জাতিকে মেধাশূন্য করতে নেমে আসে নিষ্ঠুর আঘাত

ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান
১৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
শেয়ার :
জাতিকে মেধাশূন্য করতে নেমে আসে নিষ্ঠুর আঘাত

১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। বাঙালি জাতির ইতিহাসে ঘৃণ্য কলঙ্কতম দিন। এক শোকাবহ দিন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয় যখন সুনিশ্চিত, সমগ্র বাঙালি জাতি যখন বিজয় উদযাপনের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকে ঠিক তখনই বাঙালির ওপর আসে আরেকটি নিষ্ঠুর আঘাত। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণির সব বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে। এই নৃশংস কাজে রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সদস্যরা তাদের প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেছিল। কারণ তারা চেয়েছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও যেন তাদের মেধাকে কাজে লাগিয়ে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে না পারে। হিংসা ও প্রতিশোধপরায়ণ চিন্তা-চেতনা থেকে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছিল।

২০২১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী’দের সংজ্ঞা চূড়ান্ত করা হয়। সংজ্ঞা অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২ পর্যন্ত সময়কালে যেসব বাঙালি সাহিত্যিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, রাজনীতিক, সমাজসেবী, সংস্কৃতিসেবী, চলচ্চিত্র, নাটক ও সংগীতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এবং এর ফলে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী কিংবা তাদের সহযোগীদের হাতে শহীদ কিংবা ওই সময়ে চিরতরে নিখোঁজ হয়েছেন, তারা শহীদ বুদ্ধিজীবী। চূড়ান্ত বিজয়ের প্রাক্কালে স্বাধীন বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করতে পরিকল্পিতভাবে সংঘটিত হয় এ হত্যাযজ্ঞ। পরে ঢাকার মিরপুর, রায়েরবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে গণকবরে তাদের মৃতদেহ পাওয়া যায়। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর নিকট-আত্মীয়রা মিরপুর ও রাজারবাগ বধ্যভূমিতে স্বজনের মৃতদেহ শনাক্ত করেন। অনেকের দেহে আঘাতের চিহ্ন, চোখ, হাত-পা বাঁধা, কারও কারও শরীরে একাধিক গুলি, অনেককে হত্যা করা হয়েছিল ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করে। হত্যার আগে তাদের নির্যাতন করা হয়েছিল সে তথ্যও বের হয়ে আসে। ২৫ মার্চ ’৭১ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ’৭১ পর্যন্ত বেশ কয়েকজন স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে প্রাণ হারান। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, ড. মুনীর চৌধুরী, ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ড. আনোয়ার পাশা, ড. আবুল খায়ের, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, ড. সিরাজুল হক খান, ড. এএনএম ফাইজুল মাহী, হুমায়ুন কবীর, রাশিদুল হাসান, সাজিদুল হাসান, ফজলুর রহমান খান, এনএম মনিরুজ্জামান এ মুকতাদির, শরাফত আলী, এ আর কে খাদেম, অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য, এমএ সাদেক, এম সাদত আলী, সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য, গিয়াসউদ্দিন আহমদ, এম মর্তুজা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. হবিবুর রহমান, ড. শ্রী সুখারঞ্জন সমাদ্দার, মীর আবদুল কাইউম।

চিকিৎসকদের মধ্যে অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ফজলে রাব্বি, অধ্যাপক ডা. আব্দুল আলিম চৌধুরী, অধ্যাপক ডা. শামসুদ্দীন আহমেদ, ডা. হুমায়ুন কবীর, ডা. আজহারুল হক, ডা. সোলায়মান খান, ডা. আয়শা বদেরা চৌধুরী, ডা. কসির উদ্দিন তালুকদার, ডা. মনসুর আলী, ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা, ডা. মফিজউদ্দীন খান, ডা. জাহাঙ্গীর, ডা. নুরুল ইমাম, ডা. এসকে লালা, ডা. হেমচন্দ্র বসাক, ডা. ওবায়দুল হক, ডা. আসাদুল হক, ডা. মোসাব্বের আহমেদ, ডা. আজহারুল হক, ডা. মোহাম্মদ শফী। সাংবাদিকদের মধ্যে শহীদুল্লাহ কায়সার, নিজামুদ্দীন আহমেদ, সেলিনা পারভীন, সিরাজুদ্দীন হোসেন, আ ন ম গোলাম মুস্তফা।

গীতিকার ও সুরকার আলতাফ মাহমুদ, রাজনীতিবিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, সমাজসেবক এবং দানবীর রণদাপ্রসাদ সাহা (আরপি সাহা), শিক্ষাবিদ, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক যোগেশ চন্দ্র ঘোষ, লেখক, কবি মেহেরুন্নেসা, শিক্ষাবিদ, গণিতজ্ঞ ড. আবুল কালাম আজাদ, আইনজীবী নজমুল হক সরকার ও সমাজসেবক, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক নূতন চন্দ্র সিংহ। এ ছাড়া ভাই শহীদুল্লা কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে ১৬ ডিসেম্বরের পর শহীদ হন চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান।

বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ’ (১৯৯৪) থেকে জানা যায়, ২৩২ জন বুদ্ধিজীবী নিহত হয়েছেন। তবে তালিকায় অসম্পূর্ণতার কথাও ওই গ্রন্থে স্বীকার করা হয়।

১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের ১৮, মতান্তরে ২৯ তারিখে বেসরকারিভাবে গঠিত বুদ্ধিজীবী নিধন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়নি। এরপর ‘বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটি’ গঠিত হয়। এই কমিটির প্রাথমিক রিপোর্টে বলা হয়, রাও ফরমান আলী এ দেশের ২০,০০০ বুদ্ধিজীবীকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু এই পরিকল্পনামতো হত্যাযজ্ঞ চলেনি। কারণ ফরমান আলীর লক্ষ্য ছিল শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদের গভর্নর হাউসে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা। বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটির প্রধান জহির রায়হান বলেছিলেন, ‘এরা নির্ভুলভাবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রমনস্ক বুদ্ধিজীবীদের বাছাই করে আঘাত হেনেছে।’ তবে ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি জহির রায়হান নিখোঁজ হন।

জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী জননেতা তাজউদ্দীন আহমদ একটি তদন্ত কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেন ১৯৭১ সালের ৩১ ডিসেম্বর। কিন্তু তার ওই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়নি। ১৯৭১ সালের ২৭ ডিসেম্বর দৈনিক আজাদের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পরিকল্পনাটি আগেই করা হয় আর এতে সহায়তা করে জামায়াতে ইসলামী ও এর ছাত্র সংগঠন ছাত্রসংঘ। এ হত্যাকাণ্ডে সবচেয়ে সক্রিয় ছিলেন ব্রি. জে. আসলাম, ক্যাপ্টেন তারেক, কর্নেল তাজ, কর্নেল তাহের, ভিসি প্রফেসর ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন, ড. মোহর আলী, আলবদরের এবিএম খালেক মজুমদার, আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাইনুদ্দিন, তাদের নেতৃত্ব দেয় মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী।

১৯৯৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনায় রমনা থানায় প্রথম মামলা দায়ের করা হয় (মামলা নম্বর ১৫)। সেখানে আলবদর বাহিনীর চৌধুরী মাইনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানকে আসামি করা হয়। মামলাটি দায়ের করেন অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিনের বোন ফরিদা বানু। প্রকৃতপক্ষে ১৯৭১ সালে বছরব্যাপী পাকিস্তান সেনাবাহিনী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। পরিকল্পিতভাবে ১৪ ডিসেম্বর সবচেয়ে বেশিসংখ্যক বুদ্ধিজীবী হত্যা করা হয়েছিল। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এই দিনকে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস’ ঘোষণা করেন।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে ঢাকার মিরপুরে প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়। স্মৃতিসৌধটির স্থপতি মোস্তফা হারুন কুদ্দুস হিলি। ১৯৯১ সালে ঢাকার রায়েরবাজারে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ নামে আরেকটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ শুরু হয়, যা ১৯৯৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর উদ্বোধন করেন তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। এর নকশা করেন জামী-আল সাফী ও ফরিদউদ্দিন আহমেদ।

পরিশেষে বলব, বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার মূল উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করে দেশকে পিছিয়ে রাখা। কিন্তু তাদের সেই উদ্দেশ্য সফল হয়নি। বাংলাদেশ আজ খাদ্য, শিক্ষা, অর্থনীতি, অবকাঠামো, যোগাযোগ মাধ্যম, প্রযুক্তিসহ সব বিষয় থেকেই পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার হাত ধরেই এই অসম্ভব অর্জন সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। তবে বাংলাদেশের এই সাফল্য ও অগ্রগতি বর্তমান সময়েও ধরে রাখা বিরাট চ্যালেঞ্জের বিষয়। কারণ দেশে এখনো স্বাধীনতাবিরোধী বিএনপি-জামায়াত জোট ও তাদের দোসররা সক্রিয়। তারা বাংলাদেশকে ব্যর্থ করতে এবং পাকিস্তানি ধ্যান-ধারণায় পরিচালিত করতে দেশে-বিদেশে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে যেতে হবে। তা হলেই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের রক্তদান, জীবনদান ও আত্মত্যাগের বিশাল ঋণের কিছুটা হলেও শোধ করা সম্ভব হবে।


অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান : কোষাধ্যক্ষ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও চেয়ারম্যান, বক্ষব্যাধি বিভাগ