অর্থনীতির তলানি : প্রবাসী হাইব্রিড পরামর্শক

মাহফুজুর রহমান
১২ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
শেয়ার :
অর্থনীতির তলানি : প্রবাসী হাইব্রিড পরামর্শক

একটি গল্প বলি। একজন অঙ্কের শিক্ষক নদী পার হবেন বলে নদীর তীরে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু পারাপারের নৌকার কোনো দেখা নেই। এরই মধ্যে তার এক ছাত্র এসে সালাম দিল। স্যার জিজ্ঞেস করলেন, নদীতে পানি কতটুকু?

ছাত্র বলল- স্যার, নদীতে একেক স্থানে একেক রকম পানি। কোথাও হাঁটু পানি, কোথাও কোমর পানি, কোথাও গলা পানি, কোথাও বা সাঁতার।

অঙ্ক স্যার পানির এই উচ্চতাগুলো একটি কাগজে লিখলেন। এর পর এগুলো যোগ করে ভাগ করে গড় বের করলেন। তিনি দেখলেন, নদীতে গড়ে পানি আছে লুঙ্গি ছুঁই ছুঁই পর্যন্ত। অর্থাৎ লুঙ্গি ভালো করে কাছা দিয়ে পানিতে নামলে লুঙ্গিটা ভিজি ভিজি করবে, পুরো ভিজবে না। বড় ঢেউ এলে সামান্য উঁকি দিয়ে থাকলে একদম নিরাপদ।

অঙ্ক স্যার লুঙ্গি কাছা দিয়ে নেমে গেলেন। নদীর শুরুতেই ছিল সাঁতার। অঙ্ক স্যারের গড় অঙ্ক কাজে লাগল না। তিনি ভিজে গেলেন।

বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে বর্তমানে প্রবাসী ‘অঙ্কের শিক্ষকরা’ এ ধরনের জ্ঞান বিতরণে বেশ উৎসাহ দেখাচ্ছেন। আমাদের অর্থনীতি সবিশেষ ঝঞ্ঝাপূর্ণ এ কথা কেউ অস্বীকার করছেন না। স্বয়ং গভর্নরও এ কথা অকপটে স্বীকার করে উত্তরণের পথ খুঁজছেন। তিনি স্বদেশে বসবাসকারী অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন, তাদের পরামর্শ চেয়েছেন। অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ তিনি কাজেও লাগিয়েছেন। সঙ্গত কারণেই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, টানেলের শেষপ্রান্তে তিনি আলোকরেখা দেখতে পাচ্ছেন। আগামী বছরের শুরুতে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।

এ কথা সত্য যে, আমাদের অর্থনীতিতে প্রবাসীদের অবদান অনস্বীকার্য। আমরা বিদেশ থেকে প্রেরিত বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স দেশের উন্নয়নে কাজে লাগিয়েছি। তাই তো প্রবাসী রেমিট্যান্স প্রেরকদের প্রতি আমাদের বিপুল ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। তাদের প্রতি এ শ্রদ্ধা বহাল রেখেই বলতে চাই, প্রবাসে কতিপয় জ্ঞানী লোকের বিনোদনের বিষয় হচ্ছে দেশের সরকারপ্রধানসহ দেশ পরিচালনাকারীদের সমালোচনা করা। এই সমালোচনার ধার থেকে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তাদের কেউই বাদ পড়েন না। উন্নত বিশ্বের নাগরিক হয়ে তারা বাংলাদেশের মতো পিছিয়ে থাকা দেশের কথা মনে করছেন দেখে আমাদের ভালোই লাগে। তাদের প্রতি আমার ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা।

প্রবাসে হাইব্রিড কতিপয় অর্থনীতিবিদ ও সমালোচক রয়েছেন- যারা নিয়মিত বাক্যবাণ (বাচনিক ও লিখিত) নিক্ষেপ করে তাদের জ্ঞানের গভীরতা প্রকাশ করতে সচেষ্ট থাকেন। আমি ‘সেফুদা’ নামক কুরুচিসম্পন্ন ব্যক্তির কথা বলছি না। কারণ তিনি আলোচনার যোগ্য ব্যক্তি নন। আমি বলছি অন্য অনেকের কথাÑ যারা তলায় খেয়েছেন এবং গাছের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। একজন ডক্টরেটধারী প্রবাসী ইউটিউবের মাধ্যমে নিয়মিত আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে তথাকথিত তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সরাসরি আক্রমণ করেন এবং অতিশয় ব্যঙ্গাত্মক ভাষা ও শ্লেষাত্মক স্বরে মনগড়া ব্যাখ্যা উপস্থিত করেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর নামটি পর্যন্ত শুদ্ধ করে উচ্চারণ করেন না। তার দেওয়া হাইব্রিড তথ্য ও ব্যাখ্যা শুনে সরকারের বিরোধী কতিপয় ব্যক্তি বেশ আনন্দ পেয়ে থাকেন এবং বলেন, আমাদের দল ক্ষমতায় এলে এ ভদ্রলোককে অর্থমন্ত্রী বানাতে হবে। বাংলাদেশের নির্বাচনী ডামাডোল বেজে ওঠার পর থেকে তিনি তেমন কোনো তথ্য প্রচার করেছেন বলে আমার জানা নেই। তা ছাড়া শেখ হাসিনা, তুমি পালাবে কোথায়? এ ধরনের আস্ফালনও বন্ধ রেখেছেন। এর কারণ সম্ভবত তার প্রিয় রাজনৈতিক দলটি নির্বাচনের বাইরে থাকায় ভদ্রলোকের মন্ত্রী হওয়ার খায়েশ ধুলায় লুটিয়ে গেছে।

