গুজব অগ্নিসন্ত্রাসের চেয়েও ভয়ঙ্কর

আলহাজ্ব মো. মিজানুর হক খান
১৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ২১:১৮
শেয়ার :
গুজব অগ্নিসন্ত্রাসের চেয়েও ভয়ঙ্কর

‘গুজব’ শব্দটার সঙ্গে আমরা সবাই কম বেশি পরিচিত। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশে নানা কারণে নানা প্রকারের গুজব ছড়ানো হয়েছে। আর এই সবকিছুই ব্যবহার করা হয়েছে কোনো বিশেষ দলের বা মহলের নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির জন্য। 


গুজবে বিশ্বাস করার বিষয়টি শুধুমাত্র বাংলাদেশেই নয়, বরং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যুগে যুগে গুজবের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক দেশে গুজব সৃষ্টি করে যুদ্ধে জয়ী হয়েছে অনেকেই গুজবের কারণে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হারিয়েছে গুজব বা মিথ্যা রটিয়ে অনেকেই ইতিহাসে নায়ক হওয়ার চেস্টা করেছে ।


ইতিহাসের খলনায়ক এডলফ হিটলার মিথ্যাচার করতে একটি মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেন যার নাম দেন ‘মিনিস্ট্রি অব পাবলিক এনলাইটেনমেন্ট এন্ড প্রোপাগান্ডা’। আর এর প্রধান করেন তার সরকারের সাবেক তথ্যমন্ত্রী ‘দ্য লিটল ডক্টর’ নামে পরিচিত পল জোসেফ গোয়েবল্‌সকে (জার্মান উচ্চারণ ɡœbəls) । তিলকে তাল বানানোতে ওস্তাদ এই ব্যক্তি ছোটবেলা থেকেই দুর্বল স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন। তার ডান পা ছিল বাম পা অপেক্ষা মোটা এবং ছোট। আর এই শারীরিক অক্ষমতার জন্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তিনি সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে পারেননি। কিন্তু তিনি গুজব বা মিথ্যা প্রচার করে বিশ্বের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন।


বাংলাদেশে গুজব রটানোর প্রচলন সবসময় ছিল এখনো আছে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে সদ্য স্বাধীন এই দেশটি যখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যুদ্ধবিধ্বস্ত ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে সফলতার সঙ্গে অগ্রসর হচ্ছিল, ঠিক তখনই ১৯৭৪ সালে কুড়িগ্রামের বাসন্তী বালাকে মাছের জাল পরিয়ে সংবাদপত্রে ছবি ছাপানো হয়েছিল। বহুল আলোচিত ছবির ফটোগ্রাফার ছিলেন আফতাব আহমদ। পরবর্তীতে বেরিয়ে আসে ছবিটি ছিল সম্পূর্ণ সাজানো। বঙ্গবন্ধুকে ব্যর্থ প্রমাণ করতে বাসন্তী ও দুর্গতিকে নিয়ে প্রকাশিত সাজানো সেই ছবিটি ছিল হলুদ সাংবাদিকতা ও নোংরা রাজনীতির খেলা। এই ছবিটিতে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি এতটাই লাভবান হয়েছিল যে খালেদা জিয়া ১৯৭৪ সালেরহ দুর্ভিক্ষ পীড়িত চিলমারি বাসন্তী ছবির জন্য ২০০৬ সালে আফতাব আহমদেকে রাস্ট্রিয়ভাবে সম্মানিত করে একুশে পদক প্রদান করে পুরস্কৃত করেন।


জোসেফ গোয়েবলসের একটি বিখ্যাত উক্তি ছিল- ‘আপনি যদি একটি বিশাল মিথ্যা বলেন এবং সেটা বারবার সবার সামনে বলতে থাকেন, তাহলে মানুষজন একসময় সেটা বিশ্বাস করতে শুরু করবে’। বাংলাদেশে বিএনপি গোয়েবলসের তত্ত্বটি কাজে লাগানোর চেষ্টা করে।


১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাটে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন। বিএনপি প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান জীবদ্দশায় কোনোদিন নিজেকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেন নাই । ১৯৭৪ সালের ২৬ শে মার্চ সাপ্তাহিক বিচিত্রা ৪৩ তম সংখ্যায় ‘একটি জাতির জন্ম’ শিরোনামে জিয়াউর রহমানের নিজের লেখা ছাপা হয়। তিনি সেখানে লেখেন যে ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাটে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করেন। 


