ব্লু ইকোনমি : দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা সময়ের দাবি
প্রতিটি ইন্ডাস্ট্রি উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো দক্ষ ও নিবেদিত মানবসম্পদের প্রাচুর্যতা। একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, ওই দেশের সব ইন্ডাস্ট্রির সাফল্যের ওপর নির্ভর করে। এ ক্ষেত্রে মানবসম্পদের ভূমিকা অমূল্য, বিশেষ করে নতুন ও ক্রমবর্ধমান ইন্ডাস্ট্রিগুলো কখনই দক্ষ মানবসম্পদ ছাড়া এগিয়ে যেতে পারে না।
একটি ইন্ডাস্ট্রির বিবর্তনের পাঁচটি অনুক্রমিক পর্যায় রয়েছে। এ পাঁচটি পর্যায়ে ওই ইন্ডাস্ট্রির প্রতিটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন সময় পাঁচটি স্বতন্ত্র বাজারভিত্তিক প্রতিযোগিতা ও পরিবেশের সম্মুখীন হয়। পাঁচটি পর্যায় হলো জন্ম (embryonic), বৃদ্ধি (grwoth), ঝাঁকুনি (shakeout), পরিপক্ব বা পরিণত (mature) ও পতন (decline) পর্যায়। একটি ইন্ডাস্ট্রির জন্ম (embryonic) পর্যায়টি হলো এমন একটি সময়- যখন কোনো এক দেশে সবেমাত্র ওই ইন্ডাস্ট্রির বিকাশ শুরু করেছে এবং বৃদ্ধির (grwoth) স্তরটি হলো- যখন ওই ইন্ডাস্ট্রির পণ্যগুলোর চাহিদা বাড়তে শুরু করে। যাহোক, ঝাঁকুনি (shakeout) পর্যায়কে প্রতিযোগিতামূলক বাজার পর্যায় বলা হয়। এ পর্যায়টি অনির্দিষ্টকালের জন্য বজায় থাকে না। কারণ অনেক প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠান বাজারে প্রবেশ করে। পরিণত (mature) পর্যায় হলো এই অবস্থা- যেখানে ওই ইন্ডাস্ট্রির বিকাশ থেমে যায়। এতে ওই শিল্পের বাজার এক সময় একটি নেতিবাচক বা পতনের (decline) পর্যায়ে চলে যায়।
বর্তমানে বাংলাদেশে এমন কিছু ইন্ডাস্ট্রি রয়েছে- যেগুলো ঝাঁকুনি (shakeout), পরিপক্ব বা পরিণত (mature) পর্যায়ে পৌঁছেছে। এমতাবস্থায় আমরা যে ইঙ্গিত পাই, তা হলো আমাদের দেশের অনেক ইন্ডাস্ট্রি এখন পতনের (decline) পর্যায় থেকে খুব বেশি দূরে নয়। তাই এখনই আমাদের নীতিনির্ধারকদের নতুন নতুন সম্ভাবনাময় ইন্ডাস্ট্রি খুঁজে বের করতে হবে। এতে নতুন ইন্ডাস্ট্রির ক্রমবর্ধমান বিকাশের জন্য দ্রুত যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভবা হবে। নতুন ও সম্ভাবনাময় ইন্ডাস্ট্রিগুলোর অর্থনৈতিক ভূমিকায় বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখা সম্ভব হবে।
আমাদের এমন কিছু ইন্ডাস্ট্রি বের করতে হবে- যা বৈদেশিক মুদ্রা এনে দেবে। আমাদের দেশ এখন ডলার সংকটে জর্জরিত। আর এই সংকট মোকাবিলায় বৈদেশিক মুদ্রা এনে দিতে পারে- এমন শিল্পের অনুসন্ধান করা আবশ্যিক! এ ক্ষেত্রে ব্লু ইকোনমি ইন্ডাস্ট্রি বিশাল সম্ভাবনাময় এক ইন্ডাস্ট্রি। এটি হতে পারে আমাদের অর্থনৈতিক ও ডলার সংকট মোকাবিলার জন্য অন্যতম নিয়ামক।
দেশের ব্লু ইকোনমি ইন্ডাস্ট্রির উত্থানে উপকূলীয় এলাকায় খুব তাড়াতাড়ি বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা অত্যন্ত প্রয়োজন। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় এসব প্রতিষ্ঠানকে উপকূলবাসী জরুরি আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহার করতে পারবে। এতে ব্লু ইকোনমি ইন্ডাস্ট্রির জন্য দক্ষ মানবসম্পদ বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় জীবন রক্ষা করার আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যাও বাড়বে। এ ছাড়া সারাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ব্লু ইকোনমি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত কোর্স এবং প্রশিক্ষণ প্রদান শুরু করা যেতে পারে। ফলে আমাদের বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর এই ধরনের সম্ভাবনাময় ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করার জন্য দক্ষতা অর্জন করার পাশাপাশি নিজেরা প্রস্তুত হবে। এভাবে এই ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করার জন্য আমরা অদূর ভবিষ্যতে একটি বৃহত্তর দক্ষ ও নিবেদিত জনশক্তি পেতে পারি। সমুদ্রভিত্তিক ইন্ডাস্ট্রিগুলো পর্যটন, মাছ ধরা ও পরিবহনশিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। ফলস্বরূপ- ওই শিল্পগুলোতেও মানবসম্পদ উন্নয়ন গুরুত্বপূর্ণ।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
আমরা জানি, বাংলাদেশের পর্যটন এলাকাগুলোয় প্লাস্টিকের অতিরিক্ত ব্যবহার একটি অত্যন্ত ভয়ানক ও সমালোচিত সমস্যা। ব্যবহৃত প্লাস্টিকগুলোর বেশিরভাগই সমুদ্রে ফেলা হয়। এ ক্ষেত্রে পর্যটন ব্যবসায় যেমন- হোটেল, রেস্তোরাঁ, রিসোর্টে কর্মরত কর্মীদের যদি বাংলাদেশের ব্লু অর্থনীতির টেকসই ও পরিবেশগত দিক সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়; তা হলে তারা সমুদ্র এবং সামুদ্রিক মাছ ও প্রাণীর ওপর প্লাস্টিকের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে জানতে পারবেন এবং সচেতন হবেন। ফলস্বরূপ- তারা প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাবেন এবং প্লাস্টিক দ্রব্য সমুদ্র বা নদীতে ফেলা থেকে বিরত থাকবেন।
সমুদ্র সংশ্লিষ্ট প্রত্যেক ব্যক্তি, বিশেষ করে মাছ ধরাশিল্পের জেলে, নাবিক, জাহাজের ক্রু ও সমুদ্র পরিবহনশিল্পের অন্যান্য কর্মীর কার্যকলাপের কারণে কীভাবে সমুদ্র দূষণ হয় এবং তা থেকে সমুদ্রকে কীভাবে রক্ষা করা যায়, এটি সম্পর্কে তাদের জ্ঞান অনেক কম। তবে ব্লু ইকোনমি ইন্ডাস্ট্রি সংশ্লিষ্ট সংক্ষিপ্ত কোর্স ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তারা সম্যক জ্ঞান অর্জন করতে পারবেন। এতে আমাদের এক বিশাল দক্ষ ও সচেতন মানবসম্পদ সৃষ্টি হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার ইতোমধ্যে বদ্বীপ পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে। এ উদ্যোগটির বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ব্লু ইকোনমিভিত্তিক মানবসম্পদের উন্নয়ন কার্যক্রম খুবই উপকারী ভূমিকা পালন করবে। কাজেই বাংলাদেশের ব্লু ইকোনমির বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন, সংক্ষিপ্ত কোর্স, সচেতনতা তৈরি কর্মসূচির উদ্যোগ নেওয়া এখনই সঠিক সময়। তবে আমাদের রয়েছে অনেক সীমাবদ্ধতা। আমাদের দেশে যে কোনো উদ্যোগ বাস্তবায়নের মন্থর গতি অনেক সম্ভাবনাময় শিল্পের সফলতাকে বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দেয়। তাই আমরা অনেক সম্ভাবনাময় ইন্ডাস্ট্রি থেকে আশানুরূপ অর্জন ফল করতে পারিনি। সীমাহীন দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি আর পক্ষপাতমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণসহ বিভিন্ন সমস্যা দেশের উন্নয়নকে করে তুলেছে অনেক প্রশ্নবিদ্ধ। তাই ব্লু ইকোনমির সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে আমাদের দ্রুত কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। শুধু তা-ই নয়, আমাদের সব ধরনের দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিকে দূরে রাখতে হবে। না হলে এই শিল্পের আশুবাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
শুরুতে বলেছিলাম, এ দেশ ডলার সংকটে জর্জরিত। কিন্তু এই সংকট মোকাবিলায় ব্লু ইকোনমি ইন্ডাস্ট্রি হতে পারে অন্যতম নিয়ামক। কিন্তু অতিদুর্নীতি, দীর্ঘসূত্রতা, স্বজনপ্রীতি ইত্যাদি এই শিল্পের উন্নয়নে বড় বাধা। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের বিনীত অনুরোধ এই যে, ‘তিনি যেন এই অপার সম্ভাবনাময় ইন্ডাস্ট্রিকে অগ্রাধিকারভিত্তিক ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে স্বীকৃতি দেন এবং একান্ত মনোনিবেশ করেন।’ প্রধানমন্ত্রীর অপরিসীম পরিশ্রম ও একনিষ্ঠ নেতৃত্বের আশীর্বাদে দেশ আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে, জনগণ স্বপ্ন দেখছে উন্নত বাংলাদেশের। তাই তার একাগ্র মনোনিবেশ এই সম্ভাবনাময় শিল্পের জন্য খুব জরুরি। ব্লু ইকোনমি ইন্ডাস্ট্রির যদি কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে, তা হলে অনেক বিদেশি পর্যটক ও ব্যবসায়ী এ দেশে ভ্রমণ করবেন। এতে সরাসরি বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসবে, এমনকি আমাদের সামুদ্রিক সম্পদ ব্যবহারের পর অতিরিক্ত সামুদ্রিক পণ্য ও কাঁচামাল বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে ডলার সংকট মোকাবিলা করতে পারব।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
অতীতে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে অনেক সময় লেগে যেত। কারণ সবকিছু ছিল ম্যানুয়াল। আর এখন আমাদের দেশকে বলা হয় ডিজিটাল বাংলাদেশ। তাই ব্লু ইকোনমি ইন্ডাস্ট্রির জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণে আমাদের ডিজিটালব্যবস্থা খুব সহায়ক হতে পারে। যে সিদ্ধান্ত নিতে দিন, মাস, বছর লেগে যেত; ডিজিটালব্যবস্থার কারণে তা এখন এক মুহূর্তেই সম্ভব। ফলে ব্লু ইকোনমি ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে যে কোনো সিদ্ধান্ত দ্রুত নেওয়া ও টেকসইয়ের নিশ্চয়তা দিয়ে দ্রুত বাস্তবায়ন হোক। এতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগ ও দেশের সুনাম বাড়বে, এমনকি এ দেশের অসংখ্য বেকার যুবকের জন্য অনেক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। ফলে দেশ এক উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হবে- যার স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ওই স্বপ্ন বাস্তবায়নে ব্লু ইকোনমি ইন্ডাস্ট্রি উন্নয়নভিত্তিক কার্যক্রম শুরু করা সময়ের দাবি ও খুবই জরুরি।
ড. মো. আসাদুল ইসলাম : সহকারী অধ্যাপক, ব্র্যাক বিজনেস স্কুল, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি
আরও পড়ুন:
দিকে দিকে মাফিয়াতন্ত্র-২