ইদানীং মার্কিন প্রবাসী এক অর্থনীতিবিদ ও লেখক বাংলাদেশের দৈনিকে প্রায়ই নিবন্ধ লিখে তলিয়ে যাওয়া অর্থনীতির হাল ধরে থাকা সব মানুষের জ্ঞানহীনতার তথ্য উপস্থাপন করেন। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে প্রায়ই তিনি মার্কিন অর্থনীতির সঙ্গে তুলনা করেন। মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো বাংলাদেশ চোখ বন্ধ করে গ্রহণ না করায় নিন্দা করেন। তার লেখাগুলো পড়লে যে কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের অর্থনীতি, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং সরকারের যোগ্যতা ও ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে অসহায় বোধ করবেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের একটি সরল উক্তি নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত প্রবন্ধে তিনি কটাক্ষ করেছেন। গভর্নর বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি একেবারে তলানিতে। তিনি তার ৩৬ বছরের সরকারি চাকরিজীবনে এর চেয়ে সংকটাপন্ন সময় আর দেখেননি। এগুলো ছিল গভর্নরের সরল উক্তি। তবে তিনি টানেলের শেষপ্রান্তে আলো দেখতে পাওয়ার কথাও বলেছেন। যে কোনো আশাবাদী ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিই তো জাতিকে আশার বাণী শোনাবেন। মানুষ তো আশা নিয়েই বেঁচে থাকে। আশাহীন মানুষ যে কোনো বিপর্যয় ঘটাতে পারে। অতীতে আশাহীন লোকরা অধিক পরিমাণে খাদ্য মজুদ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি করেছিল এ কথা কে না জানেন? গভর্নরের এই আশাবাদের বিষয়ে খোঁচা দিতে গিয়ে মার্কিন প্রবাসী অর্থনীতির অধ্যাপক লিখেছেন, ‘তার দিব্যচক্ষুতে একক আলো-দর্শন অনেকটা আধ্যাত্মিক বাণীর মতো শোনাচ্ছে। এ যেন লালনের আখড়ায় শিক্ষালাভের প্রথম ধাপ যেখানে গুরু সব দেখতে পান, শিষ্যরা কিছুই দেখে না’ {ভবিষ্যতে এ দেশে এলে লালনের আখড়ায় বেড়াতে যাওয়ার অনুরোধ জানাই। আপনার কাল্পনিক তথ্য লালনের আখড়ার বিষয়ে সঠিক নয় বলেই আমি জানি}।

প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে, অর্থনীতির অধ্যাপনা আর একটি দরিদ্র দেশের অর্থনীতি পরিচালনা করা এক নয় অধ্যাপক এ কথা জানেন না, সম্ভবত তা নয়। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের আহ্বানে সাড়া দিয়ে এর আগে প্রধান অর্থনীতিবিদ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকে কাজ করেছেন। কয়েক বছর কর্মজীবনের অবদান হিসেবে তিনি বাংলা একাডেমিতে একটি ব্যাংক মেলার আয়োজন করেছিলেন। তার গবেষণালব্ধ লক্ষ্যমাত্রা ছিল, এই মেলায় বিভিন্ন শ্রেণির লোক আসবে এবং বিভিন্ন ব্যাংকের স্টলে দাঁড়িয়ে ব্যাংক সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান নেবে। কিন্তু কোটি কোটি টাকা খরচের এ আয়োজন একেবারেই জমেনি। স্টলে দায়িত্ব পালনের জন্য বহালকৃত ব্যাংক কর্মকর্তারা তাদের দৈনন্দিন একঘেয়ে জীবনের মধ্যে একটু বিনোদন করার সুযোগ পেয়েছিলেন এই মেলা উপলক্ষে। নিজেদের মধ্যে নিজেরা আড্ডা দিয়েছেন, চটপটি-ফুচকা খেয়েছেন। কিন্তু দর্শকের অভাবে ব্যাংক সম্পর্কে জ্ঞান বিতরণ করতে পারেননি।

বাংলাদেশ ছেড়ে আমাদের যে ভাইয়েরা প্রবাসে গেছেন, তাদের প্রতি আমাদের ভালোবাসা অফুরন্ত। আমরা মায়ের বুকে মাথা রেখে ঘুমাতে পারি। তাদের ওই সুযোগ হয় না। সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক কারণে ভাইয়ে ভাইয়ে বিচ্ছেদের মতোই নিবাসী আর প্রবাসীর ভেতর একটি বিচ্ছেদ-বেদনা সব সময় অনুরণিত হয়। কিন্তু যারা এ ভালোবাসাকে কাজে লাগিয়ে নানা মতলব বাস্তবায়ন করতে চান, তাদের প্রতি আমার অনুরোধ আপনাদের উদ্দেশ্য আমরা বুঝতে পারি। গড় অঙ্ক শিখিয়ে কাছা মেরে পানিতে নেমে পড়ার জন্য আপনারা যতই উৎসাহ দেন, আমরা তা করতে চাইব না। আমরা আপনাদের চিনেছি। তাই আপনাদের লেখাগুলো আমরা কিছুটা সন্দেহের চোখেই দেখি। আপনাদের আল্টিমেট উদ্দেশ্যটি আমরা যেন বা ধরতে পারছি। অন্তত টানেলের শেষে তা দেখতে পাচ্ছি। আমরা অবশ্যই সাবধান হব। আপনাদের কাছেও অনুরোধ জানাই, দেশের স্বার্থটি আগে দেখেই লেখালেখি করবেন। বাংলাদেশে অনেক নামি-দামি অর্থনীতিবিদ রয়েছেন (তারা প্রবাসী হয়ে যাননি) যারা এখনো জাতিকে আশাবাদের কথাই শোনাচ্ছেন।


মাহফুজুর রহমান : অর্থনীতি বিষয়ের কলাম লেখক ও শিশুসাহিত্যিক