১৯৭৫ সালের বঙ্গবন্ধুর পরিবারের হত্যাকাণ্ড পরিকল্পনায় জিয়াউর রহমানের নীরব সম্মতি প্রদান এবং সমস্ত কিছু জেনেও কোন বাধা বা কাউকে অবহিত না করার কারণেই ১৫ আগস্ট বাংলাদেশে সবচেয়ে জঘন্যতম রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যায় সবচেয়ে লাভবান ব্যক্তি হচ্ছেন জিয়াউর রহমান। 


অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। গোলাম আযমকে বাংলাদেশ ফিরিয়ে আনেন ১৯৭৮ সালে, তার হাত ধরে যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে গঠন হয় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর। ইনডেমনিটি প্রাপ্তদের নিয়ে ১৯৮০ সালে গঠিত হয় ফ্রিডম পার্টি। স্বাধীনতা বিরোধী ও বঙ্গবন্ধুর খুনিরা জিয়াউর রহমানকে কৃতজ্ঞতা জানাতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কে বিতর্কিত ও বিভক্তি সৃষ্টি করার জন্য জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বানিয়ে প্রচার শুরু করেন।


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৌহিত্র ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়। ছবি: সংগৃহীত


১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জার্মানি থেকে বাংলাদেশে গিয়েছিলাম নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ করতে। আমার নির্বাচনী এলাকা মাদারীপুর-২ আসন থেকে আওয়ামী লীগের জোট থেকে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছিলেন আব্দুর রাজ্জাক। গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে যখন নৌকার পক্ষে ভোট চাইতে গেলাম তখন গ্রামের সাধারণ ভোটারদের কাছ থেকে কিছু কিছু অদ্ভুত প্রশ্ন শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম। বিশেষ করে নারী ভোটাররা বলতো বাবা নৌকায় ভোট দিলে দেশ নাকি ভারত হইয়া যাইবে মসজিদ নাকি মন্দির হইয়া যাইবে। পরে জানতে পারলাম কিছু সংঘবদ্ধ নারী বাড়ি বাড়ি গিয়ে নারীদেরকে কোরআন শরীফ ও তাসবীহ দিয়ে এগুলো প্রচার করছে। 


১৯৯১-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয় ছিল অপ্রত্যাশিত। কোনো পূর্বাভাসেই আওয়ামী লীগের পরাজয় কেউ প্রক্ষেপণ করতে পারেননি। ১৯৯১-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয় বড় কারণ ছিল ভারত বিরোধিতার নানারকম গুজব এবং মিথ্যাচার। যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি, যারা একাত্তরের বাংলাদেশের বিজয়কে কখনো মেনে নিতে পারেনি, তারাই পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশে ভারতবিরোধী গুজব সৃষ্টি করে ভারত বিরোধিতার মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে নিঃশেষ করা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করার একটি নীরব প্রচেষ্টা বাংলাদেশে দৃশ্যমান হয়েছে পঁচাত্তরের পর থেকে। সেই ধারা এখনো রয়েছে। 


কিছুদিন আগে দেশে গিয়েছিলাম। সৌভাগ্যক্রমে গণভবনে বঙ্গবন্ধুর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করার সুযোগ হয়েছিল। ফেসবুকের কল্যাণে অনেকেই জানতে পারে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে গণভবনে দেখা করেছি। একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে এক ভদ্রলোক আমাকে প্রশ্ন করেন ভাই গণভবনের ভিতরে তো ভারতীয় সেনাবাহিনী তারা কি বাংলায় কথা বলে না হিন্দিতে? আমি অবাক হয়ে তাকে প্রশ্ন করলাম- আপনাকে আমি শিক্ষিত সচেতন এবং একজন ভদ্রলোক হিসেবেই জানি আপনারা যদি গুজবে বিশ্বাস করেন তবে সাধারণ মানুষ কী করবে? আপনি একজন স্বাধীন দেশের নাগরিক। একজন স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রীকে অন্য দেশের সেনাবাহিনী নিরাপত্তা দেয় এটা কী করে ভাবলেন? তিনি আমাকে বললেন- তাহলে আপনি গণভবনের ভিতরে যাইতে পারেন নাই।


বঙ্গবন্ধুর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ স্বপ্নপূরণ করে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ এর স্বপ্ন দেখছে মানুষ।


ডিজিটাল বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১৩ কোটি। বাংলাদেশে বর্তমানে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ছয় কোটি। বিশ্বের ফেসবুক ব্যবহারকারীর দিক থেকে শীর্ষ তিনটি দেশের একটি হলো বাংলাদেশ। বর্তমান ডিজিটাল বাংলাদেশে গুজব ছড়ানো কোনো কঠিন বিষয় না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে মুহূর্তেই তিলকে তাল বানিয়ে পৌঁছে দেওয়া যায় হাজার হাজার মানুষের কাছে। 


