকে শুরু করে কিছু বিষয় নিয়ে হাতে পাওয়া সময়ের মধ্যে যতটুকু সম্ভব হয়েছে কাজ করেছেন। খেলোয়াড়রাও সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন কোচের চিন্তাকে আয়ত্ত করতে। তারা আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলেছেন।
কমলাপুর স্টেডিয়ামে প্রথম খেলা দেখার পর মনে হয়েছে, এশিয়ান গেমসের অভিজ্ঞতা নারী ফুটবলারদের কাজে লেগেছে। তাদের শারীরিক ভাষায় পরিবর্তন স্পষ্টভাবে লক্ষণীয় হয়েছে; বেড়েছে আত্মবিশ্বাস, সাহস ও মানসিক শক্তি। সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে বাংলাদেশ অনেক পরিপক্ব ও গোছানো ফুটবল খেলেছে। এতে সক্ষমতার পরীক্ষায় সহজেই উত্তীর্ণ হয়েছেন তারা।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
দ্বিতীয় ম্যাচের আগে কিছুটা অবাক হয়েই মাঠে গিয়েছি। মিডিয়ায় খেয়াল করেছি, নারী দল অবশ্যই জিততে চায়। তবে তাদের মনের মধ্যে এক ধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করছে দ্বিতীয় ম্যাচ ঘিরে। এটি কি গত বছর মালয়েশিয়ার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে ৬-০ গোলে জয়ের পর দ্বিতীয় ম্যাচে ড্র করার স্মৃতি তাড়া করছে!
শেষ পর্যন্ত হাজারো দর্শকের সামনে সিঙ্গাপুরের নারী দলকে ৮-০ গোলে পরাজিত করেছে স্বাগতিক নারী দল। প্রথমার্ধ পর্যন্ত বিজয়ী দল ৩-০ গোলে এগিয়ে ছিল। এত বেশি গোলের ব্যবধানে সিঙ্গাপুর পরাজিত হবে- এটি খেলোয়াড়, কোচ ও টিম ম্যানেজমেন্ট কেউ আগে ভাবতে পারেনি। তাই সবাই বেজায় খুশি। এর আগে ২০১০ সালের এ বিজয়ের মাসেই সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে ৯-০ গোলে ভুটানকে পরাজিত করেছিল বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল।
দ্বিতীয় ম্যাচের প্রথম ২৪ মিনিটের মধ্যে সফরকারী দলকে তিনটি গোল হজম করতে হয়েছে। ১৬ মিনিটের সময় প্রথম হেডের মাধ্যমে গোল করেন (১-০) তহুরা খাতুন। তিনি শেষ পর্যন্ত দুটি গোল করেছেন। এ ছাড়া পর্থা চাকমা দিয়েছেন দুটি গোল এবং সাবিনা খাতুন, সানজিদা আক্তার, মাতসুশিমা সুমাইয়া ও ছোট শামসুন্নাহার একটি করে গোল করেছেন।
নারী ফুটবলারদের এই বিজয় শুধু তাদের ফুটবলে নয়, পুরুষ ফুটবলেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আমরা খেয়াল করছি, পুরুষ জাতীয় দল এবং এএফসি ক্লাব চ্যাম্পিয়নশিপে বসুন্ধরা কিংসের সাফল্য দেশের ফুটবলে নতুন মাত্রা সংযোজিত করেছে। জাতীয় দল হোক আর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ক্লাব দল হোক- উভয়কে সব সময় আত্মোন্নয়নের পথ খুঁজতে হবে। দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা পারে দেশের ফুটবলকে আরও সমৃদ্ধ করতে।
আরও পড়ুন:
দিকে দিকে মাফিয়াতন্ত্র-২
ইকরামউজ্জমান : কলাম লেখক ও বিশ্লেষক; সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি, এআইপিএস এশিয়া; আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন (বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি)