মাটি ও পানি : জীবনের একটি উৎস

রত্না খাতুন
০৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
শেয়ার :
মাটি ও পানি : জীবনের একটি উৎস

মাটি কৃষির মূল মাধ্যম। এটি মানব প্রজন্মের নিরিখে অনবায়নযোগ্য ও সসীম সম্পদ। ‘ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব সয়েল সায়েন্স’ সারা পৃথিবীর মানুষের মাঝে মৃত্তিকাসম্পদ নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য ২০০২ সালে প্রতিবছর ৫ ডিসেম্বরকে বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পরে এর গুরুত্ব অনুধাবন করে জাতিসংঘের ‘সাধারণ পরিষদ’ ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে ৫ ডিসেম্বরকে ‘বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। ২০১৪ সালের ৫ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের ঋঅঙ-এর মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বব্যাপী ‘বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস’ পালিত হয়। সেই থেকে ‘বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস’ টেকসই মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব এবং এর প্রচার-প্রচারণার দায়িত্ব পালন করে আসছে। সারা বিশ্বে দিনটিকে মাটির স্বাস্থ্য এবং এর ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে বিজ্ঞানী, ছাত্র, কৃষকদের অবহিত ও অনুপ্রাণিত করার জন্য ব্যবহার করা হয়। দিবসটির গুরুত্ব তুলে ধরার জন্য প্রতিবছর আলাদা থিম (Theme) ব্যবহার করা হয়। এ বছর ‘বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস’-এর প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‘সয়েল অ্যান্ড ওয়াটার : এ সোর্স অব লাইফ’ অর্থাৎ ‘মাটি ও পানি : জীবনের একটি উৎস।’ পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের মোট ২৫ শতাংশের সরাসরি আবাসস্থল হলো মৃত্তিকা। মৃত্তিকার অণুজীব কর্মকাণ্ড মাটির গুণাগুণ এবং কৃষি উৎপাদনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। FAO-এর মতে Soil microorganism-এর মাত্র ১ শতাংশ সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন অর্থাৎ অধিকাংশই এখনো অজানা।

মাটি সব স্থলজ প্রাণীর খাবারের প্রধান উৎস এবং বাস্তুতন্ত্রের ধারক ও বাহক। পৃথিবীর সব জীব মাটি থেকে শুরু এবং মাটিতেই শেষ। এ ছাড়া সারা পৃথিবীর জীবসমূহের প্রায় ৯০ ভাগই জীবনচক্রের কোনো না কোনো অংশ মাটিতে অতিবাহিত করে। এটি শুধু খাদ্য নয়, ওষুধেরও প্রধান উৎস।

বিশ্বের অনেক জায়গার মতো আমাদের দেশের সোনার মাটিও ভালো নেই। কৃষি ও পরিবেশগত ঝুঁকিসহ বিভিন্নভাবে বাংলাদেশে মাটির গুণাগুণ হ্রাস পাচ্ছে। ভূমির ওপর প্রাকৃতিকভাবে ১ ইঞ্চি পরিমাণ মৃত্তিকা গঠিত হতে ৫০০-১০০০ বছর পর্যন্ত সময় লেগে যায়। অথচ নানা কারণে ভূমির উপরিভাগের মাটি যা চাষাবাদ ও বৃক্ষ জন্মানোর মাধ্যম তা নষ্ট হচ্ছে। বাংলাদেশে soil biodiversity হ্রাসের কারণের মধ্যে অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়ণ, কীটনাশকের অপরিকল্পিত ব্যবহার, ব্যাপকভাবে বনভূমি ধ্বংস করা, পাহাড়ে জুম চাষ, ইটের ভাটা অন্যতম। এগুলো বিপুল পরিমাণ ভূমি ক্ষয় ঘটাচ্ছে। সংরক্ষিত বনাঞ্চলে রিসোর্ট তৈরি, এমনকি শিল্পকারখানা পর্যন্ত স্থাপিত হচ্ছে যা মাটির ক্ষয় ও পরিবেশ দূষণ ঘটাচ্ছে। আমাদের দেশে প্রতিবছর প্রায় ৩ শতাংশ করে বনভূমি বিনাশ হচ্ছে যা ব্যাপকভাবে ভূমি ক্ষয়ের কারণ।