বিএনপি-জামায়াত সরকার পতনের আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা না পেয়ে গুজবকেই তাদের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছে। বাংলাদেশ আগে শুধু ভারতের কাছে বিক্রি হয়ে যেত। এখন আর বিক্রি হয় না, এখন শুধু দেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে যায়। শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া হওয়ার আগে আমাদের দেশের অনেকেই জানতো না যে একটা দেশ যে দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে। দেশের রিজার্ভ সম্পর্কে আগ্রহী লোকের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। এখন বিএনপি বলে রিজার্ভ শেষ হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ৪ বিলিয়ন রিজার্ভ থেকে ৪৮ বিলিয়ন রিজার্ভে এনেছেন সেটা কেউ টেরই পেল না, কেউ জানতেও চাইলো না, কারো খবরও নাই। রিজার্ভ কমে যাওয়ায় দেশ দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে এমন গুজব ছড়ানো হলো বাংলাদেশের ব্যাংক নিয়ে। গুজবে কান দিয়ে হাজার হাজার গ্রাহক চার হাজার কোটি টাকা আমানত উঠিয়ে ফেলার পরেও একটা ব্যাংক দেউলিয়া হলো না! অথচ অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বিশ্বের অনেক বড় বড় ব্যাংক সিরিয়াল দিয়ে দেউলিয়া হয়ে গেল। 


জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গুজব নতুন কিছু নয়। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু পুত্র শেখ কামালকে নিয়েও গুজব ছড়ানো হয়েছিল। পরবর্তীতে সবকিছু মিথ্যা প্রমাণিত হয়। বঙ্গবন্ধু পরিবারের যিনিই পাদপ্রদীপের আলোতে আসবেন, তাকেই গুজব সন্ত্রাসের আক্রমণের শিকার হতে হবে, এটা যেন প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে দেশরত্ন জননেত্রী শেখ হাসিনার মহতি ভাবনার সারথি, সমৃদ্ধ আগামীর প্রতিচ্ছবি তরুণ প্রজন্মের আইকন সজীব ওয়াজেদ জয় দীর্ঘদিন ধরেই গুজব সন্ত্রাসের টার্গেটে পরিণত হয়েছেন। সজীব ওয়াজেদ জয়কে নিয়ে অসংখ্য গুজব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ ও কারণ ছাড়াই ফেসবুক ও ইউটিউবে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে এমন সব অদ্ভুত ভিডিও। এসব ভিডিও বেশিরভাগই তৈরি করা হচ্ছে দেশের বাইরে থেকে। সজীব ওয়াজেদ জয়ের সম্পদ যুক্তরাষ্ট্রে বাজেয়াপ্ত, ইন্টারপোলের মাধ্যমে সজীব ওয়াজেদ জয় গ্রেপ্তার, ভিসা নিষেধাজ্ঞায় জয়, জয়ের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের কড়া চিঠি, যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে পালিয়েছেন জয় এমন অনেক অপপ্রচার চালানো হয়েছে সামাজিক মাধ্যমে। দেশে ফিরে পরিকল্পিত গুজব ও প্রচারণার জবাব দিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৌহিত্র, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। শুধুমাত্র হীন রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য তাকে নিয়ে গুজব ছড়িয়েছিলো একটি মহল। 


গোয়েবলস উপলব্ধি করেছিলেন মিথ্যাকে ছড়িয়ে দেওয়া যায় কিন্তু প্রতিষ্ঠা করা যায় না। সত্যকে লুকিয়ে রাখা যায় কিন্তু বিলুপ্ত করা যায় না। ১৯৪৫ সালের ১মে গোয়েবলস তার মেয়ের জন্মদিনে প্রথমে তার ছয় সন্তান এবং স্ত্রীকে হত্যা করেন। পরে নিজেও তার প্রিয় নেতা হিটলারের পন্থা অবলম্বন করে আত্মহত্যা করেন আর বাসন্তিকে জাল পরিয়ে ছবি তুলে বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তি ক্ষুন্ণ করা কারিগর আফতাব আহমেদ ডাকাতদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন। 


বঙ্গবন্ধুর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়ন, সমৃদ্ধি ও নান্দনিকতার পথে বাংলাদেশ। এই উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার বড় বাধা অগ্নিসন্ত্রাস ও গুজব। গুজব ছড়ানো একটি মারাত্মক অপরাধ। এই অপরাধের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকে শক্ত হাতে ব্যবস্থা নিতে হবে। গড়ে তুলতে হবে সামাজিক প্রতিরোধ।


লেখক: সভাপতি, জার্মান আওয়ামী লীগ