বেকারত্ব নিরসন আগামী সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ

সৈয়দ ফারুক হোসেন
০২ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
শেয়ার :
বেকারত্ব নিরসন আগামী সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অভিশাপ হচ্ছে বেকারত্ব। দিন দিন বেড়েই চলেছে বেকারের সংখ্যা। একজন মানুষ যখন তার পেশা হিসেবে কাজ খুঁজে পায় না, তখন যে পরিস্থিতি তাকে মোকাবিলা করতে হয় সেটাই বেকারত্ব। দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বেকারত্বের হার বাংলাদেশেই বেশি। শিক্ষিতদের মধ্যে ৩৩ শতাংশের বেশি বেকার। বিশেষ করে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে প্রথম শ্রেণিপ্রাপ্তদের মধ্যে ৩৪ দশমিক ৪ শতাংশই বেকার। বেকারত্ব শুধু অর্থনৈতিক অভিশাপই নয়। বেকারত্ব একই সঙ্গে একটি মানবিক ও সামাজিক দুর্যোগও বটে। বেকারত্বের হার বাড়তে থাকলে সমাজের সুখ কমতে থাকে। বিশ্বের অসুখী দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের স্থান সপ্তম। উচ্চশিক্ষা এখন আর কাজ পাওয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারছে না।

বেকারত্ব বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল একটি দেশের অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। বিশ্বে যুদ্ধ বিগ্রহ, করোনা ও ডেঙ্গু মহামারী, অর্থনৈতিক মন্দাসহ বিভিন্ন কারণে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। আগামী সরকার ক্রমবর্ধমান এই সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে অর্থনৈতিক অবকাঠামো ভয়াবহ ভাঙনের মুখে পড়তে পারে। একজন শিক্ষার্থী যখন অনার্স মাস্টার্স শেষ করেও চাকরি পায় না, তখন তাদের মধ্যে ডিপ্রেশন আরও বহু গুণ বেড়ে যায়। কাজের সুযোগ না পেয়ে অনেকে মাদকসহ নানাবিধ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। হতাশায় জীবন কাটাচ্ছে। অনেকেই বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার পথ। দেশে সরকারি খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত। বেসরকারি খাত কাক্সিক্ষত মানে বাড়ছে না। দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকার এখন ভয়াবহ পর্যায়ে রয়েছে। তরুণরা যত বেশি পড়ালেখা করছেন, তাদের তত বেশি বেকার থাকার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। বেকারত্ব কাজের অভাবে অনিচ্ছাকৃত কর্মহীনতা। বেকার বলতে শ্রমশক্তির সেই অংশকে বোঝানো হয়, যারা একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সন্ধান করা সত্ত্বেও কোনো কাজ পায় না। আমাদের তরুণ সমাজের হতাশার সবচেয়ে বড় কারণটি হচ্ছে দেশে চাকরির বাজারের সংকোচন। এসব তরুণকে উদ্যোক্তা বানানোর কথা শোনা গেলেও বাস্তব তার বিপরীত। দেশে প্রতিবছরই আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা। এ ক্ষেত্রে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা, কোটাপদ্ধতি, আর সেশনজটের মতো কারণগুলো অন্যতম। দেশে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি শিক্ষিত যুব সমাজের মধ্যে।

শিক্ষাব্যবস্থায় তথ্যপ্রযুক্তির কম ব্যবহার আর কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সমান সুযোগের অভাব। যে তুলনায় পাস করে বের হচ্ছে, সে তুলনায় আমাদের কর্মসংস্থান হচ্ছে না। চাকরি থেকে অবসরের বয়স বাড়ানো হয়েছে কিন্তু চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানো হয়নি। বৈশ্বিক মহামারী করোনায় ক্রমবর্ধমান হারে শুধু মানুষই মারা যায়নি, একই সঙ্গে তা বিশ্ব অর্থনীতিকেও দমিয়ে দিয়েছে। বিশ্বের কোনো দেশই বেকারত্ব থেকে মুক্ত নয়। উন্নত বিশ্বেও বেকারত্ব রয়েছে। তবে তাদের বেকারত্ব আর আমাদের দেশের মতো উন্নয়নকামী দেশের বেকারত্বের ধরন এক নয়। অর্থনীতি মহামন্দার সম্মুখীন, যা অতীতের সব মহামন্দাকেই ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।