জীবিকা নির্বাহের জন্য সব জীব মাটির ওপর নির্ভরশীল। মাটিতে হাজার হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ জন্মায়। উদ্ভিদ মাটি থেকে বিভিন্ন প্রকার পুষ্টি সংগ্রহ করে। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী উদ্ভিদ থেকে তাদের পুষ্টি গ্রহণ করে। উদ্ভিদ থেকে মানুষ খনিজ, ভিটামিন এবং প্রোটিন গ্রহণ করে যা তাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন। অর্থাৎ খাদ্যের জন্য মানুষ মাটির ওপর নির্ভরশীল। যখন আমরা ফসল সংগ্রহ করি তখন ফসলের সঙ্গে সঙ্গে মাটির কিছু পুষ্টি উপাদানও আমরা নিয়ে যাই। একে বলা হয় মাটির পুষ্টি রপ্তানি। এর ফলে মাটিতে পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি দেখা দেয়। উদ্ভিদ মাটি থেকে যে পুষ্টি গ্রহণ করে তা সার বা অন্য কোনো উপায়ে মাটিতে ফেরত দিতে হবে। এতে মাটির উর্বরতামান বজায় থাকবে। সরকারি এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট ভূমির প্রায় ৭৫ শতাংশই এখন উর্বরতা ঘাটতিতে ভুগছে। এ অনুর্বর হয়ে পড়া জমির পরিমাণও প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বেশিরভাগ উপজেলার পরীক্ষিত মাটিতে জৈব পদার্থ ও নাইট্রোজেনের ঘাটতি পাওয়া গেছে। ফসফরাস, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, সালফার, বোরন প্রভৃতি রাসায়নিক পদার্থ সঠিক মাত্রায় নেই।

আগামী ২০৫০ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা ৯০০ কোটিতে পৌঁছাবে। ব্যবস্থা না নিলে মাটির অবক্ষয় হবে ভয়াবহ। যা খাদ্য, পানি ও বাতাসকে করে তুলবে ভয়ানক রকম বিষাক্ত। পৃথিবীর খাদ্যের চাহিদা পূরণের জন্য মাটি অত্যাবশ্যক। পৃথিবীর প্রায় ৯৫ ভাগ খাদ্য জোগান দেয় মাটি। সুস্থ মাটি পৃথিবীর ক্ষুধা দূর করতে এবং আমাদের জন্য স্বাস্থ্যকর একটি গ্রহ উপহার দিতে সক্ষম।

অপরদিকে পানির অপর নাম জীবন। জীবনের অধিকার মানে পানির অধিকার। পানি থাকলেই জীবন থাকবে। পানি ছাড়া জীবনের অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না। সুপেয় পানি প্রাপ্তির সুযোগ বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। জাতিসংঘ পানি অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে ঘোষণা করেছে। কিন্তু অধিকার হিসেবে স্বীকৃত হলেও এখনো এ অধিকার থেকে বঞ্চিত ৭৬ কোটিরও বেশি মানুষ। তাই সুপেয় পানির অধিকার রক্ষা করা আজ জরুরি। না হলে সংকটাপন্ন এলাকাগুলো আরও বেশি ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। জাতিসংঘ বলছে, বিশ্বের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ পর্যাপ্ত পানি পায় না। বলা হচ্ছে, আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ ৯৩০ কোটি মানুষের মধ্যে ৭০০ কোটিই পানির সমস্যায় পড়বেন। কাজেই এ সমস্যা মোকাবিলা করতে হলে পানির অপচয় রোধ ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানিসম্পদ প্রকৌশল বিভাগের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রতিবছর ভূগর্ভের পানির স্তর দুই থেকে পাঁচ মিটার করে নিচে নামছে। এতে পানিতে আর্সেনিকের পরিমাণ যেমন বাড়ছে, তেমনি আশঙ্কা দেখা দিয়েছে ভূমিধস ও মাটি দেবে যাওয়াসহ নানা দুর্ঘটনার।

ওয়াটার রিসোর্স প্ল্যানিং অর্গানাইজেশনের (ওয়ারপো) পক্ষ থেকে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম) উঁচু বরেন্দ্র অঞ্চল রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁর ভূপৃষ্ঠ ও ভূগর্ভস্থ পানি পরিস্থিতি নিয়ে হাইড্রোলজিক্যাল অনুসন্ধান ও মডেলিং শীর্ষক গবেষণা করেছে। গবেষণাটি ২০১৮ সালে শুরু হয় এবং গবেষণা থেকে জানা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বরেন্দ্র অঞ্চলে আগের চেয়ে দিন দিন পানি সংকটাপন্ন এলাকা বাড়ছে। আন্তর্জাতিক পানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, ভূ-উপরিভাগ ও ভূগর্ভস্থ পানির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। পানির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত না করলে, পানি সম্পর্কিত সমস্যাগুলো বৃদ্ধি হতে পারে, যা পুরো সমাজের উন্নতির ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।

মাটি ও পানির স্বাস্থ্যের সঙ্গে মানবস্বাস্থ্যের সম্পর্ক নিবিড়। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন টেকসই মৃত্তিকা ও পানি ব্যবস্থাপনা। বাংলাদেশের কৃষি এখন খরপোশ কৃষি থেকে বাণিজ্যিক কৃষিতে উত্তরণের ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি উৎপাদিত কৃষিপণ্যের গুণাগুণ বজায় রাখতে হলে পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় পরিবেশের প্রধান উপাদান মাটি ও পানির সঠিক ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। ভবিষ্যতে দেশের আবাদি জমির পরিমাণ আরও কমবে যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বিপদের কারণ হতে পারে। মাটি বাঁচলে পরিবেশ বাঁচবে, দেশ বাঁচবে। পরিবেশ বাঁচলে রক্ষা পাবে প্রাণী ও উদ্ভিদজগৎ।


রত্না খাতুন : বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ, ঢাকা-১২০৭