বেকারত্বের কারণে সৃষ্ট সমস্যা সামাল দেওয়া তাৎক্ষণিকভাবে সম্ভব নয়। কারণ বেকারদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া, যা বছরের পর বছর চেষ্টার ফল। বাংলাদেশে বেকার সমস্যা একক কোনো সমস্যা নয় বরং বহুবিধ সমস্যার জনক। এ সমস্যা ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবন থেকে শুরু করে জাতীয় জীবনেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এ সমস্যা সমাধানে সরকারি সদিচ্ছা যেমন জরুরি, তেমনি সৎ ও যোগ্য নেতৃত্বেরও প্রয়োজন। বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং শিক্ষিত ও পরিশ্রমী জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন ধরনের কাজে উৎসাহী করে তুলতে পারলেই বেকারত্বের বিশাল বোঝা কিছুটা হলেও লাঘব হবে বিশ্বাস। মহামারীতে মধ্য আয়ের দেশগুলোর তরুণরা সবচেয়ে বেশি বেকার হয়েছেন। বেকারত্ব ঘোচাতে অবৈধ পথে বিদেশে পাড়ি জমানোর চেষ্টাও করছেন অনেকে। অবৈধ পথে যাওয়ার কারণে মৃত্যুর পাশাপাশি গ্রেপ্তারও হতে হচ্ছে তাদের। প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ তরুণ-তরুণী বাংলাদেশের চাকরির বাজারে যোগদান করেন। এদের বড় একটি সংখ্যক স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পড়াশোনা শেষ করে সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে প্রবেশের চেষ্টা করেন। লন্ডনের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) তথ্যমতে, বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি। প্রতি ১০০ জন স্নাতক ডিগ্রিধারীর মধ্যে ৪৭ জনই বেকার। অর্থাৎ প্রতি দুজনে একজনের নাম বেকারের খাতায় অন্তর্ভুক্ত। ফলে আমাদের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্রমাগত অবনতি হচ্ছে এবং হারিয়ে ফেলছি অনেক মূল্যবান প্রাণ।

আমাদের বেকার তরুণরা একটি চাকরির সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরছে, বিদেশ যাওয়ার জন্য সর্বস্ব বিক্রি করছে, অন্যদিকে আমাদেরই প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশিদের নিয়োগ দিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা দেশ থেকে চলে যাওয়ার রাস্তা করে দিচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জরিপে উঠে এসেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের ৬৬ শতাংশ অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশই বেকার থাকছেন। ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরি পান। ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী এখনো অন্য কোনো বিষয়ে স্নাতকোত্তর বা কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করছেন কিংবা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। ৩ শতাংশ স্ব-উদ্যোগে কিছু করছেন, এই তথ্য উদ্বেগজনক। স্নাতক বা স্নাতকোত্তর শেষ করে একজন শিক্ষার্থীর পুরো শিক্ষাজীবন শেষ করতে ১৬ থেকে ১৮ বছর অতিবাহিত হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেশনজট মিলিয়ে আরও তিন-চার বছর বেশি লেগে যায়। এর পর পরিবারের হাল ধরতে খুঁজতে হয় চাকরি। সন্তোষজনক চাকরি পাওয়া নিয়ে উচ্চশিক্ষিত তরুণদের মধ্যে হতাশা ক্রমেই বাড়ছে। চাকরির বাজারের ব্যাপক প্রতিযোগিতায় অভিজ্ঞতা শব্দটি বরাবরই দীর্ঘশ্বাসের কারণ। সদ্য স্নাতক পাস করা শিক্ষার্থীরা চাকরি পায় না অভিজ্ঞতার অভাবে। দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়ে দেশের মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। বেকারদের দুঃখ-কষ্ট উপলব্ধি করতে হবে। দেশের টাকা দেশে রেখে অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে হবে।


সৈয়দ ফারুক হোসেন : রেজিস্ট্রার, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়